বা সভ্যতার বিকাশে বিদ্যুৎ
আধুনিক জীবনে বিদ্যুতের ব্যবহার
ভূমিকা : মানবসভ্যতার বিকাশে বিজ্ঞানের অবদানের কথা বলে শেষ করা যায় না। এ বিজ্ঞানই মানুষের প্রয়ােজনের কথা ভেবে আবিষ্কার করল বিদ্যুৎ বা ইলেকট্রিসিটি (Electircity) । একদিন মানুষ ছিল অরণ্যচারী, বনের পশুর সাথে সংগ্রাম করে তাকে বাঁচতে হত। জীবিকার সন্ধান করতে হত শারীরিক শক্তি এবং বৃদ্ধিবৃত্তি প্রয়ােগ করে। সেই মানুষ আজ আধুনিক জীবনের অধিকারী। আজ কেবল বাঁচার জন্যে নয়, বিশ্ব সভ্যতায় শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযােগিতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অভিলাষে তাকে নিত্য নতুন আবিষ্কারে নিয়ােজিত হতে হয়েছে। এরই ফলে আবিষ্কার করল বিদ্যুৎ শক্তি। এ বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ফলে মানুষের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বেড়েছে, সহজভাবে জীবন যাপনের লক্ষ্যে সে এতদিন অবধি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এসেছে, কিন্তু এখন তাে এ নিয়ে তার পরিতৃপ্ত হওয়া চলে না, মহাশূন্য আবিষ্কারের নেশায় মেতে উঠেছেন বৈজ্ঞানিকেরা; তা তারা করুন, কিন্তু বর্তমানে দুনিয়ার আধুনিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সভ্যসমাজ প্রযুক্তিগত দিক থেকে যেভাবে বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করেছে তা বিশ্বের প্রায় সব দেশ অনুসরণ করছে। ফলে এখন যে কোন একটি উন্নত বা উন্নয়নকামী দেশের শহুরে জীবনের সাথে গ্রামীণ জীবনের মানুষের মধ্যে দূরত্ব কমে এসেছে। বিজ্ঞান গবেষণার ফসল বিদ্যুৎ : মানবকল্যাণের উদ্দেশ্যে যে বিজ্ঞান একের পর আর এক আবিষ্কার করে চলেছে সেই কল্যাণের লক্ষ্যে একদিন মাইকেল ফ্যারাডে তড়িৎ প্রবাহ আবিষ্কার করলেন। তার এ বিস্ময়কর আবিষ্কারের ফলে মানুষ আজ তার জীবনকে শান্তির পথে অগ্রগামী করেছে। যেমন-বৈদ্যুতিক পাখা, বৈদ্যুতিক বাতি নাগরিকদের বাসগৃহ ৰা অফিস কক্ষকে আরামদায়ক করেছে, আলােকিত করেছে। আধুনিক জীবনকে দাবদাহের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে রয়েছে এয়ার কন্ডিশনার (Air Conditoner)। আসলে তড়িৎ প্রবাহের যে প্রয়ােগ কৌশল তা কার্যকর করেছিলেন টমাস এডিসন। সভ্যতার বিকাশ ও অগ্রগতি সাধনে ফ্যারাডে ও এডিশনের আবিষ্কার অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আধুনিক জীবনে বিদ্যুতের ব্যবহার : একসময় মানুষের জীবনে অভাব-অভিযাগের অন্ত ছিল না। তখন মানুষ লেখাপড়া কাকে বলে জানত না। জ্ঞানচর্চা সম্বন্ধে অজ্ঞ ছিল। সেই মানুষ জীবনে সুখের প্রয়ােজনে আগুন আবিষ্কার করল। জীবনের শান্তিশৃঙ্খলা ও সুখশান্তি বিধানের জন্য বিদ্যুৎ আবিষ্কার করল। টেলিফোন, টেলিগ্রাফের ব্যবহার হচ্ছে একদেশ থেকে অন্য দেশে খরবাখরব আদান-প্রদানের উদ্দেশ্যে, আধুনিক মানুষের কাছে রেডিও, টেলিভিশনের প্রয়ােজন হয়েছে। কারণ বাসভবনের চার দেয়ালের মধ্যে বাস করা সত্ত্বেও তারা দেশ বিদেশের সংবাদ জানতে চাইছে, দেশে বিদেশে সংঘটিত কর্মকাণ্ডের ছবি চোখের সামনে দেখতে চাইছে। এসব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের রহস্য তড়িৎ তরঙ্গের যে মহাশক্তি, সেই মহাশক্তিতে আশ্রয় গ্রহণের মধ্যে নিহিত। গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করে তারা দেখে নিচ্ছে বহির্বিশ্বকে। বহির্বিশ্বকে দর্শন করার ফলে বুদ্ধিবৃত্তির উৎকর্ষ ঘটছে। যােগাযােগ ব্যবস্থাকে সহজতম ও দ্রুততম করার লক্ষ্যে প্রগতিশীল দেশগুলাে রেলগাড়ি এবং অত্যাধুনিক কনকর্ড বিমান তৈরি করেছে। ইদানিংকালে রেলগাড়ি চলছে বিদ্যুতের সাহায্যে, মাটির তলায় টিউব রেল চালু করা হয়েছে অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতিতে যাতায়াত করার অভিলাষে। এরােপ্লেনে চড়ে শূন্যপথে মানুষ আজ অতি সহজে মুক্ত পাখির মত ঘণ্টায় শত শত মাইল পথ ভ্রমণ করতে পারছে, আগের যুগে বা স্বপ্নের ব্যাপার ছিল।
বিদ্যুতের গুরুত্ব : বর্তমান দুনিয়া যেমন প্রগতিশীল তেমনি আবার জটিলও। এ জটিলতার হাত থেকে অব্যাহতি লাভের আকাঙ ক্ষায় আমরা নাগরিক জীবনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছি। শহরে জীবনের কর্মকাণ্ডে তড়িতের ব্যবহার আমাদের । নিশ্চিতভাবে নিরাপত্তা বিধান করেছে। জটিল অসুখ-বিসুখ, রােগ-শােক ব্যাধির ক্ষেত্রে যদি অপারেশনের অবশ্যম্ভাবিতা জরুরি হয়ে পড়ে তবে সে ক্ষেত্রে অপারেশন থিয়েটারে [.ক] তে চাই বিদ্যুৎ। রঞ্জনরশ্মি ও আলট্রাসনােগ্রাফির সহায়তায় মানব দেহের অদৃশ্য বস্তুকে দৃশ্যমান করার জন্য তড়িৎ প্রবাহের প্রয়ােজন। অর্থাৎ মানুষের আধুনিক জীবনের বহুবিধ দুরারােগ্য ব্যাধিকে দমন করার জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞান বিদুৎশক্তির সাহায্য গ্রহণ করেছে। এ সাহায্য গ্রহণের বিকল্প আর কিছু নেই। আজ শহর বন্দরে রাতের অন্ধকার অপসৃত হচ্ছে, ট্রেন-ট্রামটিউব চলছে, পাখা ঘুরছে বৈদ্যুতিক শক্তি ভূত্যের মত খেটে চলেছে, কোন অভিযােগ নেই, কোন প্রতিবন্ধক নেই। যদি বিদ্যুৎ না থাকত তাহলে সুখশান্তি সমৃদ্ধি ব্যাহত হতাে তাকে ছাড়া একমুহূর্ত চলা দায়। যেদিকেই দৃষ্টি ফেরানাে যাক না কেন, কেবল বিদ্যুতের জয়, জয়কার। সভ্যতার বিকাশের জন্য মুদ্রণ যন্ত্রের যে আবিষ্কার তাকে কার্যকর করার লক্ষ্যে তড়িৎ-এর ব্যবহার অতি জরুরি। ইদানীং মুদ্রণশিল্পের সমৃদ্ধির প্রয়ােজনে কম্পিউটার ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে, এখানেও বিদ্যুতের চাহিদা যে কত জরুরি তা বলার অপেক্ষা নেই। কম্পিউটারের কম্পােজ, ফটো কম্পােজ, ফটোস্ট্যাট -এবং কম্পিউটার টাইপ এসব পুস্তক মুদ্রণ ও লেখাপড়ার কর্মকাণ্ডে নবযুগের সূচনা বিদ্যুৎ। ইদানিং ঘণ্টায় ঘণ্টায় যে হাজার হাজার বই মুদ্রিত হচ্ছে তা হলাে বিদ্যুতের অবদান। করেছে আমরা ঘরে বসে প্রভাতের প্রসন্ন প্রহরে সংবাদপত্র পাঠ করতে ভালােবাসি। খবরের কাগজের যে হকার প্রত্যহ খবরের কাগজ সরবরাহ করে এবং প্রতিদিন দেশ বিদেশের যেসব তরতাজা চাঞ্চল্যকর বা আনন্দদায়ক সংবাদ পাঠ করার দুর্লভ সুযােগ করে দেয় তারও পেছনে আছে বিদ্যুতের বিস্ময়কর খেলা। আমাদের আধুনিক জীবনে যেদিন সংবাদপত্র পাঠের সুযােগ পাওয়া যাবে না সেদিন মনে হবে যে দিনটাই মাটি হলাে, দিনটা বৃথায় গেল। আধুনিক জীবনে বিদ্যুতের নানামুখী ব্যবহারের কথা বলতে গেলে অতীতকে স্মরণ করতে হয়। এমন একদিন ছিল যখন নাগরিক জীবনের তাে কথাই নেই, গ্রামীণ জীবনেও স্বস্তি ছিল না, শান্তি ছিল না। কেরোসিন জ্বালিয়ে বা রেড়ির তেলে দীপ জ্বালিয়ে পড়াশােনা চলত, কিন্তু জাজ বৈদ্যুতিক বাতি (Electric bulb) ছাড়া লেখাপড়া দূরের কথা কোন কাজই করা সম্ভবপর হয় না। আধুনিক জীবন ব্যবস্থায় শহরের ধনাঢ্য ও অভিজাত পরিবারের ইলেকট্রিক টিউব বাল্ব দিয়ে ঘর সাজানাে এক সাধারণ অভিপ্রায়। আধুনিক আজ জীবনযাপনে বিদ্যুৎ ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই।
বিদ্যুতের ব্যবহার : বাংলাদেশের শহরে, গ্রামে, গঞ্জের বহু এলাকায় বিদ্যুতের দৈনন্দিন ব্যাবহার নাগরিকদের আধুনিক জীবনকে কর্মচঞ্চল ও আনন্দময় করেছে। বিদ্যুতের হেরফের হলে জীবনযাপন স্থবির হয়ে পড়ে। বিদ্যুতের ঘাটতি অথবা লােডশেডিং এখন নিত্য দিনের ঘটনা, ফলে কর্মকাণ্ডে যে বিঘ্ন সুষ্টি হয় তাতে মানুষের ব্যক্তিজীবন নানাভবে বাধাগ্রস্থ হয়, বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামাে। লেখাপড়ার জন্য আলাে চাই, তাই বিদ্যুৎ দরকার। অনেক টাকার শপিং ও মার্কেটিং করেছেন, অনেক মাছ,মাংস কিনেছেন, ফলমূল কিনেছেন এগুলাে কিছুদিনের জন্যে সংরক্ষণের মূল্যবান ফিজ (Refrigerator রিফ্রিজারেটর, সংক্ষেপ ফ্রিজ) ক্রয় করা হয়েছে, দুঃখের বিষয় বাড়িতে এসে দেখা গেল বিদ্যুৎ নেই [ওগুলো সংরক্ষণের জন্যে বিদ্যুতের কোন বিকল্প নেই] তখন ভাবুন তাে মনের অবস্থা। বিদ্যুৎ না পাওয়া গেলে এতাে দামের সওদা সব নষ্ট হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পর যেইমাত্র বিদ্যুৎ এসেছে অমনি সবার অন্ধকার মুখে তৃপ্তির হাসি। মানুষের আধুনিক জীবনযাত্রায় চিত্তবিনােদনের উৎস খুঁজতে গেলে বিদ্যুতের প্রতি হাত বাড়াতে হবে। আপনি ছেলেমেয়েকে ডাক্তারি পড়াবেন। দরকার বিদ্যুৎ। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াবেন, বিদ্যুৎ শক্তির সাহায্য ছাড়া প্রকৌশলি হওয়া বাতুলতা। সারাদিনের কর্মকাণ্ডের পর শরীর পরিশ্রান্ত, চিত্তবিনােদনের জন্য টি.ভি সেট খুলে দিবেন, হায় অদৃষ্ট! বিদ্যুৎ নেই। বন্ধ করে দিলেন। রেডিও শুনবেন, ঐ একই কথা। বৈদ্যুতিক প্রবাহ না হলে সবই অচল। এটা হল আধুনিক জীবনের বিড়ম্ঘনা।
মানবকল্যাণে বিদ্যুৎ : মানবকল্যাণে বিজ্ঞানের যতগুলাে অবদান আছে তন্মধ্যে বিদ্যুত্ব সবার শীর্ষে। এক কথায় বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিক জীবন একেবারেই অচল ও অকেজো। আজ পর্যন্ত বিদ্যুৎ প্রবাহের মাধ্যমে সমাজে সংসারে যত কাজ হয়েছে। তার সবগুলােই মানুষের সেবায় নিয়ােজিত। রাতের শেষপ্রহর যখন পক্ষিকুলের কলকাকলিতে মুখর, নরনারীর ঘুম যখন ভেঙে যায় তখন থেকে শুরু করে সারাদিন পর আবার রাত্রিতে বিশ্রামের আয়ােজনের পর বিছানায় দেহ এলিয়ে দেয়া অবধি কেবল বিদ্যুতের খেলাই চোখে পড়ে। মানবজাতির উপকার করার জন্যেই যেন তার অস্তিত্বের ঘােষণা।
উপসংহার : আধুনিক জীবনে সমৃদ্ধির চাবিকাঠি হলাে বিদ্যুৎ । বর্তমান পৃথিবীকে বশীভূত করার জন্যে মানুষ নানাভাবে বিদ্যুতকে কাজে লাগাচ্ছে। বিদ্যুৎ ছাড়া এ কালের আধুনিক জীবনযাপন অর্থহীন। সর্বক্ষেত্রে উন্নতি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহের গতি অব্যাহতভাবে চালু রাখা দরকার এবং তা এভাবে চালু রাখতে পারলে আধুনিক জীবনব্যবস্থায় শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। লােডশেডিং, ঘন ঘন বিদ্যুতের যাওয়া ও আসা জনজীবনের ওপর দ্রুত বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। এ প্রতিক্রিয়ার ফসল হিসেবে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন যে উষ্ণ হয়ে উঠবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বিদ্যুৎ ঘাটতি আধুনিক জীবন যাপনের ক্ষেত্রে এক বিরাট হুমকি। এ সমস্যার সমাধান সম্ভব হলে সামগ্রীকভাবে দেশের কল্যাণকেই নিশ্চিত করবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
Post a Comment