SkyIsTheLimit
Bookmark

পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার রচনা

দূষণমুক্ত পৃথিবী
বা শব্দ দূষণ ও বায়ু দূষণ
বা পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশ

সূচনা : বিশ্বের সমস্ত জনগণকে যে বিষয়টি আজ সবচেয়ে বেশি ভাবিয়ে তুলেছে তা হল পরিবেশ দূষণ। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়েই আমাদের পরিবেশ। নদনদী, বায়ু, পানি, চন্দ্র, সূর্য, আবহাওয়া, জলবায়ু ইত্যাদির সবকিছুই আমাদের এ পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত। পরিবেশই আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। জীবনের জন্য প্রয়ােজনীয় সব কিছুর যােগান পাই আমরা পরিবেশ থেকে। কিন্তু এ পরিবেশ যখন দূষিত হয় তখন সমস্ত জনগণের দুশ্চিন্তার কথা। ক্রমবর্ধমান এ পরিবেশ দূষণ পৃথিবীকে ক্রমে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের পরিবেশ আজ দূষিত, আর পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে আমাদেরই উপরে।

পরিবেশ দূষণ : পরিবেশ দূষণ নতুন কিছু নয়। সেই আদিকাল থেকেই পরিবেশ মানুষ দ্বারা দৃষিত হয়ে আসছে। তবে এ দূষণ সমস্যা তীব্র সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্প বিপ্লবের সূচনা থেকে। উনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে এসে দেখা গেল পরিবেশ দূষণ কেবল সমস্যাই নয় এটি মারাত্মক আকার ধারণ করে পর্যায়ক্রমে মারাত্মক রূপ নিচ্ছে। ফলে মানবসভ্যতার অন্তরায় হিসেবে পৃথিবী আজ বিপন্ন। আরাে সহজ করে বলতে গেলে বলতে হয় আদিকালে মানুষের সংখ্যা যেমনি অনেক কম ছিল তেমনি কম ছিল তাদের দ্বারা নির্গত বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ। এছাড়াও তখনকার মানুষের নিত্য বর্জ্য পদার্থ হয়তােবা অন্য প্রাণীর খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হত নয়ত তা পরিবেশের অণুজীবদের দ্বারা বিনষ্ট হয়ে অণু ও পরমাণুতে রূপান্তরিত হয়ে আবার পরিবেশে মিশে যেত। কিন্তু বর্তমানে তার উল্টো। মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে আর তৈরি হচ্ছে এমন সব কৃত্রিম পদার্থ যা পরিবেশে বিনষ্ট হয় না, এমনকি এত বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য পরিবেশে ঢুকছে যা পরিবেশের শােষণ প্রক্রিয়াকে ক্রমশ ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ সমস্যা সমস্যা হিসেবেই পরিবেশে থেকে যাচ্ছে, উপরন্তু তৈরি করছে নতুন জটিল সমস্যা। এভাবেই পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে মানুষের বাস অনুপযােগী হয়ে পড়ছে।

পরিবেশ দূষণের কারণ : পরিবেশ দূষণ আজ কোন একক কারণে হচ্ছে না। বিভিন্ন কারণে পরিবেশের বিভিন্ন অংশ দূষিত পরিবেশ হচ্ছে। পরিবেশ দূষণের জন্য যে বিশেষ কারণগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে দায়ী সেগুলাে হল:

১. পৃথিবীর লােকসংখ্যা বর্তমান ৫০০ কোটির উর্ধ্বে। এ অধিক জনসংখ্যা আবার সৃষ্টি করছে অধিক নতুন মুখ। এভাবেই লােকসংখ্যা বেড়ে চলেছে ক্রমশ। অতিরিক্ত এ জনগােষ্ঠীর বর্জ্য পদার্থের পরিমাণও বেশি যা পরিবেশ দূষণে বিশেষভাবে দায়ী।

২. জনসংখ্যা বাড়ছে; কিন্তু জায়গা বাড়ছে না। ফলে তাদের বাসস্থানের জন্য বনভূমি উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এভাবে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে যা দূষিত করছে পরিবেশকে। অধিকন্তু বনভূমি শুধু উজাড়ই হচ্ছে না নতুন করে বনায়নের জন্য কোন যথাযথ ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে না।

৩. বৃক্ষ বাতাস হতে দূষিত গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং আমাদের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য অক্সিজেন ত্যাগ করে। কিন্তু বৃক্ষ নিধন হওয়ার ফলে বাতাসে ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে আর দিন দিন কমছে অক্সিজেন এর পরিমাণ। এর ফলে দূষিত হচ্ছে বায়ু।

৪. শিল্প বিপ্লবের ফলে কল-কারখানা আবিষ্কৃত হয়েছে। দিন দিন ক্রমবর্ধমান মানুষের চাহিদার সঙ্গে খাপ খাওয়ানাের জন্য উৎপাদন ব্যবস্থা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কল-কারখানা। এসব কলকারখানা থেকে নির্গত ধোয়া দূষিত করছে বায়ু। কল-কারখানা থেকে পরিত্যক্ত বর্জ্য পদার্থ ফেলা হচ্ছে নদীত যা দৃষিত করছে পানি। সম্প্রতি জানা গেছে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে বিধায় ছােট মাছগুলাে মারা যাচ্ছে। ঢাকা শহরের কল-কারখানাগুলাে থেকে নির্গত বর্জ্য পদার্থই হল এ সমস্যার প্রধান কারণ।

৫. কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক উপকরণ যেমন কীটনাশক ঔষুধ, রাসায়নিক সার প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়। এগুলাে পরিবেশের যথেষ্ট ক্ষতি সাধন করছে।

পরিবেশ দূষণের বিভিন্ন দিক : পরিবেশ দূষণ আজ এক ক্রমবর্ধমান জটিল সমস্যা। আমাদের পরিবেশের সামগ্রিক দিক বর্তমানে দূষিত। নিম্নে পরিবেশ দূষণের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হল ঃ

১. বায়ু দূষণ : বর্তমানে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে হচ্ছে বায়ু দূষণ। ঝুল জাতীয় কার্বন কণা থেকে আরম্ভ করে ভারি ধাতু, জটিল জৈবযােগে নিউক্লিয় আবর্জনা, জীবাশ্ম জ্বালানি, অর্থাৎ তেল, কয়লা প্রভৃতি পুড়িয়ে সৃষ্ট কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে দেয়া, নাইট্রাস অক্সাইড, রাসায়নিক ধোয়া এসব বায়ু দূষণের প্রধান উপকরণ। প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া বাতাস দূষিত করে কারণ এসব গাড়ির ইঞ্জিন পেট্রোল এবং ডিজেল দ্বারা চালিত হয়। বিভিন্ন কল-কারখানা দূষণের হাত থেকে নিস্তারের কোন উপায় নেই। বায়ু দূষণের ফলে এখানে বিভিন্ন রােগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাথাধরা, শ্বাসকষ্ট হাঁপানী, ব্রংকাইটিস, ফুসফুস ক্যান্সার প্রভৃতি এ জাতীয় রােগ বায়ু দূষণের ফল।

২. পানি দূষণ : পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া কোন জীব বাঁচতে পারে না। অথচ এ বিশুদ্ধ পানি কিছে না। দিন দিন পানি দূষিত হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর যাবতীয় জলাশয় বিশেষ করে নদনদী, পুকুর, খাল বিল এগুলাের পানি দূষিত হচ্ছে। কল-কারখানার তরল বর্জ্য পদার্থ নদনদীর পানিতে পরিত্যক্ত হচ্ছে। নদী তীরে গড়ে উঠছে সমৃদ্ধ জনপদ শহর। চটকল, কাপড় কল, চিনি কল, কাগজের কল, এ সব থেকে সব বর্জ্য পদার্থগুলাে নদীতে গিয়ে পড়ে। ফলে পানি প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনের পরিত্যক্ত আবর্জনা পানিতে ফেলে পানি নষ্ট করে। কৃষকরা পােকামাকড় ধ্বংস করার জন্য রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে। এগুলাে নদী, খাল ও পুকুরের পানির সঙ্গে মিশে যায় এবং একে দূষিত করে। নৌকা, লঞ্চ, স্টীমার, জাহাজ প্রভৃতি থেকে পরিত্যক্ত খাদ্যদ্রব্য, মলমূত্র পানিতে ফেলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে নদীর তীরের লােকজন নদীতে পায়খানা তৈরি করে। এসব কিছুই পানি দূষিত করে। পানি দূষণের ফলে আমাশয়, কলেরা, ডায়েরিয়া প্রভৃতি রােগের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় পানি দূষণের ফলে নদীনালা, খালবিল প্রভৃতি জলাশয়ের মাছও মারা যায় ।

৩. শব্দ দূষণ : পরিবেশ দূষণের একটি বিশেষ দিক হল শব্দ দূষণ। শব্দ দূষণ এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বিভিন্ন কারণে শব্দ দূষণ হচ্ছে। যানবাহনের বিকট শব্দ, কল-কারখানার যান্ত্রিক আওয়াজ, মাইকের চিৎকার, উৎসবে বাজি ফাটানাের শব্দ, সন্ত্রাসীর বােমার আওয়াজ, টেলিভিশন, রেডিও টুইন ওয়ানের শব্দ, মিছিলের শ্লোগান, পারস্পরিক ঝগড়াবিবাদ প্রভৃতি সব মিলে সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শব্দ দূষণের পরিণাম খুব ভয়াবহ। মানসিক বিপর্যয়, রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন, স্নায়ুর অস্থিরতা ইত্যাদি শব্দ দূষণের ফলে দেখা দেয়। শব্দ দূষণের ফলে ছােট ছােট ছেলেমেয়েরা পড়াশুনায় মনােযােগ দিতে পারে না। অনেক সময় রােগীরা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

৪. তেজস্ক্রিয় দূষণ : আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্রের আবিষ্কার। পারমাণবিক যুদ্ধ এবং পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে তেজস্ক্রিয় দূষণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। ১৯৬৩ সালে একটি মার্কিন নিউক্লিও সাবমেরিন আটলান্টিক সাগরে চিরকালের মত নিমজ্জিত হয় এবং তা থেকে প্রচুর পরিমাণে তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্রাকৃতিক পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া এসব যুদ্ধে অগণিত মানুষের জীবন সংহার হয়েছে, প্রকৃতির অপরূপ সুষমা বিধ্বস্ত হয়েছে। ইরাক, ইরান, ইরাক, কুয়েত, ভারত, পাকিস্তান, আরব, ইসরাইল, যুগােশ্লাভিয়ার যুদ্ধসমূহও বাতাস ভারী করে ছড়িয়েছে তেজস্ক্রিয়। ১৯৩২ সালে ব্রিটেনের নিকেল কারখানায়, ১৯৩৭ সালে ওয়েলস নিকেল কারখানায় কর্মীদের দেহে ক্যান্সার দেখা দেয়। ১৯৫৪ সালে জাপানের হিরােসিমা এবং নাগাশাকিতে পারমাণবিক বােমা বিস্ফোরণের ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়, অনেকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়। ১৯৫৩ সালে ও ১৯৬৫ সালে জাপানে সিনামাটি ও নিগাটা উপসাগরে মাছের মাধ্যমে স্নায়ুবিক রােগের উৎপত্তি ও মৃত্যু ঘটে। ১৯৫২ সালে লন্ডনের বহুসংখ্যক লােক ধোয়াজাত রােগে আক্রান্ত হয়।

৫. খাদ্য দূষণ : পরিবেশ দূষণের অন্যতম দিক হচ্ছে খাদ্য দূষণ। খাদ্য দুষণের ফলে আমাদের খাবারের মান খুব নিচু মানের। খাদ্য উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ওষুধ প্রয়ােগ, খাদ্যদ্রব্যে বিভিন্ন রকমের ভেজাল খাদ্য দূষণের অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে খাটি খাদ্যদ্রব্য পাওয়া খুব কষ্টকর। এখানে দুধের মধ্যে পানি মেশানাে হয়, চালের ভিতর কাকর, হলুদের গুড়ার মধ্যে ইটের গুড়া, সরিযার তেলের মধ্যে রাসায়নিক দ্রব্য, ঘিয়ের মধ্যে পামওয়েল, ময়দার মধ্যে আটা, বিভিন্ন রকম খাদ্য তৈরিতে রাসায়নিক দ্রব্য মিশানাে প্রভৃতি রকমের ভেজালের ফলে খাদ্য দূষণ এমন আকার ধারণ করেছে এসব খাদ্য খেয়ে আমাদের জীবনধারণই হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।

পরিবেশ দূষণের প্রতিকার : পরিবেশ দূষণে গােটা বিশ্ব আজ আতজ্কগ্রস্ত। এ ভয়ঙ্কর সমস্যার মােকাবেলার জন্য সবাই চিন্তাভাবনা করছে। বায়ু দূষণের প্রতিকার করা হচ্ছে। বৃক্ষরােপণ, ক্ষতিকারক পতঙ্গের জীবনচক্র নিরােধ, রাসায়নিক পদার্থের শােধন, ধোঁয়ার প্রতিশ্রতিকরণ, বসতি ও শিল্পাঞ্চলের মধ্যে দূরত্ব তৈরির মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ রােধ করা অনেকটা সম্ভব। শব্দের নিয়ন্ত্রণ এবং মানব চেতনার উদ্বোধন দূষণ প্রতিরােধের জন্য একান্ত কাম্য। তবে পরিবেশ দূষণ রােধে সবচেয়ে প্রয়ােজন ৩টি বিষয়ের। আর তা হল ঃ ১. পরিবেশের ভারসাম্য ও পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জনগণের নিকট পৌছে দেওয়া। ২. পরিবেশ সংরক্ষণ এবং পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়ােগ করা। ৩. পরিবেশ দূষণ রােধকল্পে সকলের ঐকান্তিক সদিচ্ছা থাকতে হবে।

উপসংহার : বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ দূষণের বিরাজমান রূপ মানব সভ্যতার এক ভয়ঙ্কর বিপদ। আমাদের সবাইকে মিলে পৃথিবী নামক গ্রহটিকে প্রাণিজগতের জন্য নিরাপদ এবং উপযােগী করে তােলাই হবে প্রথম দায়িত্ব ও কর্তব্য। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তুলতে আমরা সম্মিলিতভাবে প্রয়াস চালাতে পারি। সমগ্র বিশ্বের জনগণ আজ তাই পরিবেশ দূষণের হাত থেকে বিশ্বকে বাঁচানাের জন্য-একযােগে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের সকলেরই লক্ষ্য দূষণমুক্ত সুন্দর পরিবেশ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment