SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার

ভূমিকা : বর্তমান বিশ্বসভ্যতা যে কয়টি মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন, মাদকাসক্তি তার অন্যতম। পুরােনাে সামাজিক মূল্যবােধের অবক্ষয় ঘটছে দিনে দিনে, নতুন মূল্যবােধও গ্রহণযােগ্য হয়ে ওঠেনি। সামগ্রিকভাবে সমাজব্যবস্থা চলছে বিভ্রান্তি ও, অস্থিরতার মধ্যে আর এই অবস্থা একদিকে যেমন স্বাচ্ছন্দ্য আনছে, অন্যদিকে সারিত করছে হতাশা ও উদ্বেগ। ফলে বিশৃঙ্খল এক পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে নানা মানুষ নানা বিষয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। যার কোনােটি খারাপ, কোনােটি আবার খারাপ আসত্তি তৈরি করছে। নানারকম এই আসক্তির মাঝে বিপদজ্জনক ও ভয়ংকর এক আসক্তি হচ্ছে। মাদকাসক্তি। এই আসক্তি এক ভয়ংকর ব্যাধিরূপে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। মাদকাসক্তি এখন সারাবিশ্বের অন্যতম সমস্যা। এমন দেশ সম্ভবত বিশ্বের কোথাও পাওয়া যাবে না, যেখানে মাদকাসক্তির কালাে ছায়া তরুণসমাজকে স্পর্শ করছে না।
মাদকদ্রব্য ও মাদকাসক্তি : মাদকদ্রব্য হচ্ছে সেসব বস্তু বা গ্রহণের ফলে স্নায়বিক বৈকল্যসহ নেশার সৃষ্টি হয়। সুনির্দিষ্ট সময় পর পর মাদক সেবনের দুর্বিনীত আসক্তি অনুভূত হয় এবং কেবল সেবন দ্বারাই সে আসত্তি দূরীভূত হয়। আর মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে নেশা সৃষ্টিকে মাদকাসক্তি বলা হয়। তবে বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার মতে, ‘মাদকাসক্তি হচ্ছে চিকিৎসা গ্রহণযােগ্য নয় এমন দ্রব্য অতিরিক্ত পরিমাণে ক্রমাগত বিক্ষিপ্তভাবে গ্রহণ করা এবং এসব দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া। 
মাদকদ্রব্যের ধরণ : বর্তমান বিশ্বে নানা ধরনের মাদক দ্রব্য চালু রয়েছে। মদ, গাজা, ভাং, আফিম ইত্যাদি প্রাচীনকালের মাদকদ্রব্য। বর্তমানে প্রচলিত রয়েছে হেরােইন, মারিজুয়ানা, এলএসডি, হাসিস, কোকেন, প্যাথিড্রিন, ফেনসিডিল ইয়াবা ইত্যাদি। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে হেরােইনই সবচেয়ে বেশি আলােড়ন সৃষ্টিকারী মাদকদ্রব্য। বাংলাদেশে যেসব মাদকদ্রব্য সেবন সর্বাধিক সেগুলাে হলাে গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরােইন, মদ, বিয়ার, তাঁড়ি, পচুই, প্যাথেড্রিন ইনজেকশন ইত্যাদি।
মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট : মাদকদ্রব্য চোরাচালানের যাত্রাপথে বাংলাদেশের মানচিত্র অন্তর্ভুক্ত হওয়ার এ সমস্যা আমাদের সমাজে দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের সীমান্ত গােল্ডেন ওয়েজ বা মাদক পাচার ও চোরাচালানের জন্য বিখ্যাত। আবার পার্শ্ববর্তী দেশগুলােতে মাদক পাচারের ট্রানজিট হিসেবে বাংলাদেশ ব্যবহৃত হওয়ায় বাংলাদেশে মাদক প্রবেশ করছে অবাধে আর বাড়ছে এর ব্যবহার। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ২০ লক্ষ মাদকসেবনকারী রয়েছে এবং এই সংখ্যা দিন দিন আরও বাড়ছে। বিভিন্ন পেশাজীবী, শ্রমজীবী থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে এই মাদকের প্রভাব রয়েছে। তবে আমাদের দেশে মাদকাসক্তির অধিকাংশই যুব সমাজ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা বাংলাদেশে মােট জনসংখ্যার ১৭ ভাগ মাদক ব্যবহার করে। দেশে ৩৫০টি বৈধ গাঁজার দোকান রয়েছে। বৈধ লাইসেন্স ছাড়াও আমাদের দেশে বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর দেশিয় মদ উৎপাদন ও বিক্রি হয়। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন ও অবনতির মাঝামাঝি অবস্থান করছে। আর এই মধ্যবর্তী অবস্থাটিই সমাজে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি করছে। তরুণ সমাজ নৈতিকতা ও মুল্যবােধকে সঠিকভাবে ধারণ ও বিকশিত করতে পারছে না আর দেশীয় অর্থনীতিতে বিরাজমান অস্থিরতা তাদের মধ্যে তৈরি করে হতাশা, ক্ষোভ, বিস্বাদ যার ফলশ্রুতিতে পূর্বের চেয়েও ভয়াল ত্রাসে বাংলাদেশকে ছেয়ে ফেলছে মাদকাসক্তি। 
মাদকের উৎস ও বিস্তার অঞ্চল : মায়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ড সীমান্তে অবস্থিত পপি উৎপাদনকারী অঞ্চলকে বলা হয় গােল্ডেন ট্রায়াঙ্গল। আবার আফগানিস্তন, পাকিস্তান ও ইরান সীমান্তে অবস্থিত আফিম মাদক উৎপাদনকারী অঞ্চলকে বলা হয় গােল্ডেন ক্রিসেন্ট। মাদকের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন আফিম, পপি কুনোর নির্যাস থেকে তৈরি হয় আফিম। আফিম থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় হেরােইন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের আশপাশের দেশগুলোতেই মাদকের উৎস, তার বিস্তার থেকে বাংলাদেশ মুক্ত নয়। তবে শুধু এশিয়াতেই নয় ল্যাটিন আমেরিকার ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, জ্যামাইকা, কলম্বিয়া, গুয়াতেমালাসহ দক্ষিণ আফ্রিকা ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশে মারিজুয়ানা উৎপাদন হয়। আবার দক্ষিণ আমেরিকা, পেরু, কলম্বিয়া, ব্রাজিল কোকেন উৎপাদনে খ্যাত। আর আফিম, হেরােইন উৎপাদন হচ্ছে এশিয়াসহ দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। এভাবে বিশ্বব্যাপী মাদক ছড়িয়ে পড়ছে নীরব ঘাতকের মতাে। 
মাদক আক্রান্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগােষ্ঠী : যেসব পরিবারে পারিবারিক বন্ধন শিথিল, ঘনিষ্ঠতা কম, সেসব পরিবারের সদস্যরাই মাদকাসক্ত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মাদকাসক্তদের গড় বয়স ১৮-৩২ বছর। অর্থাৎ আমাদের যুবসমাজ। জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মতাে একটি উন্নয়নশীল দেশে মাদকাসক্তরা বছরে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে। 
মাদকাসক্তির ক্ষতিকর প্রভাব : মাদকাসক্তির প্রভাব নিঃসন্দেহে ধ্বংসাত্মক। আর সে প্রভাবগুলােই নিম্নে আলােচিত হলাে : 
i. কর্মঠ ও সফল হতে পারত যে যুবসমাজ, মাদকাসক্তি সে যুবসমাজকে অবচেতন ও অকর্মণ্য করে তুলছে। 
ii. বাংলাদেশে বিভিন্ন শ্রেণির মাদকাসক্তরা মাদকদ্রব্য সংগ্রহের জন্য চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত। এই সব অপকর্ম সৃষ্টি করছে সামাজিক বিশৃঙ্খলা।
iii. চোরাচালান বাড়ছে ও দেশের কর্মঠ জনশক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। মাদক। ফলে দেশীয় অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে পড়ছে। 
iv. মাদকদ্রব্য আসক্তদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নানা ক্ষতি করে। 
v.অতিরিক্ত সেবন সমাজে আনছে চরম নৈতিক অধঃপতন। 
vi. আসক্ত ব্যক্তি দ্বারা সৃষ্টি হচ্ছে পারিবারিক ভাঙন এবং পুরাে সমাজব্যবস্থার মানুষের মাঝে হতাশা। 
vii. সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবােধের চূড়ান্ত অবক্ষয় হচ্ছে। 
viii. অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। 
ix. মেধাবী সমাজ ধীরে ধীরে ধ্বংস হচ্ছে।
মাদকাসন্তি ও আমাদের যুবসমাজ : বিশ্বব্যাপী মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার। এবং চোরাচালানের মাধ্যমে এর ব্যাপক প্রসার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। মাদকের নিষ্ঠুর ছােবলে অকালে ঝরে যাচ্ছে তাজা প্রাণ এবং অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে বহু তরুণের সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। প্রেমে ব্যর্থতা, হতাশা, বেকারত্ব, দারিদ্র্য প্রভৃতি কারণে আমাদের দেশের যুবসমাজের এক বিরাট অংশ মাদকদ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আর মাদককে কেন্দ্র করেই সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে। আরও বহু ধ্বংসের সামাজিক সমস্যা। নেশাগ্রস্ত যুবসমাজ শুধু যে নিজেরই সর্বনাশ করে তা নয়, এরা পরিবার ও জাতীয় জীবনকে বিপর্যস্ত ও বিপন্ন করে তুলছে। যে যুবসমাজ দেশকে আলােকিত করবে, সে যুবসমাজ মাদকাসক্ত হয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের মাঝে অন্ধকার নেমে আসে, তাতে শুধু সে নয়, পুরাে দেশ জাতি অন্ধকারে পর্যবসিত হয়ে যাবে। 
মাদকদ্রব্য সেবনের কারণ : সাময়িক জীবনের প্রতি বিমুখতা ও নেতিবাচক সনােভাব থেকেই মাদকসন্তির জন্ম। অভ্যাস থেকে আসক্তি, ধূমপান একদিন পরিণত হয় হেরােইন আসক্তিতে। ধনতান্ত্রিক সমাজ ও অর্থনীতিতে ব্যক্তির ভােগের উপকরণ অবাধ ও প্রচুর। ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে সেখানে চলে স্বেচ্ছাচারিতা, আনন্দের পােশাকে ঘুরে বেড়ায় উচ্ছংখলতা। বর্তমানে সিনেমা ও টেলিভিশনে যেসব অশ্লীল নৃত্য, ছবি, কাহিনি ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে সেসব অনুকরণ করতে গিয়ে তরুণ সমাজ তাদের নৈতিক অধঃপতন ডেকে আনছে। তরুণদের এই বিপদগামীর অন্যতম কারণ হচ্ছে বেকারত্ব। এই বেকারত্ব নামক অভিশাপটি যখন জীবনকে বিষিয়ে তােলে, তখন আপনাতেই মাদকাসক্তের এই ধ্বংসজালে আটকে যেতে হয়। তাছাড়া আবার অনেক সময় অস্থিরতা, কু-চিন্তা, অভাব-অনটন, পারিবারিক কলহের কারণে তরুণ সমাজ এই মােহের জালে আচ্ছন্ন হয়। 
মাদকাসক্তি সমস্যা সমাধানের উপায় : বিশ্বজুড়ে মাদকাসক্তি একটি জটিল সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় এর সমাধানে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। 
ক. প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা : মাদকাসক্তদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক অবস্থা বিচার-বিশ্লেষণ করে তাদের সুস্থ করার জন্য প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাকে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা বলা হয়। আসক্ত ব্যক্তিকে প্রথমে তাদের পরিবেশ থেকে সরিয়ে আনা হয়। যাতে সে পুনরায় মাদক গ্রহণ করতে না পারে। পরে তাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক করার জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
খ. প্রতিরােধমূলক ব্যবস্থা : 
১. মাদকদ্রব্যের উৎপাদন ও আমদানি নিষিদ্ধকরণের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলাের সাথে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করে প্রতিরােধ ব্যবস্থা জোরদার করা। 
২. স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলাে অন্তর্ভুক্ত করা। 
৩. প্রচার মাধ্যম ও আলােচনা সভার মাধ্যমে মাদকের ক্ষতিকর দিক তরুণ সমাজের কাছে তুলে ধরা। 
৪. মাদক প্রতিরােধ ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইনের বাস্তবায়ন করা। 
৫. পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তােলা। 
৬. ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাকে জোরালাে করার প্রচেষ্টা করা। 
৭. তরুণ সমাজের জন্য সুস্থ বিনােদনের ব্যবস্থা করা। 
৮. সামাজিক পরিবেশ উন্নয়নের ব্যবস্থা করা।
উপসংহার : বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মাদকাসক্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য মাদকাসক্তি নিরাময় ও প্রতিরােধ আন্দোলনে আপামর জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে। এর পূর্বশর্ত হিসেবে ধূমপান ও মাদকবিরােধী আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে। সরকারি মহল থেকে শুরু করে গণমাধ্যম ও রাজনীতিবিদ, কূটনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবি, আইনজীবী, সমাজকর্মী, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদসহ সকল শ্রেণির মানুষকে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলে এ বিশ্বকে বাসােপযােগী করে তুলতে হবে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment