'পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,
এদেশের বুকে আঠারাে আসুক নেমে।'
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যুবসমাজ এখন বিপথে পরিচালিত হচ্ছে। প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতিতে যুবসমাজের অবক্ষয়ের কারণে জাতি হতাশায় নিমজ্জিত। এ অবক্ষয় জাতির বুকে গভীর ক্ষত তৈরি করছে। গােটা সমাজকে ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চিত অন্ধকারের দিকে। আর এই সমস্যার প্রতিকার না হলে দেশ ও জাতি ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হবে।
যুবসমাজ ও অবক্ষয় : অবক্ষয় শব্দের আভিধানিক অর্থ হলাে ক্ষয়প্রাপ্তি। মানবজীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে হলে কিছু গুণের প্রয়োজন হয়। আর মানুষের এই গুণগুলি যখনই লােপ পায় বা নষ্ট হয় তখনই শুরু হয় নৈতিক অবক্ষয়। কোনাে একটি দেশের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হলাে যুবসমাজ। তারা কখনও পরাজয় মেনে নেয় না এবং পুরাতনকে নতুন করে গড়তে চায়। কিন্তু এই যুবসমাজ যখন খারাপ পথে ধাবিত হয় তখন সমাজের মধ্যে নানা সমস্যা দেখা যায়। যুবসমাজের অবক্ষয়ের কারণে জাতীয় জীবনে নেমে আসে চরম দুঃখ-দুর্দশা, বিপর্যয় ও হতাশা।
অপসংস্কৃতির প্রভাব : আমাদের সমাজের তরুণদের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ হলাে বিদেশি সংস্কৃতির নামে এক ধরণের অপসংস্কৃতির প্রসার। বর্তমানে আমাদের চলচ্চিত্রের অশ্লীল নাচ, গান, সংলাপ যুবসমাজকে ক্রমান্বয়ে গ্রাস করে ফেলছে। ডিশ এন্টেনার প্রভাবে বিদেশি অপসংস্কৃতি আমাদের যুবসমাজকে চেপে ধরেছে। তাছাড়া রুচিহীন পােশাক-পরিচ্ছদও অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ।
অপসংস্কৃতির উৎস তথ্যপ্রযুক্তি : উনিশ শতকের বাংলায় পাশ্চাত্য সংস্কৃতি উদ্দাম ভােগ-বিলাসিতা ও উদ্ধৃঙ্খলতার জন্ম দেয়। নতুন সংস্কৃতির উন্মত্ততায় সে সময়ে যে অনাচার ও উদ্ধৃঙ্খলতার দেখা দিয়েছিল সেগুলােকে বর্জন করে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সদর্থক ইতিবাচক দিকগুলাে গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছিল সমাজ-সংস্কারক বাঙালি মনীষীরা। বর্তমানে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার অবাধ সুযােগে আমাদের জাতীয় জীবনে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। পাশ্চাত্য যুবসমাজ যে মাদক নেশা ও অবক্ষয়ে আক্রান্ত, আকাশ- সংস্কৃতির মাধ্যমে তা ক্রমবিস্তার লাভ করছে আমাদের তরুণ সমাজে। অসংত পাশ্চাত্য মানসিকতা, উগ্র বিদেশিয়ানা ও ভােগপ্রবণ স্থূলতা আজ আমাদের সংস্কৃতির মূলধারাকে গ্রাস করতে বসেছে। বৈদেশিক সংস্কৃতির নির্বিকার গ্রহণ আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির জন্য এখন হুমকিস্বরূপ।
প্রযুক্তির অপব্যবহার : প্রযুক্তির সহজবােধ্যতা যুবসমাজকে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে যুব সমাজের অবক্ষয়। পত্রিকা, ম্যাগাজিন, টিভি, ইন্টারনেট, ফেসবুকসহ নানা ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার অনস্বীকার্য। সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্যবহৃত টুথব্রাশ ও টুথপেস্ট এবং ঘুমাতে যাওয়ার আগে ঘরে বসে দ্রুত সময়ে পৃথিবীর যে কোনাে খবর জানা ও আপনজনের সঙ্গে যােগাযােগের মাধ্যম হিসেবে পরিচিত টিভি ও ইন্টারনেটও প্রযুক্তির অবদান। প্রযুক্তি মানুষের জীবনযাত্রার মান সহজতর করাসহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও দুর্ভাগ্যবশত এটির অপব্যবহার কিশাের ও যুবসমাজকে অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত করছে।
যুবসমাজের উপর প্রযুক্তির কুপ্রভাব : প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে যুবসমাজের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তনসহ কিছু মনস্তাত্ত্বিক এবং আচরণগত পরিবর্তন অবধারিত। বাংলাদেশের মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের ২০১৫ সালের একটি জরিপ উদাহরণস্বরূপ তুলে ধরা যেতে পারে। জরিপে দেখানাে হয়েছে, ঢাকার একটি স্কুলে মােট ৩০ জন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীর মধ্যে ক্লাসরুমে বসে পর্ণগ্রাফি দেখে এরকম ২৫ জনের মােবাইলে পর্ণগ্রাফি পাওয়া যায়। অপরদিকে, ১০০ জন অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ৮৬ জন মােবাইল ব্যবহার করে যাদের মধ্যে ৭৬ জন পর্ণগ্রাফি দেখে। ফলে তাদের আসক্তির মাত্রা বেড়ে চলছে পাশাপাশি লেখাপড়ায় অমনােযােগীর সংখ্যাও লক্ষণীয়। কিছু বিকৃত রুচিহীন বিনােদনমূলক অনুষ্ঠান, মিউজিক ভিডিও, পর্ণগ্রাফি কিশাের ও যুবকদের খারাপ কাজে উদ্দীপনা তৈরির পাশাপাশি অনুকরণে উৎসাহ দেয়। ফলে বড় বড় অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি যুবসমাজ বিপদগামী হওয়ার কারণ হিসেবে আমেরিকান কয়েকজন গবেষক প্রযুক্তির অপব্যবহারকে দায়ী করেছেন। কারণ, প্রযুক্তির এ অপব্যবহার তাদের ব্র্যান্ড, ইমেজ, ও গ্লামারের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি করে। ফলে এটির অনুকরণে যুবসমাজ ভাল-মন্দের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না। মানুষের জীবনযাত্রার মান সহজ ও স্মার্ট করার পেছনে ইন্টারনেট, ইউটিউব, ভাইবার, ফেসবুকসহ প্রযুক্তির আরাে অনেক মাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও এর আবার বিপরীত ভূমিকাও লক্ষ্য করা যায়। যা যুবসমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ। ইন্টারনেট, ইউটিউব, ভাইবার, পর্ণগ্রাফি আসক্তিতে উন্নত দেশগুলাের প্রায় ৬২% যুবসমাজ (১২-১৬) বছর যৌন হয়রানি ও ধর্ষণসহ বড় বড় অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। যা যুবসমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ এমনকি পর্ণ আসক্তিতে প্রতি বছর আমেরিকার স্কুল পড়ুয়া ২,৮০,০০০ শিক্ষার্থী গর্ভবতী হচ্ছে যা শুধু পরিবার নয় তথা পুরো সমাজ ও একটি রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। (সূত্র ন্যাশনাল ক্রাইম প্রিভেনশন সার্ভে)
উপসংহার : প্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। আবার আমাদের কাছ থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবােধ কেড়ে নিয়েছে। এ কথা সমীচীন নয় যে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমাদের সমাজের জন্য অপ্রয়ােজনীয়। সভ্যতার উন্নয়নে তথ্য প্রযুক্তির অবদান অপূরণীয়। কিন্তু আমাদের এ কথাও অনুধাবন করতে হবে যে প্রযুক্তির অকল্যাণকর দিকগুলো আমাদের অবস্থান কোথায় নামিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য এর জন্য আবিষ্কার ও আবিষ্কারক কোনােটিই অপরাধী নয়, অপরাধী হচ্ছি আমরা ব্যবহারকারীরা। তাই এ ব্যপারে আমাদের সচেতন হতে হবে । তবেই যুবসমাজ প্রযুক্তির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পাবে।
Post a Comment