বা টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষা
ভূমিকা: টেলিভিশন আধুনিক বিজ্ঞানের একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার। লাতিন Tele' শব্দের অর্থ দূর এবং 'vision' শব্দের অর্থ দৃষ্টি। এ দুটি শব্দের মিলিত রূপ হচ্ছে- 'Television' । দুটি শব্দের অর্থ একত্র করলে দাঁড়ায় দূরদৃষ্টি বা দূরদর্শন। শব্দটির অর্থ থেকেই বােঝা যায় দূর-বহুদূর থেকে ছবি দেখা যায়, টেলিভিশন এমন একটা যন্ত্র। আসলেই তাই; টেলিভিশনে আমরা বহুদূরে ঘটে যাওয়া কোনাে ঘটনা ঘরে বসেই দেখতে পাই। টেলিভিশন বেতার যন্ত্রের উন্নত সংস্করণ। টেলিভিশনে আমরা শব্দ শােনার সঙ্গে সঙ্গে ছবিও দেখতে পাই।
টেলিভিশন আবিষ্কার: মানুষ যেদিন আকাশের ক্ষণ-বিদ্যুৎকে আবিষ্কার করল, যেদিন বিদ্যুৎ তরঙ্গ বিদ্যুৎশক্তিকে সে বশীভূত করল, সেদিন তার সামনে এক অনন্ত সম্ভাবনাময় সমৃদ্ধ পৃথিবীর রুদ্ধ দ্বার খুলে গেল। মানুষ পেল তরঙ্গ ও ইলেক্ট্রনের অনন্ত রহস্যের সন্ধান। সেই আবিষ্কারের পথ ধরেই এল বেতার। মানুষ শুনল দূরতম প্রান্তের মানুষের কণ্ঠস্বর। আর টেলিভিশন যেন একই সজ্গে চিত্র ও বাণীর অপূর্ব সমাহার। চিত্র ও বাণীকে প্রথম সফলভাবে তারের সাহায্যে দূরে প্রেরণ করেন ইংল্যান্ডের জন লেগি বেয়ার্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের জেনকিন্স। সময়টা ছিল ১৯২৫ সাল। অবশ্য এর আগে আলােক তড়িৎকোষ ব্যবহার করে প্রাথমিক পর্যায়ের টেলিভিশন আবিষ্কার করেন জি. আর. কেরি। ১৮৮৪ সালে জার্মান বিজ্ঞানী পল্ নিপকো স্ক্যানিং ডিস্ক টেলিভিশন পদ্ধতির আবিষ্কার করেন। বেয়ার্ড ও জেনকিন্সের পদ্ধতিকে উন্নত করে কুড়ির দশকেই টেলিভিশন ক্যামেরার প্রচলন করেন ভাদিমির জোরিকিন্ ও ফিলাে ফার্নসওয়ার্থ। পরে টেলিভিশন আরও উন্নত হয়, 'ইমেজ অর্থিকন ও ‘কিনেস্কোপ’ পদ্ধতির ব্যবহারে। ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরশনই (বিবিসি) প্রথম ব্যবসায়িক ভিত্তিতে টেলিভিশন প্রচার করে। এখনও টেলিভিশন নিয়ে চলছে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা; এরই অনিবার্য ফল হলাে আধুনিকতম টেলিভিশন।
টেলিভিশনের গঠন-কৌশল: টেলিভিশন ক্যামেরায় যে ছবি ধরা হয় তাকে ইলেক্ট্রন পদ্ধতিতে পরিণত করা হয় ভােল্টেজ সিগন্যাল-এ। একেই আমরা বলি ভিডিও সিগন্যাল বা চিত্র সংকেত। টেলিভিশন টাওয়ার থেকে সেই চিত্র সংকেতকে বিশেষ পদ্ধতিতে প্রেরণ করা হয় চারদিকে। আমাদের টেলিভিশনের এন্টেনা সেই চিত্র সংকেত গ্রহণ করে পাঠিয়ে দেয় টেলিভিশনের ভেতরে। টেলিভিশনের পর্দাটি কাচের তৈরি। তবে কাচের ভেতরের পিঠে 'ফসফর' নামে একটি প্রতিপ্রভ পদার্থের আস্তরণ লাগানা থাকে। এ প্রতিপ্রভ আস্তরণের ফলে ইলেক্ট্রনকণা টেলিভিশনের পর্দার কোনাে একটি জায়গায় আঘাত করলেই সেখান থেকে বিচ্ছুরিত হয় আলাে। দূরদর্শনের ভেতরে থাকে ইলেক্ট্রন তৈরির ব্যবস্থা। সেখানে একটি ইলেক্ট্রন বন্দুক থেকে বেরিয়ে আসে চিত্র-সংকেতের তীব্রতা অনুযায়ী কমবেশি ইলেক্ট্রন স্রোতের বর্শা। সমস্ত ঘটনাগুলাে ঘটে আলাের গতিতে অর্থাৎ সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলােমিটার বেগে। ফলে সমস্তটাই সাথে সাথে ঘটে যায় বলে মনে হয় । শব্দ সংকেত ও চিত্র সংকেত টেলিভিশন কেন্দ্র থেকে একই সঙ্গে প্রেরিত হয়। দুটি সংকেতের সামঞ্জস্য বিধানের ফলেই সম্ভব হয় একই সঙ্গে ছবির দর্শন ও শব্দ শ্রবণ।
টেলিভিশনের ব্যবহার: টেলিভিশনের ব্যবহার পৃথিবীর সকল উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আমাদের দেশে টেলিভিশন চালু হয়েছে প্রায় ত্রিশ বছর আগে। আমাদের দেশে টেলিভিশন মূলত বিনােদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠানমালায় যুক্ত করা হয়েছে গণশিক্ষা, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, পরিবার পরিকল্পনা, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সম্পর্কিত অনুষ্ঠান।
উপকারিতা: টেলিভিশন আধুনিক জীবনের জন্যে খুবই প্রয়ােজনীয় এক উপকরণ। এটা শিক্ষার মাধ্যম। টেলিভিশন বিশ্বের সুদূর কোনাে এক প্রান্তের সংবাদ ও ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে অন্য প্রান্তে প্রত্যক্ষ ও জীবন্তরূপে পরিবেশন করতে পারে। একটি টেলিভিশন সেট থাকলে নিজের ঘরের কোণে সারা দুনিয়াটাকে পাওয়া যায়। আমাদের বিশ্বাস এটা যেমন চন্দ্রাভিযানে চন্দ্রলােকের চিত্র ও বাণী বহন করে এনেছে, তেমনি একদিন হয়তাে গ্রহান্তরের চিত্র ও বাণী পৃথিবীপৃষ্ঠে বহন করে আনতে সক্ষম হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে টেলিভিশনের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। সর্বস্তরের শিক্ষণীয় বিষয় অতি দ্রুত প্রচার সম্ভব হয় এ টেলিভিশনের মাধ্যমেই ।
শিক্ষাক্ষেত্রে টেলিভিশন: টেলিভিশনের মাধ্যমে তথ্যপ্রদান, বিনােদন ও সমাজসচেতনতামুলক কার্যপ্রণালি অনুষ্ঠানাকারে প্রকাশের পাশাপাশি সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক ও উচ্চশিক্ষা বিস্তারেও আমরা উপকৃত হচ্ছি। আমাদের দেশে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম, চিকিৎসা, রান্না বিষয়ক কয়েকটি অনুষ্ঠান চালু রয়েছে। প্রচারিত এসব অনুষ্ঠানমালা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিকল্প হলেও এর বাস্তব সুফল পেয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন সমাজের অনেকেই।
জনমত গঠনে টেলিভিশনের ভূমিকা: জনমত গঠনে টেলিভিশন অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কোনো বিষয়ে জনমত গঠনের লক্ষ্যে টেলিভিশনে প্রচারণা চালানাে হলে তা সহজেই জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জনগণ বিচার-বিশ্লেষণ করে সে বিষয়ের প্রতি তাদের মতামত প্রদান করতে পারে। টেলিভিশন বিভিন্ন অস্পষ্ট ধারণাকে জনগণের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরে। যার ফলে জনগণ হয়ে ওঠে প্রায়ােগিক ও বাস্তবমুখী। জনমত গঠনের ক্ষেত্রে টেলিভিশন তিনটি ভূমিকা পালন করে। যেমন:
ক. জনগণের বিভ্রান্তি দূর করে।
খ. জনগণের মতামত প্রকাশের স্পৃহাকে অধিকতর জোরালাে করে। গ. জনগণকে করে তােলে সচেতন ও আত্মপ্রত্যয়ী।
জনমত গঠনে টেলিভশনের ভূমিকা সম্পর্কে ড. শমশের আলী বলেন, 'The extra ordinary role played by television in the formation of Public opinion can hardly be over-emphasized truly.' তবে দুঃখের বিষয় যে, বাংলাদেশ টেলিভিশন স্বাধীনভাবে কখনও কাজ করতে পারে নি। ১৯৭১ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় সবক্ষেত্রেই বাংলাদেশ টেলিভিশন নিজস্ব পরিকল্পনা প্রয়ােগ করে সুষ্ঠু জনমত গঠনে সক্ষম হয়নি। তাই আক্ষেপ করে অধ্যাপক নূরুল আমীন বেপারী বলেন, 'It is really irony of fate that we couldn't ensure the suitable condition of raido and television in Bangladesh still now.' তবে সাম্প্রতিকালে দেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলাে অনেকটা স্বাধীনভাবেই কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এগুলাের মধ্যে এটিএন, চ্যানেল আই, একুশে টিভি, এনটিভি উল্লেখযোগ্য।
সচেতনতা সৃষ্টিতে টেলিভিশনের ভূমিকা: বাংলাদেশের অধিকাংশ লােক নিরক্ষর। তাই তারা নিজেদের জীবনের ও জাতির বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন নয়। টেলিভিশন সমাজের জন্যে ক্ষতিকর বিভিন্ন বিষয় জনগণের সামনে সুন্দরভাবে তুলে ধরে। এইডস, আর্সেনিক, পরিবার পরিকল্পনা, পরিবেশ দূষণ, বিভিন্ন কুসংস্কারসহ বিভিন্ন সমস্যা ও রােগ সম্বন্ধে জনগণকে সচেতন করে তােলে টেলিভিশন। কোনাে নতুন জিনিস সম্পর্কে টেলিভিশনের মাধ্যমেই জনগণ জানতে পারে এবং পরিচিত হতে পারে। বিভিন্ন অজানা বিষয়ে জ্ঞানলাভ করতে পারে। এভাবে জনগণকে সচেতন করতে টেলিভিশন বিশেষ ভূমিকা রেখে থাকে। এগুলোর মধ্যে এটিএন, চ্যানেল আই, একুশে টিভি, এনটিভি উল্লেখযোগ্য।
অপকারিতা: টেলিভিশন যেমন আমাদের বিশুদ্ধ আমােদ বিতরণ এবং শিক্ষাদানের কাজ করে, তেমনই এর কিছু কিছু অপকারিতা আছে। টেলিভিশন অধিক সময় ধরে দেখলে দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি হয়ে থাকে। ডিশ এন্টেনার প্রভাবে আজকাল টেলিভিশনে অনেক কুরুচিপূর্ণ চিত্রও প্রদর্শিত হচ্ছে। এ সকল ছবি ছেলেমেয়েদের নৈতিক অবনতির কারণ হচ্ছে। অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ এ ছবিগুলো বালক-বালিকা ও যুবক-যুবতীদেরকে অধঃপতনের দিকে চালিত করছে।
উপসংহার: টেলিভিশন কার্যকরী গণমাধ্যম হিসেবে আমাদের দেশে অতি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সুস্থ বিনােদনের সঙ্গে সঙ্গে টেলিভিশনকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুললে সমাজ, জাতি ও দেশ উপকৃত হবে।
1 comment