বা দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান
ভূমিকা: বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানীদের নানা আবিষ্কারের সূত্র ধরে জন্ম নিয়েছে আধুনিক যুগ। মানুষ তার যুগযুগান্তরের স্বপ্ন ও সাধনার অনবদ্য ফসল দিয়ে সভ্যতার এ বিশাল ইমারত গড়ে তুলেছে। তিল তিল পাণশক্তি এবং বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে মানুষ রচনা করেছে সভ্যতার এ তিলােত্তমা-মূর্তি। যে সভ্যতার বেদীমূলে রয়েছে বাহুর শক্তি, মস্তিষ্কের বুদ্ধি, ইন্দ্রয়ের অনুভূতি এবং হৃদয়ের ভালােবাসা। বিজ্ঞান মানুষের অন্তু সাধনার ফসল।বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, সভ্যতার পদক্ষেপকে করেছে দুরততর। পৃথিবীকে করেছে ছোট। মানুষকে দিয়েছে অনিঃশেষ শক্তির অপরিমেয় অহমিকা।
বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার: প্রাচীন যুগের সেই অসহায় মানুষ আজ অসীম শক্তিধর। হিংস পশুর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্যে পাথর আর গাছের ডাল ব্যবহার করতে করতে একসময় বল্লম, তীর, ধনুক, ঢাল, তলােয়ারের ব্যবহার করতে শিখেছে তারা। আধুনিক বিজ্ঞান সময় ও দূরত্বকে জয়। করেছে। জেমস ওয়াট স্টিম ইঞ্জিন ও জর্জ স্টিভেনসন রেলগাড়ি আবিষ্কার করেছেন। বিজ্ঞানের বলে মানুষ জল, স্থল ও অন্তরীক্ষ জয় করেছে। বিজ্ঞান মানুষের সংকট নিবারণের ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের বহু অভাবনীয় কৌশল আবিষ্কার করেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতিতে আজ অধিকাংশ দুরারােগ্য ব্যাধি হয়েছে চিকিৎসাযােগ্য।
বিজ্ঞানের জয়যাত্রা: বিজ্ঞানের ঐন্দ্রজালিক শক্তিবলে মানুষ উদ্দাম, উচ্ছল নদীর স্রোতকে বশীভূত করে উষর মরু-প্রান্তরকে করেছে জলসিত্ত, ভূগভের সতি শস্য সম্ভাবনাকে করে তুলেছে উজ্জ্বল। পাষাণী ধরিত্রীর সর্বদেহে সঞ্চারিত করে দিয়েছে অপূর্ব প্রাণ-স্পন্দন। বিজ্ঞান আজ উর্বরতা দিয়ে ক্ষয়িষ্ণু বসুধাকে শস্যবরতী করে তুলেছে, শিল্পশৈলীর নব নব প্রবর্তনে উৎপাদন-জগতে এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। প্রাগৈতিহাসিক মানবের অগ্নি-প্রজবলন কৌশল আয়ত্ত করার দিন থেকে আধুনিক পাথফাইন্ডার মহাকাশযানের যুগ পর্যন্ত মানুষের অতন্দ্র সাধনা বিজ্ঞানকে করেছে সমৃদ্ধ, সভ্যতাকে করেছে। জঙ্গম। বাষ্পীয় শক্তিকে করেছে বিজ্ঞান আজ বশীভূত, আকাশের বিদ্যুৎকে করেছে করায়ত্ত; মুঠিতে পুরে নিয়েছে আণবিক, পারমাণবিক শক্তিকে।
দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান: বিজ্ঞান আমাদের জীবনকে বিস্তৃতি দিয়েছে। সুদূরকে করেছে নিকট। ঘুচিয়ে দিয়েছে স্থানিক এবং মানসিক সংকীর্ণতা। প্রতিদিন প্রভাত কলরবের সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্র আমাদের ঘরে পৌছে দেয় বিশ্বের অসংখ্য সংবাদ কণিকা। বেতারে ধ্বনিত হয় বিশ্ববার্তা। দূরদর্শনের পর্দায় ভেসে ওঠে পৃথিবীর দূরদূরান্তের ছবি, নিখিল মানুষের চলমান স্রোত। ঘুম থেকে উঠে রাতে শুতে যাওয়া পর্যন্ত বিজ্ঞান শক্তির অকৃপণ দাক্ষিণ্য লাভ করতে করতে চলেছি আমরা। আমাদের দিনযাপনের প্রতিটি মুহূর্তকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে বিজ্ঞান। অভ্যস্ত জীবনধারায় কোনাে ছন্দপতন ঘটলেই আমরা উপলব্ধি করি, প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞানের ভূমিকা কতখানি ব্যাপক ও গভীর। হঠাৎ যখন বিদ্যুতের অভাবে আলােকোজ্জ্বল রাত্রি গভীর অন্ধকারে ডুবে যায়, তখনই বুঝতে পারি বিজ্ঞান আমাদের কতটা দিয়েছে। পরিধেয় বস্ত্র থেকে ঘরবাড়ি, পথঘাট, ওষুধপত্র, কৃষিজ, খনিজ, ভােগ্যপণ্য সবই তাে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার ফসল। বস্তুত আমাদের বর্তমান জীবনটাই বিজ্ঞান-নিয়ন্ত্রিত।
চিকিৎসা জগতে বিজ্ঞান: চিকিৎসা জগতে বিজ্ঞান আজ যুগান্তর এনেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ফলে দূরারােগ্য ব্যাধিতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। স্ট্রেপটোমাইসিন, পেনিসিলিন, এক্সরে প্রভৃতি মৃত্যুপথযাত্রীকে দান করেছে নিশ্চিত বিশ্বাস ও আশা। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ফলে মানবদেহের অভ্যন্তরস্থ ফুসফুস, পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, বৃক্ক, ধমনী, শিরা ইত্যাদির নির্ভুলভাবে রােগ নির্ণয় করা যায়। অতিকম্পনশীল প্রযুক্তি চিকিৎসাবিজ্ঞানকে নিয়ে এসেছে সর্বাধুনিক পর্যায়ে।
শিল্পক্ষেত্রে বিজ্ঞান: শিল্পকারখানায় মানুষের হাতের কাজকে বিজ্ঞান অনেকাংশে কমিয়ে দিয়েছে। ইতিপূর্বে শিল্পকারখানায় সমস্ত কাজই হাতে করা হতাে। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ফলে এখন সময় কম ব্যয় হচ্ছে, খরচ কম পড়ছে এবং উৎপাদন হচ্ছে অধিক।
কৃষিক্ষেত্রে: বিজ্ঞানের ছোঁয়া কৃষিক্ষেত্রেও বিস্ময়কর প্রভাব বিস্তার করেছে। প্রাচীন ভোতা লাঙলের পরিবর্তে আজ ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নতমানের কলের লাঙল ও ট্রাক্টর। পচা আবর্জনা ও গােবরের সঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক রাসায়নিক সার। গবেষণার মাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে উন্নতমানের বীজ। সুতরাং বলা যায়, কৃষিক্ষেত্রেও বিজ্ঞান মহাবিপ্লব এনেছে।
জ্ঞানচর্চার সুযােগ সৃষ্টি: মুদ্রণযন্ত্র ও কম্পিউটারের আবিষ্কার মানুষের জ্ঞানচর্চাকে করেছে সহজতর। মানুষের চিন্তাচেতনা খুব সহজে মুদ্রণযন্ত্রের সাহায্যে সংরক্ষণ করা হচ্ছে, ফটোস্ট্যাস্ট মেশিনের সাহায্যে অতি অল্প সময়ে শত শত পাতার ফটোকপি করা সম্ভব হচ্ছে। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আনন্দদানের পাশাপাশি শিক্ষাদানও চলছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও জাতীয় চেতনাকে উজ্জীবিত করার জন্যে চলচ্চিত্র, সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন আজ বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। শিক্ষাব্যবস্থাসহ সকল ক্ষেত্রে যুগান্তরকারী পরিবর্তন এনেছে কম্পিউটার।
বিজ্ঞানের সর্বধ্বংসী অকল্যাণমূর্তি: যে বিজ্ঞান সভ্যতার শরীরে জীবন প্রতিষ্ঠা করেছে, আজ তার বিনাশেও সে মেতে উঠেছে। বিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত দুটি মহাযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা বিজ্ঞানের দানবীয় শক্তি সম্বন্ধে মানুষের মনে এনেছে এক ঘােরতর আতজ্ক। পারমাণবিক বােমা, হাইড্রোজেন বােমা, ডিনামাইট, বােমার বিমান, ট্যাঙ্ক, সাবমেরিন ইত্যাদি আবিষ্কারের ফলে মানবজীবনে বিজ্ঞান অভিশাপে পরিণত হয়েছে। বর্তমানকালে বিজ্ঞান কী চায়? জীবন না মৃত্যু? আজ পৃথিবীর মানুষের মনে জেগেছে এ অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু বিজ্ঞানের এ বিধ্বংসীরূপের জন্যে বিজ্ঞান দায়ী নয়। বরং যারা একে নিজেদের সার্থে ব্যবহার করছে তারাই দায়ী।
উপসংহার: অসীম সম্ভাবনাময় বিজ্ঞান বিশ্বের মুষ্টিমেয় স্বার্থপর নরঘাতকদের জন্যে আজ সমাজের সার্বিক দুঃখ ও আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞান যদি সর্বধ্বংসী মারণাস্ত্র নির্মাণ থেকে বিরত হয়ে কেবল মানবকল্যাণে ব্যবহৃত হয়, তবেই মানুষের দুঃখ রজনীর অবসান হবে। হিংস্রতার রক্ত বিপ্লবের হাত থেকে রক্ষা পাবে ধরিত্রী।
2 comments