জানার আগ্রহ ও দেশভ্রমণ: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কত অফুরন্ত ভান্ডার নিয়ে কত ভূখণ্ড অধীর আগ্রহে আমাদের আগমনের প্রতীক্ষা করছে। হৃদয়ের ভূগােলের ক্ষুধা, অন্তরের অতৃপ্তি, গৃহ-প্রাচীরের বন্দনী থেকে মুক্ত করে সুদূরের অনন্ত আহ্বানে মহাবিশ্বের মুক্তপ্রাজ্গণে টেনে নিয়ে চলে। ইতিহাস প্রত্যক্ষ ও অবধারিত সান্নিধ্যে দাঁড়িয়ে আমরা অতীত ও বর্তমানের স্মৃতি গায়ে মেখে ধন্য হই। আমরা ইতিহাসের পাতাতে দেখতে পাই জ্ঞানার্জনের জন্যে সুদূর চীন, মিসর, মরক্কো, গ্রিস, স্পেন, পর্তুগাল, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ ছুটে এসেছিল ভারতীয় উপমহাদেশে। কিছু মানুষের দেশভ্রমণের বাসনা আছে বলেই মানুষ নতুনকে জানার জন্যে দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে বেড়ায়।
শিক্ষার মাধ্যম দেশভ্রমণ: জ্ঞানলাভে পরিপূর্ণতা আনতে হলে দেশভ্রমণের প্রয়ােজনীয়তা অপরিসীম। কেবল বই পাঠ দ্বারা জ্ঞানলাভ পূর্ণতা পায় না। এর জন্যে চাই দেশভ্রমণ। ঐতিহাসিক ও ভৌগােলিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ ভ্রমণ করলে অর্জিত শিক্ষা সমৃদ্ধি লাভ করে। পৃথিবীর বহু মানুষের কলরব মুখরিত সজীব-সুন্দর বিচিত্র বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষা করছে শ্যামল-শােভন-প্রাণােচ্ছল হাজারাে ভূখণ্ড। বাইরে অবাধ উন্মুক্ত আকাশের নিচে জীবন্ত দেশটি দেখে, তার অধিবাসীদের প্রত্যক্ষ স্পর্শ লাভ করে, তাদের জীবনধারা জানার এবং উপলব্ধি করার মধ্যেই প্রকৃত জ্ঞানার্জন নিহিত। দেশভ্রমণের মাধ্যমে মানুষ কোনাে বস্তু, জাতি, স্থান বা ঘটনার প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসে পূর্ণ জ্ঞানলাভ করতে পারে। তাই বলা যায়, দেশভ্রমণ শিক্ষাকে পূর্ণতা দেয়। দেশভ্রমণ করে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শিক্ষা-দীক্ষা সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞানলাভ করা যায়। দেশভ্রমণের ফলে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে বিপুল অভিজ্ঞতা বাড়ে, মানুষের মন অনেক উদার হয় এবং স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতি বিশ্বাস ও আগ্রহ বাড়ে। ও অতএব বলা যায়, দেশভ্রমণ মানুষের শিক্ষার ও জ্ঞানার্জনের একটি উৎকৃষ্ট পন্থা।
দেশভ্রমণের প্রয়ােজনীয়তা: মানুষ দিনের পর দিন চার দেয়ালের স্বরচিত কারাগারে আবদ্ধ থেকে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। একমাত্র দেশভ্রমণের মাধ্যমে সে আবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং অন্তরের মধ্যে অঙ্কুরিত ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতার বীজ সমূলে উচ্ছেদ করা যায়। দেশভ্রমণের দ্বারা সীমাহীন সৌন্দর্যের মধ্যে বহু মানুষের স্পর্শ লাভ করে, সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে গৃহে ফেরা যায়। বিশ্ববিখ্যাত পরিব্রাজক ফা হিয়েন, হিউয়েন সাঙ, ইবনে বতুতা প্রমুখ পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন। তারা বিভিন্ন দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতির দ্বারা নিজেদের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছেন।
দেশভ্রমণের উদ্দেশ্য: বিভিন্ন ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষ দেশভ্রমণ করে থাকে। কেউ জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে, কেউ ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে, দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক উন্নতির উদ্দেশ্যে দেশভ্রমণ করে। আধুনিককালে মানুষ সাধারণত ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে দেশভ্রমণ করে থাকে। এখন ঐতিহাসিক কারণে বিভিন্ন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক স্বার্থ পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এজন্যে সেসব দেশের মধ্যে আর্থিক ও বাণিজ্যিক লেনদেনের জন্যে দেশভ্রমণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি থেকে জ্ঞানার্জনের জন্যে এবং বিভিন্ন দেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য ও ঐতিহাসিক স্থানসমূহ দেখার জন্যে মানুষ দেশভ্রমণ করে থাকে।
দেশভ্রমণ ব্যবস্থার উন্নতি: অতীতকালে দেশভ্রমণ ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আজ নানা পথ ও পরিবহণ-ব্যবস্থার ফলে দেশভ্রমণ সহজ হয়েছে। স্থলপথ, জলপথ ও বিমানপথ বিস্তৃত হয়েছে এবং পরিবহণ-ব্যবস্থা হয়েছে সহজলভ্য। এ ছাড়াও বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ বিষয়ে দেশে দেশে, এখন Tourist Bureau' স্থাপিত হয়েছে। এ ব্যুরাে ভ্রমণের ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযােগিতা করে থাকে। এ ছাড়া পর্যটন এখন বিরাট শিল্পে পরিণত হয়েছে এবং পৃথিবীর অনেক দেশ পর্যটনের মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।
পারস্পরিক সহমর্মিতা: দেশভ্রমণ শিক্ষার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। দেশ-দেশান্তরের ভৌগােলিক পরিস্থিতি, প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সেখানকার মানুষের জীবনাচরণের প্রত্যক্ষ জ্ঞানলাভ দেশভ্রমণের মাধ্যমে সম্ভব হয়। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত জ্ঞানলাভও দেশভ্রমণের পরােক্ষ ফল। অন্যদিকে ভ্রমণের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যে ভাবমূলক সংহতি গড়ে ওঠে, তা জাতীয় সংহতির পক্ষে, মানবিক সৌহার্দ্যবােধের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দিনে দিনে সারা পৃথিবীতেই দেশভ্রমণ জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। জাতিসংঘও দেশভ্রমণকে 'বিশ্ব শান্তির ছাড়পত্র' হিসেবে অভিহিত করে বিশ্ববাসীকে দেশভ্রমণে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাই আজ পৃথিবীতে লক্ষ-কোটি ভ্রমণবিলাসী মানুষ ঘর ছেড়ে বের হয়ে পড়েছে।
দেশভ্রমণের অপকারিতা: দেশভ্রমণের অনেক সুফল রয়েছে তবে অত্যধিক ভ্রমণ বা উদ্দেশ্যবিহীন ভ্রমণ বর্জনীয়। অতিরিক্ত ভ্রমণ স্বাস্থ্যহানি ঘটায়। কোনাে একটি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে দেশভ্রমণ করা উচিত, তবে শুধু ভ্রমণের উদ্দেশ্যেই ভ্রমণ করা উচিত নয়। ভ্রমণলব্ধ জ্ঞান যদি কাজে লাগানাে না যায় তবে সে ভ্রমণের কোনাে মানে হয় না, তা শুধু আর্থিক ক্ষতিসাধন করে স্বাস্থ্যহানি ঘটায়। প্রলােভন থেকে যে ব্যক্তির আত্মরক্ষার ক্ষমতা নেই তার ভ্রমণ করা উচিত নয়।
উপসংহার: দেশভ্রমণের মাধ্যমে শিক্ষালাভ সম্পূর্ণ হয়, জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পায়, মনের সংকীর্ণতা দূর হয়, চিন্তাশীল হওয়া যায় এবং সর্বোপরি পঙ্কিলতা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। দেশভ্রমণ মানুষকে বিরাট পৃথিবীর অন্তহীন বৈচিত্র্য ও রহস্যের মধ্যে অবগাহন করার সুযােগ করে দেয়। তবে আর্থিক দৈন্যের কারণে ভ্রমণের ইচ্ছা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে সে আশা দুরাশার গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। খােদার সৃষ্টিরহস্য স্বচক্ষে দেখে নিজেকে ধন্য করা, জীবনে বৈচিত্র্য আনয়ন, অভিজ্ঞতা অর্জন ও সৌন্দর্যপিপাসা নিবৃত্ত করার জন্যে আমাদের সকলেরই কম-বেশি দেশভ্রমণ করা উচিত।
Post a Comment