বা সমাজ উন্নয়নে বেসরকারি সংস্থা
বা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এনজিও-এর ভূমিকা
ভূমিকা : তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলােতে ' বেসরকারি সংস্থা (Non- Government Organisation) বা এনজিও (NGO) একটি বহুল আলােচিত বিষয়। বাংলাদেশে কর্মরত বেসরকারি সাহায্য সংস্থার অধিকাংশই বিদেশী ধনী রাষ্ট্রগুলোর আর্থিক সাহায্যে পরিচালিত হয়ে। এসব সেবা সংস্থার মধ্যে আশা, গ্শিকা, যনির্ভর বাংলাদেশ, টিএমএসএস, কারিতাস, আরডিআরএস, বিইউআরও এবং শক্তি ফাউন্ডেশন প্রধান। ব্রাক হলাে সর্ববৃহৎ দেশীয় এনজিও। এগুলাোর উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকারের নীতিমালা অনুসরণ করে এদেশের দরিদ্র জনসাধারণের সেবায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখা। বাংলাদেশে কর্মরত এনজিওগুলাের কার্যক্রম ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এনজিও-এর পটভূমি : সত্তরের দশকে দরিদ্র ও অনুন্নত বিশ্বে সাহায্যদানের নতুন কৌশল হিসেবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এনজিও সৃষ্টি করে। ১৯৭৩ সালে নাইরোবিতে বিশ্ব ব্যাংকের পরিচালকমন্ডলীর সভায় ভাষন দিতে গিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা সর্বপ্রথম এনজিও ধরনের একটি বিকল্প গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন সৃষ্টির প্রয়ােজনীয়তা জোরালােভাবে সর্বসমক্ষে তুলে ধরেন। তারপর থেকে ম্যাকনামাবার নেতৃত্বে বিশ্ব ব্যাংক এবং অন্যান্য অর্থ যােগানদাতা সংস্থুগুলাে এ নীতির সপক্ষে শক্তিশালী প্রচারণা চালাতে শুরু করে। এর সাথে এশীয়, উন্নয়ন ব্যাংক নতুন, দৃষ্টিভঙ্গি পােষণ করে। এনজিও সম্পর্ক এডিবি'র মুল্যায়ন হচ্ছে- আমলাতান্ত্রিক সংগঠনগুলাের তুলনায় স্বেচ্ছাসেবী সংপুগুলাে তৃতীয় বিশ্বের গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলাে পূর্ণ করার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশে এনজিও-এর কর্মক্ষেত্র : এদেশে এনজিওগুলাের সাহায্য ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সমন্বয়কারী কেন্দ্রীয় সংস্থা হচ্ছে। এডাব। এডাব সমগ্য বাংলাদেশ ১৩টি অঞ্চলে ভাগ করে ৬২৩টি সংগঠনকে এর আওতায় এনেছে। এর মধ্যে ১৮৫টি সংগঠন এডাবের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সদস্য। সমন্বয়কারী অপর এনজিও হচ্ছে। ভি. এইচ. এস . এস। এর আওতায় রয়েছে। ১৫৩টি বেসরকারি সংস্থা। বাংলাদেশের এনজিওগুলো যেসব ক্ষেত্রে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে,তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য . কয়েকটি হচ্ছে- নিরক্ষরতা দূরীকরণ, দারিদ্র বিমােচন, প্রাথমিক ও বয়স্ক শিক্ষা সম্প্রসারণ, স্বাস্থসেবা, লিঙ্গবৈবষম্য দূরীকরণ, রাস্তাঘাট, কালভার্ট ও ব্রীজ নির্মাণে সহায়তা, প্রদান, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন এবং পুরুষ ও নারীকে স্ব স্ব আজিকে স্বাবলম্বী করে তােল।
বাংলাদেশে এনজিও-এর ভূমিকা : বাংলাদেশে কর্মরত এনজিওগুলাে গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এদেশের বিপুল জনগােষ্ঠী ক্ষুধা, দারিদ্র ও বেকারত্বের শিকার। দিনভর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও এখানকার বেশির ভাগ মানুষ জীবনের ন্যূনতম প্রয়ােজন মেটাতে অক্ষম। এমতাবস্থায় ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর অপুষ্টি তাদে নিত্যসঙ্গী। এনজিওগুলা খুব সহজেই সেবার হাত প্রসারিত করে অসহায় মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে কর্মরত বেসরকারি সংস্থুগুলাের অসংখ্য আঞ্চলিক ও শাখা অফিস রয়েছে। প্রত্যেকটি শাখা শিক্ষা, চিকিৎসা ও খাদ্যসহ নান। রকম সেবা মানুষের দ্বারে পৌছে। দেয়। CDF-এর পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী বর্তমানে দেশে ৭২০টি এনজিও কর্মরত রয়েছে এবং এ যাবৎ উপকার ভােগীর সংখ্যা হলো ১.৪৬ কোটি লােক। তন্মধ্যে মহিলা ১.২১ কোটি এবং পুরুষ ০.২৫ কোটি। ২০০৪ সালে এনজিওদের মােট ক্ষুদ্র ঋণের ৪১.৭৯ শতাংশ বিনিয়ােগ হয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়। এর মধ্যে ১২.৩১% কৃষিতে, ১৭.৬৪% পশু সম্পদে, ৭.৩৯% মৎস্য খাতে প্রধান ৯টি এনজিও মােট ঋণের বৃহৎ অংশ বিতরণ করে। ঋণ বিতরণকারী সংস্থুগুলো হলো ব্রাক; আশা, প্রশিকা, কারিতাস, স্বনির্ভর বাংলাদেশ, TMSS, RDRS. BEURD এবং শক্তি ফাউন্ডেশন। এসব সংস্থায় কর্মরত রয়েছে বাংলাদেশের প্রায় ৫৫ হাজার নারী-পুরুষ। সুতরাং দেশের বেকারত্ব ঘুচাতেও এনজিওগুলাের কার্যকর ভূমিকা রয়েছে। এক কথায়, আমাদের আর্থ- সামাজিক প্রেক্ষাপটে এনজিওগুলাে বৃহত্তর দরিদ্র জনগােষ্ঠীর কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
সরকারি সংস্থার সম্পূরক হিসেবে এনজিও : বাংলাদেশে বিরাজমান অসংখ্য সামাজিক সমস্যার মােকাবেলা করা সীমিত সম্পদ দ্বারা সরকারের একার পক্ষে দুষ্কর। স্থানীয় সম্পদের সদ্ব্যবহার এবং সমস্যাগুলো স্থানীয় পর্যায়ে মােকাবেলার প্রয়ােজনে এনজিওগুলাে সরকারি সংস্থার সম্পূরক হিসেবে কাজ করে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পদ বিভাগের মাধ্যমে এসব সংস্থা বিদেশ থেকে মােটা অঙ্কের অর্থ সাহায্য পেয়ে থাকে। এসব সাহায্য সরকারিভাবে প্রাপ্ত সাহায্যের বিকল্প নয়, সম্পূরক হিসেবে এনজিওগুলােকে দেওয়া হয়।
এনজিও-দের ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম : ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে দেশের দারিদ্র বিমােচন, বেকারত্ব লাঘব, নারীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যেসব ক্ষেত্রে এনজিওগুলাে ঋণ প্রদান করে থাকে তা হলাে- ছাগল পালন, মৎস্যচাষ, পােলট্রি, সেলাই, কুটির শিল্প, বৃক্ষরােপণ, ছাড়াও অন্যান্য আত্মনির্ভরশীল যেকোনাে কাজে। এনজিও-র ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প থেকে ঋণ গ্রহণ করে অনেকে স্বাবলম্বিতা অর্জন করেছে।
এনজিও-এর কার্যক্রমের কুফল : আমাদের দেশের কেন্দ্র থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সর্বত্র এনজিও-এর এক বিরাট নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। এ নেটওয়ার্ক দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। বাণিজ্য করতে আসা ব্রিটিশ বেনিয়া গােষ্ঠীর মতো সাম্রাজ্যবাদী মনােভাব কিছু কিছু এনজিও-এর কার্যকলাপে ইতােমধ্যেই লক্ষ করা গেছে। গ্রামীণ উন্নয়নের নামে এসব এনজিও বাংলাদেশের রাজনীতিতে কালাে থাবা বিস্তার করছে- এটা দেশের জন্য মােটেই কল্যাণকর নয়। এছাড়া ধ্যান-ধারণার অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে এবং প্রভৃত্ব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে বলেও অভিযােগ উঠেছে। অনেক এনজিও জনসেবার নামে মানুষকে ধর্মান্তরিত করছে এবং ইসলামী কৃষ্টি-কালচার ও মূল্যবােধকে ধ্বংস করছে বলেও অভিযােগ রয়েছে। অধিকাংশ এনজিও-র সুদের হার মাত্রাতিরিক্ত এবং তাদের সমাজকল্যাণমূলক ভূমিকার চেয়ে বাণিজ্যক মনােবৃত্তিই প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে।
উপসংহার : বাংলাদেশে কর্মরত দেশি-বিদেশি এনজিওগুলাের মূল উদ্দেশ্য বা ভিতরগত কূট উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক না কেন, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এগুলাের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এদের সেবামূলক কার্যকলাপ নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু সেবার নামে অন্য কোনাে উদ্দেশ্য সাধন করতে চাইলে তা হবে ঘৃণার বিষয়। অপরের সাহায্য ও সহযাগিতা অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে পরনির্ভরশীল করে তােলে- এ কথাটি আমাদেরকে বিশেষভাবে স্মরণ রাখতে হবে। ভিক্ষার হাতকে পরিণত করতে হবে কর্মীর হাতে। তবেই হবে দেশ ও জাতির প্রকৃত উন্নতি।
Post a Comment