SkyIsTheLimit
Bookmark

ঘুষ রচনা

ঘুষ ও বৈধতা
বা প্রশাসনে ঘুষের প্রভাব
বা ঘুষ ও বাংলাদেশ

ভূমিকা :
বহুবিধ দুর্নীতিতে ছেয়ে আছে আমাদের সমাজ জীবন। ঘুষ এক প্রকার দুর্নীতি। এটা একটা মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। সমাজব্যবস্থার অবক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ঘুষ। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটা দেশেই ভালাে কাজের পাশাপাশি কিছু খারাপ কাজ আমরা প্রত্যক্ষ করি। সেগুলাের মধ্যে ঘুষ অন্যতম এবং এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। তাই ঘুষ প্রবণতা থেকে আমাদের মুক্ত হওয়া একান্ত প্রয়োজন।

ঘুষ কি : ঘুষ হচ্ছে একটি অসৎ ও অবৈধ বিনিময় প্রথা। ঘুষের আভিধানিক অর্থ উৎকোচ। অন্যায়ভাবে কোন কাজ সম্পাদন করার জন্যে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে যখন কোন অর্থ বা সম্পদ গােপনে প্রদান করা হয় তখন তাকে ঘুষ বা উৎকোচ বলা হয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, রহিমের একটা কাজ কোন একটা অফিসের ক্ষমতাবান ব্যক্তি জনাব করিমের নিয়মমাফিক করে দেয়ার কথা। কিন্তু দীর্ঘদিন থেকে কাজটা তিনি করে দিচ্ছেন না। রহিমের কাজটা ফেলে রেখেছেন ফাইলবন্দী করে। এ অবস্থায় রহিম আর কোন পথ না দেখে জনাব করিমকে অবৈধভাবে কিছু অর্থ প্রদানের মাধ্যমে কাজটা আদায় করে নেয়। এ লেনদেনকেই ঘুষ বা উৎকোচ বলা হয়ে থাকে।

ঘুষের উৎপত্তি : ঘুষের উৎপত্তি কখন বা কোথায় হয়েছে তার সঠিক সময় নির্ণয় করা যায় না। সময়ের দিক থেকে এর কোন তথ্য প্রমাণও নেই। তবে প্রাচীনকাল থেকেই উপঢৌকন প্রথার প্রচলন ছিল। তাই ঘুষের আদি রূপ হিসেবে উপটৌকন প্রথাকেই উল্লেখ করা চলে। রাজা, মহারাজা, নবাব, জমিদারদের মাঝে এটা প্রচলন ছিল। বিশেষ করে ক্ষমতাবানদের তুষ্ট রাখার জন্যই তারা নানা ধরনের উপঢৌকন ছােট ছােট রাজ্যের রাজারা বড় রাজ্যের রাজা বা মহারাজাকে তুষ্ট রাখার জন্য উপঢৌকন বা নজরানা পাঠিয়ে তাদের মন জয় করার চেষ্টা করতেন। আধুনিককালে রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে উপটৌকনেরও চেহারা বদল হয়েছে। তাই বলা যায়, উপঢৌকন ব্যবস্থাই কালক্রমে সরাসরি অর্থনৈতিক অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে ঘুষ রূপে প্রবর্তিত হয়েছে।

বাংলাদেশে ঘুষ : বাংলাদেশে ‘ঘুষ’ একটা অত্যন্ত পরিচিত শব্দ। বাংলাদেশের রন্ধে রন্ধে ঘুষ চরমভাবে বিস্তার লাভ করেছে। ঘুষের নাম শােনেনি এমন লােক বাংলাদেশে আছে বলে আজ আর বিশ্বাস করা যায় না। আমাদের সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় এত চরমে উঠেছে যে, ঘুষ ছাড়া আজ আর কোন কাজই সম্পাদন করা যায় না। তাই ঘুষ লেনদেন আজ একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে বললেই চলে। তবে ঘুষ গ্রহণ বা প্রদান অন্যায় এবং ঘৃণিত বিষয় একথা কারােরই অজানা নয়। তবু সমাজে ঘুষ প্রথা বিদ্যমান। বাংলাদেশের অফিস আদালত থেকে শুরু করে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত আজ ঘুষ প্রথা বিস্তার লাভ করেছে। ঘুষ ছাড়া অফিসের ফাইল নড়ে না। এমনকি একই অফিসে এক শাখা থেকে আরেক শাখায়, এক জেলা থেকে আরেক জেলায় বদলির জন্যও তার নিজের অফিসের কাউকে না কাউকে ঘুষ দিতে হয়। সারাজীবন চাকরি করে পেনশনের টাকা তােলার জন্য তার নিজের অফিসের অফিসারকেও ক্ষেত্রবিশেষ ঘুষ দিতে হয়। এমনিভাবে ঘুষের দাপট বাংলাদেশকে কজা করে রেখেছে। ঘুষ যেন আমাদের অস্তিত্বের অবলম্বনে পরিণত হয়েছে। যে ঘুষ খায় না, অফিসের সবাই তাকে উপহাস করে। আর যে ঘুষ দিতে অপারগ হয়, বিনা দোষে তার শাস্তি হয়ে যায়। সুতরাং বাংলাদেশে ঘুষ এখন স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে পড়েছে। ঘুষ নামক অবৈধ লেনদেন লজ্জার বিষয় হলেও বাংলাদেশে এর বিস্তার এত বেশি যে, বর্তমানে কেউ তাতে লজ্জাবােধ করে না। বরং কোন চাকরিজীবী তার পরিচয় দিতে গেলে অপরদিক থেকে প্রশ্ন উঠে, উপরি কেমন আছে?

ঘুষের কুফল : ঘুষ এমন একটা অপরাধ, যা মানুষের নৈতিক মূল্যবােধকে ধ্বংস করে দেয়। ঘুষ প্রথা বিদ্যমান থাকার কারণে কেবল নৈতিক মূল্যবােধেরই অবক্ষয় হচ্ছে তা নয়, মানুষের মেধার সঠিক বিকাশও হচ্ছে না। যােগ্যতার মূল্যায়ন হচ্ছে না। মেধা বা প্রতিভা হচ্ছে নিরুৎসাহিত। ফলে দেশ ও জাতি ক্রমে ক্রমে মেপশূন্য হয়ে যাচ্ছে। যে সমাজে অবৈধ লেনদেন হয় সে সমাজ সভ্য সমাজ নয়। ঘুষ লেনদেনের কারণে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও বিচার কাঠামাে অচল হয়ে পড়ে। আইনের শাসনের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধাবােধ থাকে না। ফলে সমাজে অরাজকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে; অন্যায় বৃদ্ধি পায়। সামাজিক ন্যায়বিচার অবলুপ্ত হয়। সমাজ জীবনে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। অকল্যাণের অন্ধকারে হারিয়ে যায় কল্যাণ ও ন্যায়বােধ। ঘুষ মানুষকে যেমন দুর্নীতিপরায়ণ করে তেমনি সমাজকে নিয়ে যায় চরম অবক্ষয়ের দিকে।

ঘুষ প্রতিরােধের উপায়: ক্রমে ক্রমেই ঘুষ প্রথা অগ্রসর হচ্ছে এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে। এখন থেকেই এ ঘুষ প্রথা প্রতিরােধের ব্যবস্থা করা না হলে জাতির ভবিষ্যৎ তলিয়ে যাবে অন্ধকারের অতল গভীরে। তাই আর কালবিলম্ব না করে অবশ্যই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঘুষ প্রথা দমনের জন্য প্রথমেই সমাজ থেকে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হবে। তারপর দুর্নীতি দমন আইনের প্রয়ােগের মাধ্যমে কঠোর নীতি গ্রহণ করতে হবে। শুধু নীতি-নির্ধারণ করে বসে থাকলেই হবে না, তা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে। জনগণের মধ্যে বিবেকের জাগরণ ঘটানাের প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েও ঘুষ বা যে কোন ধরনের দুর্নীতি থেকে মানুষকে বিরত রাখা সম্ভব। কারণ, এর ফলে মূল্যবােধ সৃষ্টি হতে পারে আর মূল্যবােধ সৃষ্টি হলেই সমাজ থেকে ঘুষ বা দুর্নীতি দূর হতে পারে।

উপসংহার : ঘুষ প্রদান বা গ্রহণ উভয়ই এমন একটা সামাজিক ব্যাধি যা সমাজের মানুষ তথা জাতিকে নিয়ে যাচ্ছে। অধঃপতনের দিকে। ঘুষের ভেতর দিয়ে সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতি যেভাবে কলুষিত হয়ে উঠেছে তাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর সুন্দর ও সঠিক পথের সন্ধান পাবে না একথা বলাই বাহুল্য। তাই 'ঘুষ নামক এ মারাত্মক ব্যাধিকে দমন করার জন্যে প্রশাসনিকভাবে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। হয়ত একদিনে এ দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়, তবে সদ্দিচ্ছা নিয়ে আন্তরিকভাবে অগ্রসর হলে অদূর ভবিষ্যতে তা প্রতিরােধ করা সম্ভব হলেও হতে পারে। তবে জাতীয় কল্যাণ ও সমৃদ্ধি অর্জনের স্বার্থে ঘুষ প্রথা বন্ধ করতেই হবে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment