প্রাচীন কালের চিকিৎসাব্যবস্থা: চিকিৎসাব্যবস্থা প্রাচীন কালে ঠিক বিজ্ঞানসম্মত ছিল না। সঠিক ও কার্যকর চিকিৎসাব্যবস্থা তখন ছিল অকল্পনীয়। সে সময় মানুষ রােগমুক্তির জন্যে বিভিন্ন ধরনের কবিরাজি ওষুধ, গাছ-গাছালি, দোয়া-কালাম, তাবিজ-কবজ, পানিপড়া, ঝাড়-ফুক ইত্যাদির ওপর নির্ভর করত। ফলে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসাব্যবস্থার অভাবে মানুষ বিভিন্ন ধরনের জটিল রােগে আক্রান্ত হতাে। চিকিৎসাক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি না থাকায় এসব জটিল রােগ নির্ণয় করাও ছিল দুঃসাধ্য। ফলে সুচিকিৎসার অভাবে মারা যেত অনেকে।
আধুনিক যুগের বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসাব্যবস্থা: আধুনিক চিকিৎসার ধ্যান-ধারণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বিজ্ঞান বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। বিজ্ঞানের অবদানে আবিষ্কৃত হয় রােগ নির্ণয়ের নতুন নতুন যন্ত্রপাতি। এসব যন্ত্রের সাহায্যে জটিল সব রােগ নির্ণয় করা সম্ভবপর হয়েছে আধুনিক যুগে। বিজ্ঞানের অবদানে আধুনিক যুগে কবিরাজি চিকিৎসার পরিবর্তে হােমিওপ্যাথিক, অ্যালােপ্যাথিক চিকিৎসার প্রবর্তন হয়েছে। প্রাচীন কালের মতাে মানুষ কবিরাজি ওষুধের ওপর নির্ভর না করে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করছে। ফলে কঠিন সব রােগের হাত থেকে তারা মুক্তি পাচ্ছে। বিজ্ঞানের অবদানেই পেনিসিলিন, ক্লোরােমাইসিন, স্টেপটোমাইসিন ইত্যাদি ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। তাই আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার প্রবর্তনে বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য।
রােগ নির্ণয়ে বিজ্ঞান: রােগ নিরাময়ের জন্যে প্রথমেই প্রয়ােজন হয় রােগ নির্ণয়ের। সঠিক রােগ নির্ণয়ের মাধ্যমেই রােগের সঠিক ওষুধ প্রয়ােগ করা সম্ভব। সঠিকভাবে রােগ নির্ণয় করতে না পারলে সুচিকিৎসা করা সম্ভব নয়। রােগ নির্ণয়ে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছে বিজ্ঞান। অধ্যাপক রঞ্জনের আবিষ্কৃত রঞ্জন রশ্মি বা এক্সরে, ইসিজি, সিটি স্ক্যান, মাইক্রোসকোপ, আলট্রাসনােগ্রাফি, এমআরআই ইত্যাদি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে শরীরে পরীক্ষা চালিয়ে সঠিকভাবে রােগ নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে। আর এসবই বিজ্ঞানের অবদান।
রােগ প্রতিরােধে বিজ্ঞান: রােগ নির্ণয়ের পর তা প্রতিরােধের প্রয়ােজন হয়, প্রয়ােজন হয় রােগ নিরাময়ের। তবে রােগ নিরাময়ের চেয়ে তা প্রতিরােধই গুরুত্বপূর্ণ। রােগে আক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই তা প্রতিরােধ করতে সক্ষম হলে রােগের অতিরিক্ত ভােগান্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বিজ্ঞান এ অসাধ্যকে সাধন করেছে। বিজ্ঞানের আবির্ভাবে রােগ প্রতিরােধের জন্যে নানা ধরনের পন্থা আবিষ্কৃত হয়েছে। হাম, যক্ষ্মা, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, বসন্ত, ডিপথেরিয়া ইত্যাদি জটিল রােগ প্রতিরােধের জন্যে প্রতিষেধক টিকার ব্যবস্থা হয়েছে। বিজ্ঞানের বদৌলতেই এসব সম্ভব হয়েছে।
রােগ নিরাময়ে বিজ্ঞান: আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা বিজ্ঞানের আশীর্বাদেই সম্ভব হয়েছে। রােগ নিরাময়ের আধুনিক সব ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির ফলেই পেনিসিলিন, স্ট্রেপটোমাইসিন, ক্লোরােমাইসিন ইত্যাদি মহৌষধ আবিস্কৃত হয়েছে। এ ছাড়াও সর্দিজ্বর, কাশি, মাথাব্যথা, জন্ডিস, গ্যাস্ট্রিক ইত্যাদি ছােটখাটো যেসব রােগ যা প্রতিনিয়তই মানুষের জীবনে লেগে আছে তারও অনেক প্রকার ওষুধ বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে। অবশ্য দুরারােগ্য ব্যাধি এইডস, ক্যান্সার, SARS প্রভৃতি রােগের ওষুধ বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারেনি। তা সত্ত্বেও কিছুক্ষেত্রে ক্যান্সার রােগ নিরাময় সম্ভব হচ্ছে। এসব রােগের ওষুধ আবিষ্কারের জন্যে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা চালিয়ে যাচ্ছে নিরলস পরীক্ষা নিরীক্ষা ও গবেষণা। ভবিষ্যতে এসব রােগ নিরমায়ের ওষুধও হয়তাে বিজ্ঞান মানুষের হাতের নাগালে পৌছে দেবে। হেনরি ডেভিডের মতে, 'বিজ্ঞান বিশ্বসভ্যতাকে অনেক বিস্ময়কর উপহার দিয়েছে। আর এ বিস্ময়ের অন্যতম হলাে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা।
জটিল রােগের চিকিৎসায় বিজ্ঞান: চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সংযােজনের ফলে অনেক দুরারােগ্য রােগের ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। ফলে মানুষ জটিল সব রােগ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে পেয়েছে। কঠিন রােগে আক্রান্ত ব্যক্তিও আজ রােগমুক্তি লাভে আশার আলাে দেখছে। অধ্যাপক কুরি ও মাদামকুরির আবিষ্কৃত রেডিয়াম ব্যবহার করে দুরারােগ্য ক্যান্সার রােগেরও চিকিৎসা করছেন চিকিৎসকরা। অনেক ক্ষেত্রেই এ ভয়ংকর ক্যান্সার রােগ থেকে মানুষ মুক্তি পাচ্ছে। ভ্যাক্সিন আবিষ্কারে এককালের মহামারি বসন্ত রােগের চিকিৎসা সহজতর হয়েছে। বিজ্ঞানের আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে অপারেশন করা হচ্ছে জটিল রােগে আক্রান্ত রােগীকে। মানবদেহে হৃৎপিণ্ড, কিডনি প্রভৃতি সংযােজন করা সম্ভব হচ্ছে বিজ্ঞানের কল্যাণেই। প্লাস্টিক সার্জারি করে মানুষের শরীরের আকৃতি বা চেহারা পরিবর্তনের মতাে দুঃসাধ্য কাজও সম্ভব হচ্ছে বিজ্ঞানের আশীর্বাদে। মানবদেহের কোনাে অঙ্গের হানি ঘটলে (যেমন- হাত, পা, আঙুল ইত্যাদি) যন্ত্রপাতি দিয়ে নতুন হাত-পা তৈরি করে মানবদেহে সংযােজন করা সম্ভব হচ্ছে। অতএব দেখা যাচ্ছে, চিকিৎসার প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানের অবদান অসামান্য।
চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের গুরুত্ব: চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। অনেক দুরারােগ্য রােগ নির্ণয় ও তার চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার করেছে বিজ্ঞান। মানুষের জন্যেই বিশ্ব। সুস্থ-সবল মানুষই জাতিকে উন্নতির দিকে ধাবিত করতে পারে। বিজ্ঞান যদি চিকিৎসাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন না আনত, তাহলে কঠিন সব রােগব্যাধি থেকে মানুষ মুক্তি পেত না। অসংখ্য মানুষ প্রতিনিয়ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত। অসংখ্য অসুস্থ, অথর্ব মানুষ নিয়ে বিশ্বকে চলতে হতাে। মানুষের জীবনে সুখ-শান্তি বয়ে আনছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞান বিশ্বসভ্যতার জন্যে একাধারে আশীর্বাদ এবং অভিশাপও। কিন্তু চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান শুধু আশীর্বাদই বহন করছে। জীবজন্তু এবং মানুষ সকলের জন্যেই চিকিৎসাবিজ্ঞান আশীর্বাদ। এ প্রসঙ্গে কিপলিং বলেন, 'বিজ্ঞানের আশীর্বাদে বিশ্বমানবতা কখনও উল্লসিত হয়, আবার অনেক সময় তার বিভীষিকাময় রূপে বিশ্বসভ্যতা থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান এনেছে শুধু আশীর্বাদ আর আশীর্বাদ।
উপসংহার: সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটেই চলেছে। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতি সাধিত হয়েছে। মানুষ আর এখন কঠিন রােগে হাল ছাড়ে না। চিকিৎসাবিজ্ঞান মানুষের মাঝে বাঁচার আশা জাগিয়েছে। এক দেশে চিকিৎসার সুব্যবস্থা না থাকলে, অন্য দেশে ছুটে চলেছে উন্নত চিকিৎসার আশায়। হয়তাে চিকিৎসার জন্যে প্রয়ােজন হচ্ছে প্রচুর অর্থের, তবুও চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার ফলে মানুষ একপ্রকার মৃত্যুকে জয় করে চলেছে বলা যায়।
Post a Comment