বা গ্রামােন্নয়নই দেশােন্নয়ন
বা শহরের বিকল্প গ্রাম
বা গ্রামােন্নয়ন
বা গ্রামীণ জীবন
বা এসো দেশ গড়ি
বা সুখি জীবন বনাম গ্রাম্য জীবন
বা পল্লি উন্নয়ন।
ভূমিকা : একটি প্রবাদ আছে যে God made of village and man made the town' কথাটির মধ্যে যে সত্য বিদ্যমান, সেটি হল এই যে, গ্রাম বাংলার অধিকাংশ মানুষ অর্থাৎ, অধিবাসীর শতকরা ৮০ জন মানুষ জন্মসূত্রে গ্রামের অধিবাসী, যে গ্রাম সৃষ্টির মূলে রয়েছেন স্বয়ং বিশ্বস্রষ্টা। গ্রামের নদনদী, বিলঝিল, গাছপালা, প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য এসবের নির্মাতা বিশ্ববিধাতা। বাংলাদেশের গ্রামের সংখ্যা প্রায় ৮৫ হাজার। এ গ্রাম নিয়েই সমগ্র বাংলাদেশ, যেখানে প্রায় ১১ কোটি মানুষের বাস। একে অন্যভাবে বলা যায়, ৮৫ হাজার গ্রামের সম্মিলিত নাম বাংলাদেশ। গ্রামে ফিরে যাব কেন : একদিন গ্রাম ছিল নিতান্ত অবহেলিত। সেখানে স্বাস্থ্য ছিল না, শিক্ষা ছিল না কিছুই ছিল না। স্কুল- কলেজ, রাস্তাঘাটের সুযােগ-সুবিধা, সুচিকিৎসার ব্যবস্থা এ সবের বিশেষ বন্দোবস্ত ছিল না। সেখানেও আজ এসুব সুযােগ-সুবিধার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। মানােন্নীত থানার কল্যাণে আজ কেন্দ্রীয় প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ হওয়ার ফলে বহুকালের অবহেলিত গ্রামগুলাে আজ নানা কর্মকাণ্ডে মুখর হয়ে উঠেছে। গ্রাম বাংলায় যেখানে সমস্যার পাহাড় জমে থাকত সেখানে সমস্যাগুলাে চিহ্নিত করে থানার নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে বিভিন্ন বিভাগের কর্মচারীবৃন্দ গ্রামের কাজে নিযুক্ত হয়েছেন। গ্রামগুলােকে সেদিনের সে অবহেলিত গ্রাম নামে আখ্যায়িত করা যাবে না। কাজেই গ্রামে ফিরে গিয়ে কাজ-কর্ম করার ক্ষেত্রে আমার নিজের আকাঙ্ক্ষাও তীব্র হয়ে উঠেছে। অন্যদের বলি , চলাে গ্রামে ফিরে যাই।
গ্রামকেন্দ্রিক প্রশাসন : দেশের প্রশাসনকে জনকল্যাণমুখী করার জন্য বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। আগে প্রশাসন ছিল শহরকেন্দ্রিক, গ্রামের লােকজনকে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে মামলা-মকদ্দমা সব কাজের জন্য শহরে যেতে হতাে। কিন্তু এখন তার প্রয়ােজন নেই। মামলা-মকদ্দমা ও প্রশাসনিক সুযােগ সুবিধার জন্য এখন আর গ্রামবাসীকে গ্রাম ছেড়ে যেতে হয় না। এখন সব কিছুর ব্যবস্থা গ্রামেই করা হয়েছে। এখন গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী আছে, যুবসংস্থা আছে, আছে পশুপালন অফিসার, মৎস্যপালন, সমাজ উন্নয়ন, জনসংখ্যা, রেভিনিউ প্রভৃতি বিষয়ক অফিসারবৃন্দ, ম্যাজিস্ট্রেট আছেন, আছেন মুন্সেফ এবং তাদের আওতাধীন দপ্তর ও কর্মচারীবৃন্দ। কাজেই এখন শহরের লােকজন ইচ্ছে করলেই গ্রামে ফিরে গিয়ে বাড়িঘর তৈরি করে সুখে বাস করতে পারেন।
গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা : বর্তমানের নানা সুযােগ-সুবিধার কথা বাদ দিলেও গ্রামের অতিরিক্ত আকর্ষণ রয়েছে যা অনেকের জন্য খুশির খবর সন্দেহ নেই। গ্রামের আম, কাঁঠাল, জাম, জামরুল এর সমারােহ ছাড়াও সেখানে প্রকৃতি রাণী তার অপার দাক্ষিণের হাত বাড়িয়ে রেখেছেন। তার নদনদীর রূপালী স্রোতধারার বুকে নৌকায় অসংখ্য মাঝির দাঁড় টানা এবং বর্ষার নৌকা বাইচের প্রতিযােগিতায় লােকজনের আনন্দোল্লাসে মাতােয়ারা হওয়া কেবল গ্রামেই সম্ভব। গ্রামে ফুল ফোটে অফুরান অফুরন্ত। বিলে,ঝিলে পদ্ম, শাপলা, শালুকের পাপড়ি দল মেলে। সে পদ্মের লােভে যে কেবল ভ্রমর ভ্রমরী উন্মত্ত হয় তা নয়, সর্বশ্রেণীর ও সর্ববয়সের নরনারী মাত্রই পাগল হয়ে উঠে। এখানে মােটর নেই, ট্রাম নেই, বিমান নেই, বড় বড় ইণ্ডাস্ট্রি ও মিল নেই বটে, তবে প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের সম্ভার এসব জিনিসের অভাবকে ভরে রেখেছে। গ্রামের জলাশয় ও পুকুরগুলাে নানা রংয়ের ও নানা আকৃতির রূপালি মাছে পর্ণ থাকে। সেসব মাছের সৌন্দর্য বাঙালির মন ভরাবেই। গ্রামের আর এক আকর্ষণ এখানকার সারস পাখি। এক কথায় বলা চলে যে, গ্রামভিত্তিক বাংলাদেশে প্রচুর পাখির বাসা। নানা বর্ণের ও নানা আকৃতির পাখি এখানে দেখা যায়। শহরে পাখি কম: গ্রামের এসব বিচিত্র বর্ণের পাখির বিচিত্র নাম দোয়েল, কোয়েল, পাপিয়া, টিয়া, ময়না, বুলবুল, বক, মাছরাঙ্গা, ফিঙে, শালিক, খঞ্জন। এদের কাকলি যে কোন, রসিক মনকে আনন্দে ভরে তুলবে।
অন্যান্য সুযোেগ-সুবিধা : গ্রামে যে সুযােগ-সুবিধা আছে তা শহরে নেই। যেমন সরকারি ব্যবস্থায় হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করর্পোরেশনের মাধ্যমে শতকরা ৭ টাকা হার সুদে বাড়ি তৈরির যে সুযােগ আছে তা শহরে নেই। শহরে সুদের পরিমাণ অনেক বেশি, বাড়ি তৈরির অন্যান্য উপকরণ ও জিনিসের দাম গ্রামের তুলনায় ঢের বেশি। সেকালে গ্রামের কিংবদন্তি প্রচলিত ছিল-
গােলা ভরা ধান
পুকুর ভরা মাছ
গােয়াল ভরা গরু।
এ নিয়েই ছিল সুখী সাধারণ বাঙালি পরিবার। ধান, চাল খাদ্যের যেমন তার অভাব ছিল না, পুকুরের টাটকা মাছ যেমন প্রচুর মিলত, তেমনি বাড়ির গরুর দুধের প্রাচুর্য গ্রামে পারিবারিক জীবনকে সুখময় করে তুলতাে। বলা প্রয়ােজন বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে গ্রামেও এখন কিঞ্চিৎ অভাব-অনটন দেখা যাচ্ছে। সে দিন আবার ফিরে আসুক।
অসুবিধার কারণ বর্ণনা : গ্রামের সুযােগ-সুবিধার কথা ছেড়ে দিলে অনেক কিছু অসুবিধাও দেখা যায়। যেমন পথঘাট অধিকাংশ কাঁচা। কাজেই বৃষ্টিপাত হলে পথঘাট কর্দমাক্ত হয়ে উঠে এবং লোক চলাচল কঠিন হয়ে দাড়ায়। সব গ্রামে এখনও ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রসারিত করা যায় নি; ফলে সেখানে চুরি, ডাকাতি ও রাহাজানি বন্ধ করা কঠিন হয়েছে। তাছাড়া, গ্রামের লােকজনের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকে এবং বংশানুক্রমে সে বিবাদের জের চলে।
উপসংহার : সব রকমের ভালােমন্দ বিবেচনা করে শিক্ষিত ব্যক্তিদের গ্রামে ফিরে যেতে হবে।। শিক্ষিত সমাজ এতদিন অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখতেন বলে গ্রামে বাস করার কথা চিন্তাই করতেন না। কিন্তু আজ দিনের পরিবর্তন ঘটেছে। আজ শ্লোগান হােক ঃ “চলাে গ্রামে ফিরে যাই।”
Post a Comment