SkyIsTheLimit
Bookmark

ছাত্র সমাজ ও রাজনীতি রচনা

রাজনীতিতে ছাত্র সমাজের ভূমিকা 
বা ছাত্র-রাজনীতি ও সন্ত্রাস
বা ছাত্র-রাজনীতি ও বাংলাদেশ 
ভূমিকা :
ছাত্র সমাজ অধ্যয়নে আত্মনিবেদিত এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে জ্ঞান সাধনায় সফলকাম হয়ে উঠে। এ সমাজ দেশ ও জাতির জন্য হয়ে উঠে সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। এ প্রসঙ্গে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন,
"আমরা শক্তি, আমরা বল
আমরা ছাত্রদল
মােদের পায়ের তলায় মূৰ্ছে তুফান
উর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল।” 
এই উক্তির মধ্য দিয়ে ছাত্রসমাজের স্বরূপ বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। দুর্জয় সাহস ও উদ্বেল তারুণ্য ছাত্রদেরকে যে কোন অসাধ্য সাধনে উদ্বুদ্ধ করে তােলে। রাজনীতির ক্ষেত্রেও তারা পিছিয়ে নেই। তারা বারবার রাজনীতিতে এসেছে কিন্তু অবশেষে প্রদীপের মত নিঃশেষ হয়ে অন্ধকারে দিশেহারা ছাত্রসমাজ রাজনীতিবিদগণের পথ খােলাসা করেছে এবং তারা নিজেদেরকে আদর্শ থেকে লক্ষ্যচ্যুত করেছে। 
অতিতের শিক্ষা ব্যবস্থা ও ছাত্রসমাজ : এক সময় ছাত্রসমাজ অধ্যয়নকে কঠোর তপস্যা হিসেবেই গ্রহণ করেছিল। অধ্যয়নই ছাত্রদের একমাত্র তপস্যা এ সুভাষণকে তারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। তখনকার কৃষিনির্ভর জীবনযাত্রায় রাজনীতি সাধারণ সমাজের বিষয় ছিল না। রাজনীতিতে ক্ষমতার হাতবদল ঘটত উত্তরাধিকার সূত্রে, যুদ্ধবিগ্রহে কিংবা রাজায় রাজায় শক্তি পরীক্ষার মাধ্যমে। জনজীবনের সাথে রাজনীতির প্রত্যক্ষ যােগ ছিল না। ফলে রাজনীতির সাথে সংস্রব রাখা, না রাখা পরবর্তী জীবনে কোন প্রভাব ফেলত না। 
আধুনিক বিশ্বে রাজনীতির প্রভাব ও ছাত্র রাজনীতি : আধুনিক বিশ্বে রাজনীতি বিশ্বের চালিকা শক্তি হয়ে দাড়িয়েছে। মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে এমনকি শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও রাজনীতি সর্বব্যাপী প্রভাব ফেলেছে। বিশ শতকের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সময় পৃথিবী জুড়ে সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের ভাবাদর্শগত লড়াই বিশ্বকে আলােড়িত করেছে। পাশাপাশি ঔপনিবেশিক দেশগুলােতে চলেছে সাম্রাজ্যবাদী শােষণ, নিপীড়ন এবং তারই পাশাপাশি পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তির জন্যে লড়াই। ফলে ঔপনিবেশিক দেশ ও উন্নয়নশীল দেশগুলােতে সমাজের সচেতন ও সংগ্রামী অংশ হিসেবে ছাত্রসমাজ রাজনৈতিক সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের দেশের ছাত্রসমাজ ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে, শিক্ষা আন্দোলনে, ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলনে এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। রাজনীতিতে ছাত্রসমাজের এ দেশব্রতী ভূমিকাকে তুচ্ছ করে দেখা কি সমভব? আজকের বিশ্বের কেবল যে উন্নয়নশীল দেশের ছাত্ররা রাজনীতিতে অংশ নিচ্ছে তা নয়। ইংল্যাণ্ড, আমেরিকা, ফান্স, জার্মানি ইত্যাদি দেশেও ছাত্ররা রাজনৈতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হচ্ছে। অবশ্য তাদের সাথে আমাদের ছাত্র-রাজনীতির কিছুটা পার্থক্য আছে। ইংল্যান্ড, আমেরিকায় ছাত্রদের রাজনীতিতে মুখ্য স্থান নিয়েছে যুদ্ধবিরােধী মানবতাবাদী ভূমিকা। ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, ইত্যাদি দেশে ছাত্র আন্দোলনে চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে.সমাজ বিপ্লবের ভাবাদর্শ। খুব বেশি দিনের কথা নয়, চীনের ছাত্রসমাজও ফুঁসে উঠেছিল রাজনৈতিক তৎপরতায়। সুতরাং বর্তমান বিশ্বে ছাত্র-রাজনীতি একটা সাধারণ ব্যাপার। 
ছাত্র-রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা : গনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ছাত্র-রাজনীতি শিক্ষা ক্ষেত্রে গণতন্ত্রায়ণের অপরিহার্য অঙ্গ। এ দেশে আঠারাে বছরের বেশি বয়সের তরুণ-তরুণী ভােটাধিকার প্রয়ােগ করতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই ভােটার হিসেবে তারা দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। চুল না ভিজিয়ে যেমন পুরােপুরি গােসল হয় না তেমনি রাজনীতি সচেতন না হয়ে দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ভূমিকা পালন করা যায় না। 
ছাত্র রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল : দুঃখের বিষয় আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সমাজের অগ্রসর অংশ হিসেবে ছাত্রসমাজকেই তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে সর্বাধিক সচেষ্ট। ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে তারা ছাত্রসমাজকে তাদের রাজনৈতিক ভাবাদর্শ কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থের প্রভাব বলয়ের মধ্যে আনার জন্যে ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গ সংগঠনের জন্ম দিয়েছে। ফলে ছাত্রদের এক অংশ ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে, রাজনীতি সচেতন মননশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার পরিবর্তে রাজনৈতিক দলের ক্লীড়নকে পরিণত হয়েছে। এসব দলের নেতৃত্বে ত্যাগী দেশব্রতী রাজনীতিবিদের পরিবর্তে সুবিধাবাদী, , স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি ও লুটেরা ধনীদের প্রাধান্য বেড়ে যাওয়ায় তারা জনগণের মতামতের চেয়ে জবরদস্তিমূলক পন্থায় ক্ষমতা রক্ষা, কিংবা ক্ষমতা দখলে সচেষ্ট হয়। ফলে ছাত্রসমাজ সুস্থ দেশগঠনমূলক আদর্শবাদী রাজনীতির পথ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। নীতিহীন উচ্ছঙখলতা, অনভিপ্রেত অনাচার, পরীক্ষায় দুর্নীতি, জঘন্য অপরাধ প্রবণতা, বিকৃত ও অশ্লীল অপসংস্কৃতির দ্বারা তারা প্রভাবিত হচ্ছে। আমাদের দেশের ক্ষমতাকেন্দ্রিক অস্থির রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব আজ ছাত্রসমাজের মধ্যেও পড়ছে। ফলে ছাত্র রাজনীতিরও বুচিবিকার ঘটছে। 
যােগ্য দিক নির্দেশনায় সংকট : স্বাধীনভাবে দেশব্রতী ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠায় সুস্থ সবল উদ্দীপনাময় দিক নির্দেশনা এখন আর ছাত্রসামজের সামনে নেই। তাদের শিক্ষা কেবল যে কোন পন্থায় পরীক্ষা পাশের ও সার্টিফিকেট প্রাপ্তির শিক্ষায় পর্যবসিত হয়েছে। দায়িত্বের ও আনন্দের কাজে, দেশগঠন ও সমাজসেবার দেশপ্রেমিক কাজে তাদের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা নেই। সাংস্কৃতিক চর্চা, গ্রন্থাগার কার্যক্রম, খেলাধুলা, শিক্ষা সফর, নির্মল আনন্দ বিনােদন ইত্যাদিতে তাদের পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানাে হচ্ছে না। এগুলাের সুযােগ তাদের জীবনে নেই বললেই চলে। বরেণ্য মনীষীদেরকে তাদের সামনে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে না। গণমাধ্যমের বদৌলতে মডেল তারকা, স্থূল নাটকের নায়ক-নায়িকা, কিংবা অস্ত্রবাজ অ্যাকশন হিরােকে তাদের সামনে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এসবের নেতিবাচক প্রভাব তো ছাত্রদের ওপর পড়বেই। 
ছাত্রদের রাজনৈতিক দায়িত্বের সীমা : মনীযী রাজনীতিবিদ বলেছেন, মানুষ মাত্রই রাজনৈতিক জীব। কিন্তু তার মানে এ নয় যে, পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের রাজনৈতিক দায়িত্ব যতটা, অপ্রাপ্তবয়স্কেরও ততটাই। একজন রাজনৈতিক নেতার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যতটুকু, একজন অধ্যাপক ও গবেষকের ততটা কিছুতেই নয়। এদিক থেকে বলা যায় যে, ছাত্রসমাজের সাধারণ রাজনৈতিক দায়িত্ব থাকলেও প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক দায়িত্ব তেমন নেই। অর্থাৎ, তাদের যে রাজনৈতিক সচেতনতা দরকার তা পরােক্ষ সচেতনতা। এ সচেতনতার মূল লক্ষ্য হচ্ছে উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তােলা। সেজন্যে প্রয়ােজন জ্ঞান অর্জন, চরিত্র গঠন, মনুষ্যত্বের সর্বাঙ্গীন উদ্বোধন, দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে পরিচয় সাধন। ছাত্রজীবনে সুস্থ রাজনৈতিক সচেতনতা এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু ছাত্রধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে অসুস্থ, বিকৃত, পঙ্কিল, সংকীর্ণ রাজনৈতিক আবর্তে জড়িয়ে পড়ে অনৈতিক পথে পা বাড়ানাে ছাত্রজীবনে কাম্য হতে পারে না। 
সাধারণ কর্তব্য বা বিশেষ পরিস্থিতির কর্তব্য : সাধারণভাবে ছাত্রদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে নিজেকে মানুষ হিসেবে গড়ে তােলা। এমন ব্যক্তিত্ব গঠন করা যেন ভবিষ্যতে জাতীয় জীবনে সুশীল নাগরিকের দায়িত্ব পালন সম্ভব হয়। সামাজিক-রাজনৈতিক দায়িত্বও তার মধ্যে পড়ে। এ প্রস্তুতি অবশ্যই শিক্ষাসাপেক্ষ। আর ছাত্রজীবনে প্রস্তুতিপর্ব বলে এ সময় প্রত্যক্ষ ও দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ না করাই শ্রেয়। তবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষ কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে এ সাধারণ নিয়ম শিথিল করা যায়। যেমন, কোন যুদ্ধকালীন মুহূর্তে। ছাত্রজীবন প্রত্যক্ষ রাজনীতির চেয়ে যেসব কাজে ছাত্রছাত্রীদের আন্তরিকভাবে অংশ গ্রহণ করা উচিত সেগুলাে হল: দুর্গত ও বিপন্ন মানবতার সেবা, জনসেবা, গ্রামােন্নয়ন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, গরিব ও মেহনতি মানুষকে সহায়তা, জনস্বাস্থ্য রক্ষা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, পরিবেশ সংরক্ষণ, বৃক্ষরােপণ ইত্যাদি। দেশগঠনমূলক এসব কাজের মাধ্যমেই ছাত্রছাত্রীরা মনুষত্বের শিক্ষা অর্জন করতে পারে। তা না হলে শিক্ষা পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। 
উপসংহার : কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : 
'তােমার পতাকা যারে দাও 
তারে বহিবারে দাও শকতি।' 
ভবিষ্যতে আমাদের ছাত্রসমাজ যেন জাতীয় স্বার্থে দেশপ্রেমিকদের মহৎ দায়িত্ব মাথা পেতে নিতে পারে, সেজন্যে শক্তি অর্জন করতে হবে। ছাত্রজীবন সেই শক্তি অর্জনের সময়। এক্ষেত্রে গঠনমূলক রাজনীতি সম্পর্কে সচেতনতা পরিহার্য নয়। কিন্তু জাতীয় জীবনে চরম মুহূর্ত না এলে ছাত্রদের সক্রিয় ও প্রত্যক্ষভাবে দলীয় রাজনীতির আবর্তে জড়িত না হওয়াই ভালাে। দেশের কর্ণধার ও রাজনৈতিক নেতাদের কর্তব্য হবে ছাত্রদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার না করা, দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment