৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি: জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো প্যারিসে অনুষ্ঠিত এর দ্বি বার্ষিক সম্মেলনে ৩০ অক্টোবর, ২০১৭ তারিখে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে 'বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তা সংস্থাটির 'মেমােরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রার' এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা/বিশেষজ্ঞ কমিটি কর্তৃক দুই বছর ধরে প্রামাণ্য দালিলিক যাচাই-বাছাই শেষে ইউনেস্কোর সেক্রেটারি জেনারেলের সম্মতিক্রমে এটি সংস্থার নির্বাহী কমিটি কর্তৃক চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। দীর্ঘ ৪৬ বছর পরে হলেও জাতিসংঘের মতাে বিশ্বসংস্থার এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর ফলে বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রণােদনাময়ী ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্বব্যাপী মানবজাতির মূল্যবান ও ঐতিহ্যপূর্ণ সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত ও গৃহীত হলাে। স্বাধীনতার জন্য আত্মােতসর্গকৃত ৩০ লাখ শহিদ আর সম্ভম হারানাে কয়েক লাখ মা-বােনসহ আমাদের সবার জন্য এটি এক মহা- আনন্দ ও বিরল সম্মানের ঘটনা। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা শহিদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ফলে ভাষার অধিকার সংরক্ষণের প্রতীক হিসেবে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই ভাষা আন্দোলনে শুধু সংগঠকের ভূমিকাই পালন করেননি, তিনি ছিলেন প্রথম কারাবন্দিদের মধ্যে অন্যতম। উল্লেখ্য, ১৯৯২ সাল থেকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য সম্পদের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে আসছে। এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইউনেস্কোর সেক্রেটারি জেনারেল ইরিনা বজোভার কথায়, আমি গভীর ও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি দালিলিক ঐতিহ্য ও স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য এ কর্মসূচি পরিচালিত হওয়া উচিত, যাতে করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সংলাপ, আন্তর্জাতিক সহযােগিতা, পারস্পরিক বােঝাপড়া ও শান্তির চেতনা মনে লালন করতে পারে' যুদ্ধ-বিগ্রহ, ধর্মীয় উন্মাদনা, লুণ্ঠন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন ইত্যাদি কারণে দেশে-দেশে বিশ্ব ঐতিহ্য সম্পদ বিনষ্ট বা ধ্বংস প্রাপ্ত হচ্ছে। আবার সম্পদের অপ্রতুলতার কারণেও যথাযথভাবে তা সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণেও তা বিনষ্ট বা বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। এসব দিক বিবেচনায় ইউনেস্কোর এ কর্মসূচির গুরুত্ব অপরিসীম। গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিসের অপর এক নগররাষ্ট্র স্পার্টার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত স্বদেশীয় সৈন্য ও সাধারণ মানুষের স্মরণে প্রদত্ত ভাষণ (৪৩১ খ্রি.পূর্ব) থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রােনান্ড রিগানের ১৯৮৭ সালে বার্লিনে দুই জার্মানির মধ্যকার বিভক্তির দেয়াল (বার্লিন ওয়াল) ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার আহ্বান সংবলিত ভাষণ পর্যন্ত এখানে স্থান পেয়েছে আড়াই হাজার বছরের বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে অধিক প্রভাব বিস্তারকারী ৪১ জন সামরিক, বেসামরিক জাতীয় বীরের বিখ্যাত ভাষণ নিয়ে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Jacob F Feild 'We shall Eight on the Beaches: The Speeches That Inspired History' শিরােনামে একটি গ্রন্থ সংকলন করেন, যা ২০১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে অন্যান্যদের মধ্যে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, জুলিয়াস সিজার, অলিভার ক্রমওয়েল, জর্জ ওয়াশিংটন, নেপােলিয়ন বােনাপার্ট, যােসেফ গ্যারিবােন্ড, আব্রাহাম লিংকন, ব্লাদিমির লেনিন, উড্রো উইলসন, উইনস্টন চার্চিল, ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, চার্লস দ্য গল, মাও সেতুং, হাে চিং মিন প্রমুখ নেতাদের বিখ্যাত ভাষণের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
৭ই মার্চের ভাষণের পটভূমি ও সার কথা: ৭ই মার্চ ১৯৭১ বাঙালির জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। এ দিন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির, বাঙালি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখাে জনতার সমাবেশে তার জাতির উদ্দেশ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ রাখেন যা ইতিহাস খ্যাত ৭ই মার্চের ভাষণ নামে পরিচিত। ততকালীন পাকিস্তানের জনগণই শুধু নয়, সারাবিশ্বের মানুষ ঔৎসক্য নিয়ে তাকিয়ে ছিল; বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে কী বলেন তা শােনার অপেক্ষায় বিদেশি সব গুরুত্বপূর্ণ পত্রপত্রিকা ও সংবাদ মধ্যমের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য সেটি ছিল এক অন্তিম মুহূর্ত। অপরদিকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপ্ত বাঙালি জাতির জন্য ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শােষণের শৃঙ্খল ছিন্ন করে জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর চূড়ান্ত সংগ্রামের আহ্বান। এর পটভূমিতে ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালিদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী দল আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সত্ত্বেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বাঙালি জাতিকে সমূলে নির্মূল করার ষড়যন্ত্রে আশ্রয় গ্রহণ। এর প্রতিবাদে একদিকে চলছিল বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সারা বাংলায় সর্বাত্মক শান্তিপূর্ণ অসহযােগ আন্দোলন, অপরদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র জনগণের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণ ও হতামতের ঘটনা। ৭ই মার্চ নির্ধারিত সময়ে বঙ্গবন্ধু বিক্ষোভে উত্তাল রেসকোর্সের লাখাে জনতার সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হন। হৃদয়ে তার বাঙালির হাজার বছরের মুক্তির আন্দোলন, সংগ্রাম ও স্বপ্ন। মাথার ওপড় আকাশে ঘুরছিল পাকিস্তানি যুদ্ধ বিমান। এমন এক সন্ধিক্ষণে তিনি তার ১৮ মিনিটের সংক্ষিপ্ত জগৎ বিখ্যাত ভাষণ রাখলেন। অসাধারণ এক বক্তব্য। যেমনি সারগর্ভ, অজস্বী ও যুক্তিযুক্ত, তেমনি তির্যক, তীক্ষ ও দিকনির্দেশনাপূর্ণ। অপূর্ব শব্দশৈলী, বাক্যবিন্যাস ও বাচনভঙ্গিতে একান্তই আপন, নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস ও বাঙালিদের অবস্থার ব্যাখ্যা, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে বাঙালিদের দ্বন্দ্বের স্বরূপ তুলে ধরা, শান্তিপূর্ণভাবে বাঙালিদের অধিকার আদায়ের চেষ্টা, অসহযােগ আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা ও বিস্তারিত কর্মসূচি ঘােষণা করেন। সারা বাংলায় প্রতিরােধ গড়ে তােলার নির্দেশ, প্রতিরােধ সংগ্রাম শেষাবধি মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেওয়ার ইঙ্গিত, শত্রুর মােকাবেলায় গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন, যেকোনাে উসকানির মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারােপ করেন। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলে। তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করতে হবে। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।
কেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণের মধ্যে অন্যতম: বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি কেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণগুলাের মধ্যে অন্যতম হিসেবে অভিহিত? এর উত্তরে সংক্ষেপে বলা যায় এক. যে কোনাে শ্রেষ্ঠ ভাষণ মাত্রই তা প্রচণ্ড উদ্দীপনীয় (Inspiring); মুহূর্তে মানুষকে নব চেতনায় জাগিয়ে তুলে অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে তাদের প্রস্তুত করতে পারঙ্গম। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ 'সমগ্র বাঙালি জাতিকে নজিরবিহীনভাবে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। ভাষণে দৃপ্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু ঘােষণা করেছিলেন, “আমরা ভাতে মারবাে। আমরা পানিতে মারবাে। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। ........ রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবাে। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বাে ইনশাআল্লাহ। ঠিকই কোনরূপ আপসকামিতার পথে না গিয়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে ৫-১০ লাখ নয় ৩০ লাখ লােক আত্যোৎসর্গ করে এবং কয়েক লাখ মা-বােন সম্ত্রম হারান; যা বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন। দুই, শ্রেষ্ঠ ভাষণের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নেতৃত্বের সর্বোচ্চ দেশাত্মবােধ, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির এবং লক্ষ্য অর্জনে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণের মূল ও আশু লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসন-শােষণের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের - সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিন. শ্রেষ্ঠ ভাষণের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সময়ের পরিসীমায় গণ্ডিবদ্ধ না থেকে তা হয় কালােত্তীর্ণ ও সব সময়ের জন্য প্রেরণাদায়ী 'সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। (বঙ্গবন্ধু - শেখ মুজিবুর রহমান) চার, ইতিহাসখ্যাত শ্রেষ্ঠ ভাষণের আর একটি উল্লেখযােগ্য দিক হচ্ছে এর কাব্যিকতা; শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাসে তা হয়ে ওঠে গীতিময় ও শ্রবণে চতুর্দিকে অনুরণিত। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি ঠিক অনুরূপ, যে কারণে বঙ্গবন্ধু আখ্যাত হন 'Poet of Politics' রূপে পাঁচ, যে কোনাে শ্রেষ্ঠ ভাষণই বিদ্যমান পরিস্থিতি উথিত, একই কারণে তাৎক্ষণিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও হৃদয় উৎসারিত। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণও ছিল তা-ই কোনােরূপে লিখিত ছিল না। ছয়, শ্রেষ্ঠ হিসেবে চিহ্নিত ইতিহাসখ্যাত ভাষণের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আকারে তা নাতিদীর্ঘ। আব্রাহাম লিংকনের 'Gettysburg' Address-এর শব্দ সংখ্যা ২৭২, সময় ৩ মিনিটের কম। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের সময় ১৮ মিনিট, শব্দ ১১০৫। অপরদিকে মার্টিন লুথার কিং এর I have a dream Address-এর সময় ছিল ১৭ মিনিট, শব্দ সংখ্যা ১৬৬৭।
৭ই মার্চ কেন বিশ্ব সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত ও গৃহীত: যেসব দিক বিবেচনায় ৭ই মার্চের ভাষণ এক অনন্য অসাধারণ ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত ও মানবজাতির অমূল্য সম্পদ হিসেবে গৃহীত, তা হচ্ছে এরূপ— এক. জাতিসংঘের বিশ্ব মানবাধিকার ঘােষণাপত্রে (১০ই ডিসেম্বর ১৯৪৮) ঔপনিবেশবাদ, বর্ণ বৈষম্যবাদ, জাতি-নিপীড়ন ইত্যাদি থেকে পৃথিবীর সর্বত্র জাতিগােষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি গৃহীত ও স্বীকৃত হয়। পাকিস্তানে অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাষণ-শশাষণ ও জাতি নিপীড়নের নিগঢ় থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে নির্দেশিত বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম ছিল ওই নীতি-আদর্শের সঙ্গে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ। দুই. একটি রাষ্ট্রের বন্ধন ছিন্ন করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ ছিল তৃতীয় বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম নজির সৃষ্টিকারী ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল এর সব প্রেরণার মূলে। বাঙালির জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত দীর্ঘ ঐতিহাসিক আন্দোলন সংগ্রামের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা রেখেও এ কথা বললে বােধ হয় অত্যুক্তি হবে না যে, একটি ভাষণে (৭ই মার্চ) একটি জাতি-রাষ্ট্রের (বাংলাদেশ) সৃষ্টি এবং তাও মাত্র নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যা বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। তিন, আমেরিকায় বর্ণবৈষম্যবাদবিরােধী আন্দোলনের প্রিয় নেতা বিশ্বনন্দিত মার্টিন লুথার কিং এর মতাে জনগণকে শুধু 'I have a dream' বা একটি 'স্বপ্নের কথা' (দাসপ্রথা বিলুপ্তি) বলতে নয়, বরং ৭ই মার্চ বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেকোর্স ময়দানে জনতার উত্তাল মহাসমুদ্রে হাজির হন বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বাধীনতার স্বপ্নের বাস্তবায়ন তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামের উদাত্ত আহ্বান নিয়ে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আসন্ন যুদ্ধের বিশেষ করে গেরিলা যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণে বাঙালিদের দিকনির্দেশনা দান শেষে বঙ্গবন্ধুর আহ্বান ছিল, 'ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলাে। তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তােমরা বন্ধ করে দেবে।' পাকিস্তানের কারগারে বন্দি থাকা সত্ত্বেও তারই নামে পরিচালিত নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় বাঙালির লালিত স্বপ্ন মহান স্বাধীনতা। চার, ঢাকায় উপস্থিত বিদেশি সাংবাদিকসহ প্রায় সর্বমহলের ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধু তার ৭ই মার্চের ভাষণে সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যাকে বলা হয় UDI (Unilateral Declaration of Independence) ঘােষণা করবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ, অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক। স্নায়ু যুদ্ধকালীন বিশ্ব রাজনীতির গতিধারা বা মেরুকরণ সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। দেশের অভ্যন্তরে কিংবা বহির্বিশ্বে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে তিনি যাতে কোনাে অবস্থাতেই চিহ্নিত না হন, সে ব্যাপারে তিনি ছিলেন সদা সর্বদা অত্যন্ত সতর্ক। তেমনটি ঘটলে তৎকালীন বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন হয়তাে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতাে। তার সম্মুখে দৃষ্টান্ত ছিল কীভাবে নাইজেরিয়ার বিয়াফ্রা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন (১৯৬৭- ১৯৭০) আদর্শিক বিভাজন নির্বিশেষে বৃহৎ শক্তির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে কঠোরভাবে দমন করা হয়। তাই বঙ্গবন্ধুর কথা ছিল মেজরিটি (বাঙালি) মাইনরিটি (পশ্চিম পাকিস্তান) থেকে বিচ্ছিন্ন হবে কেন? বরং মাইনরিটিই। ‘সিসিড' করছে এটাই বিশ্বাসীর কাছে প্রতিভাত হােক। পাঁচ, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল ব্যস্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতারই ঘােষণা। তবে বিদ্যমান বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাস্তবতায় তিনি কৌশলের আশ্রয়ী হন এই যা। ভাষণের শেষভাগে তিনি এমনভাবে স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করেন যাতে ঘােষণার কিছু বাকিও থাকে না, অপরদিকে তার বিরুদ্ধে একতরফা স্বাধীনতা ঘােষণার (UDI) অভিযােগ উত্থাপন করাও পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর পক্ষে আদৌ সহজ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর এ কৌশলী অবস্থান সুদক্ষ সমরকুশলীদেরও অবাক করার মতাে। ছয়, বাঙালির জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে দীর্ঘ গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতা চূড়ান্ত পর্বে এসে একটি ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যেভাবে দ্রুত তার নিরম্ত্র জাতিগােষ্ঠীকে তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার স্বপ্ন অর্জনে সশস্ত্ররূপে আবির্ভূত হতে উদ্বুদ্ধ করেন সেটিও এক বিরল ঘটনা। সাত, ৭ই মার্চ এক বিস্ফোরণােন্মুখ পরিস্থিতির মুখােমুখি দাঁড়িয়ে সর্বাধিক বিবেচনায় রেখে ধীরস্থির অথচ তেজোদীপ্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু এমনি এক ভাষণ রাখলেন, যার নজির ইতিহাসে বিরল। ভাষণে একদিকে যেমন ছিল শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরােধ গড়ে তােলার আহ্বান, অপরদিকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টা। ('আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করছি') গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ (যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।') মানবিকতা (.... গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সে জন্য ...), অসাম্প্রদায়িক আদর্শ ও সম্প্রীতি (এই বাংলা হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের উপরে)। ভাষণের এসবদিক তথা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের দায়িত্ববােধের প্রকাশ ছিল সবার নজর কাড়ার মতাে। আট, ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে পরিগণিত অধিকাংশ নেতৃত্বের বক্তব্য যেখানে লিখিত (আব্রাহাম লিংকনের ১৮৬৩ সালের বহুল উচ্চারিত Gettysburg Address টি সম্পূর্ণ ও ওয়াশিংটন ডিসির লিংকন মেমােরিয়াল চত্বরে মার্টিন লুথার কিং এর ১৯৬৩ সালের বিখ্যাত T have a dream Address-টির প্রথম দিকের বক্তব্য ছিল লিখিত। সেখানে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি ছিল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অলিখিত, স্বতঃস্ফূর্ত, যা এ ভাষণকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। নয়, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ পৃথিবীর একাধিক ভাষায় ইতােমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে (৪৬ বছর) পৃথিবীর কোনাে দেশে কোনাে নেতার ভাষণ সে দেশের মানুষ শ্রবণ করে আসছে কিনা সন্দেহ। এটি এমনি ব্যঞ্জনাপূর্ণ ও গীতিময় যে, যতবার শ্রবণ করা হয়, ততবারই মনে হয় এই প্রথমবার শােনা হলাে কখনাে পুরনাে মনে হয় না।
উপসহার: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতিকে মুক্তির মােহনায় দাঁড় করিয়েছিলেন। তিনি এই একটি ভাষণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। যুগে যুগে এ ভাষণ নিপীড়িত, লাতি স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রেরণা ও উদ্দীপনার উৎস হিসেবে কাজ করে। গণতন্ত্র, উচ্চ মানবিকতা, ত্যাগ ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল আদর্শ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম, জাতিভেদ, বৈষম্য ও জাতি-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্ব মানবতার মুক্তির সংগ্রামে যুগে যুগে এ ভাষণ অনুপ্রেরণা জোগাবে। সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে নবীন প্রজন্ম, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাষ্ট্রনায়ক, সমরকুশলী। সবার জন্যই এ ভাষণে রয়েছে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়।
1 comment