আমাদের দেশীয় খেলাধুলা : আমাদের দেশীয় ভৌগােলিক, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, জলবায়ু প্রভৃতি কারণে প্রাচীনকাল থেকেই বেশ কিছু খেলা গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরের মানুষের মাঝে প্রচলিত রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা এসব খেলার অনেকগুলােই বিদেশি কিছু খেলার প্রভাবে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে চলেছে। যেসমস্ত খেলাধুলা এখনও বিশেষভাবে প্রচলিত রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য খেলাগুলো হলাে- পালাটুটু, লাঠিখেলা, হাডুডু বা কাবাড়ি, গােল্লাছুট, কুস্তি, ডাংগুলি, এক্কা-দুৱা, লুকোচুরি, নােনতা, নৌকাবাইচ, গাদিখেলা, মার্বেলখেলা, দাড়িয়াবান্দা, ঘুড়ি ওড়ানাে, বউচি ইত্যাদি। এছাড়াও প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রচলিত। রয়েছে সাঁতার, পাশা, দাবা, তাস, কেরাম, বাঘবন্দি ইত্যাদি খেলা। আমদের এসব দেশীয় খেলা শিখতে বিশেষ কোনাে ট্রেনিংয়ের প্রয়ােজন হয় না। ঘুড়ি উড়ানাে আমাদের দেশের একটি অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। এ খেলার জন্যে বিশেষভাবে সুরক্ষিত কোনাে মাঠ বা উপকরণের বাহুল্য নেই। এ খেলা ব্যয়বহুল নয় এবং নিয়মকানুনও সহজ-সরল। গ্রামগঞ্জের শিশু- কিশাের-রাখাল বালকরা এ খেলা খেলে থাকে। নিচে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দেশি খেলা সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে।
সাঁতার : বাংলাদেশে নদী-নালা, খাল-বিলের সংখ্যা অসংখ্য। সঙ্গত কারণেই সাঁতার মানুষের জীবনের একটি অঙ্গ। এ সাঁতারও এখন অন্যতম একটি খেলায় পরিণত হয়েছে। গ্রামের এ সাঁতার খেলাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়া না হলেও শহরাঞ্চলে এ খেলা বিশেষ গুরুত্ব পায়। শহরে সুইমিংপুল তৈরি করে সেখানে সাঁতার শেখানাে এবং সাঁতার প্রতিযােগিতার আয়ােজন করা হয়ে থাকে। বিদেশেও এ খেলার বহুল প্রচলন রয়েছে।
ক্যারাম, বাঘবন্দি, দাবা ও তাস : বাংলাদেশের নাতিশীতােষ্ণ আবহাওয়া এদেশের মানুষের স্বাস্থ্য ও স্বভাবে প্রভাব ফেলায় এখানকার মানুষ অলসপ্রকৃতির। মানুষের এ অলস সময় কাটানাের জন্যেও কিছু খেলা রয়েছে। খেলাগুলাে হলাে তাস, দাবা, বাঘবন্দি, ক্যারাম বাের্ড ইত্যাদি। এসব খেলার জন্যে বেশি পরিশ্রম, ছুটোছুটি এবং অনেক জায়গার প্রয়ােজন হয় না। তবে এসব খেলায় বুদ্ধিচর্চা হয়ে থাকে। আগেকার দিনে রাজা-বাদশা এবং অভিজাত শ্রেণিরা এ সমস্ত খেলা খেলত। বর্তমানে দাবা, ক্যারাম খেলার প্রতিযােগিতাও অনুষ্ঠিত হয়।
হাডুডু বা কাবাডি : হাডুডু বাংলাদেশের জাতীয় খেলা। গ্রামাঞ্চলে এ খেলার খুবই প্রচলন রয়েছে। প্রতিযােগিতার মাধ্যমে দুটি দলের মধ্যে এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ খেলাটির উৎপত্তিস্থল ফরিদপুর। বছরের যেকোনাে সময় যে কোনাে স্থানে এ খেলা অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে বর্ষা মৌসুম আগমনের সাথে সাথে এ খেলাটি আরম্ভ হয়। কাদামাটির মধ্যে এ খেলাটি দারুণ উপভােগ্য। এ খেলার কোট তৈরির জন্যে ১২.৫ মিটার লম্বা এবং ১০ মিটার চওড়া জায়গার দরকার হয়। মাঝখানে মধ্যরেখা টেনে কোটকে সমান দু ভাগে ভাগ করা হয়। দুটি দল থাকে, প্রতি দলে ৬ থেকে ৮ জন খেলােয়াড় থাকে। বর্তমানে এ খেলা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
নৌকাবাইচ ও লাঠিখেলা : এ দুটি বাংলাদেশের অন্যতম দেশীয় খেলা। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীপথের অন্যতম যানবাহন নৌকা। এ নৌকা দ্বারাই নৌকাবাইচ খেলা হয়। তবে নৌকাবাইচ খেলার নৌকা বিশেষভাবে তৈরি। এ নৌকাটি লম্বায় সাধারণ নৌকা থেকে বড় এবং বেশি চওড়া হয় না। অনেক লােক থাকে একেকটি নৌকায়। নৌকাবাইচ প্রতিযােগিতা দেখার জন্যে অনেক দর্শক সমাগম হয়। লাঠিখেলা দুই বা তার অধিক সংখ্যক লােকের ভেতরে লাঠি দ্বারা খেলা হয়। খেলাটিতে কৌশলের প্রয়ােজন হয়। এছাড়াও কুস্তি খেলা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ডাংগুলি, গাল্লাছুট, কানামাছি, মার্বেল, নােনতা, গাদিখেলা প্রভৃতি গ্রামের ছেলেমেয়েরা খেলে থাকে।
বিদেশি খেলা : বাংলাদেশের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী কিছু খেলা ছাড়াও বর্তমানে বেশ কিছু বিদেশি খেলা খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। পাশ্চাত্য দেশের সাথে সংযােগের ফলে ইউরােপীয় দেশসমূহের কিছু উল্লেখযােগ্য খেলা বাংলাদেশে সংযােজিত হয়েছে। যেমন- ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, টেনিস, ব্যাডমিন্টন, পােলাে, ওয়াটার পােলাে, হ্যান্ডবল, মুষ্টিযুদ্ধ, ভলিবল, জুডাে, শুটিং ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব খেলা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ খেলে থাকে। ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস, ব্যাডমিন্টন প্রভৃতি খেলা এদেশে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এসব খেলার খেলােয়াড়দের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সফলতা আনার জন্যে ব্যাপক প্রশিক্ষণ ও চর্চা প্রয়ােজন হয়। দেশে এজন্যে স্টেডিয়াম গড়ে উঠেছে। বিদেশ থেকে কোচ এনে খেলােয়াড়দেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখন অন্যতম শক্তিধর একটি দেশ। এছাড়া বাংলাদেশ ক্রিকেটে টেস্ট খেলার মর্যাদাও লাভ করেছে। এসব খেলায় বাংলাদেশ অনেক সফলতাও এনেছে।
খেলার জগতে বাংলাদেশ : বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশ এখন অন্যতম পরিচিত নাম। বিদেশি খেলাগুলাে আয়ত্তে আনায় বাংলাদেশ অতি সহজে আন্তর্জাতিক খেলাধুলার আসরে যােগদান করতে সক্ষম হয়েছে। খেলাধুলায় কৃতিত্ব অর্জন করছে বাংলার দামাল ছেলেরা। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও সাঁতার, শুটিং, রেস, দাবা ইত্যাদি বিভিন্ন খেলায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করে সফলতা অর্জন করছে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখন জনপ্রিয় একটি নাম। এছাড়া টেস্ট ক্রিকেট মর্যাদা লাভ করায় বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের মর্যাদা আরও বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ফুটবল খেলায় মর্যাদা এখনও অর্জন করতে না পারলেও এ খেলায় বাংলাদেশের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। এছাড়াও সাফ গেমস, এশিয়ান গেমস, অলিম্পিক গেমসের বিভিন্ন খেলায় অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরা অনেক স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করে দেশের জন্যে সুনাম বয়ে এনেছে। বাংলাদেশ স্বাগতিক দেশ হিসেবেও সাফ গেমস, ওয়ানডে ক্রিকেট, টেস্ট ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদি বিভিন্ন খেলার আয়ােজন করে থাকে। এর ফলে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের মর্যাদা উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে কৃতিত্ব অর্জন করায় বাংলাদেশ সরকার কৃতী খেলােয়াড়দের মাঝে পুরস্কারও দিয়ে থাকেন। এভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে খেলাধুলার মাধ্যমে বাংলাদেশের সৌহার্দ্যের সম্পর্ক স্থাপিত হচ্ছে।
উপসংহার : বাংলাদেশ বর্তমানে খেলাধুলার প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্রগতি লাভ করে চলেছে। সাঁতারে ব্রজেন দাস ও মােশাররফ, দাবায় গ্রান্ড মাস্টার নিয়াজ মাের্শেদ, রাণী হামিদ প্রমুখ খেলােয়াড় বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশে আরও অনেক প্রতিভাধর খেলােয়াড় গড়ে উঠছে। যারা দেশের জন্যে বয়ে এনেছে গৌরব। বাংলাদেশের খেলাধুলার মান উন্নত করতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ আরও বাড়াতে হবে। খেলােয়াড়দেরকেও এজন্যে কঠোর সাধনা, অনুশীলন. ও প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে।
Post a Comment