SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ

ভূমিকা : আমাদের দেশ বাংলাদেশ। এক সাগর রক্ত পেরিয়ে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এক মানচিত্র পৃথিবীর বুকে স্থান করে নিয়েছে 'বাংলাদেশ নামে। এদেশের সার্বভৌমত্ব অর্জনের জন্যে কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই আন্দোলন ও সংগ্রাম চলে আসছিল। ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যাবে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের শাসন-শােষণের হাত থেকে মুক্তির জন্যে সংগ্রাম করেছে। এদেশের আপামর জনসাধারণ। এ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দখলদারমুক্ত হয়, এদেশের সর্বস্তরের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন সফলতার মুখ দেখে। নদীবিধৌত শস্য-শ্যামলা, সুজলা- সুফলা প্রকৃতির বৈচিত্র্যে ভরা এ বাংলাদেশ একরাশ স্বপ্ন বুকে ধারণ করে বিশ্ব মানচিত্রে নিজের স্থান করে নিয়েছে। এ স্বপ্নের দেশই আমার প্রিয় বাংলাদেশ। 
বাংলাদেশের সৌন্দর্য : 
'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, 
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।' 
আমাদের দেশ স্বপ্নের দেশ, স্বপ্নের রূপসী বাংলা। এদেশের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতি এসেছে এ দেশবাসীকে শাসন করতে। আবার অনেক কবি-সাহিত্যিকের জন্ম হয়েছে দেশের সৌন্দর্যের বন্দনা গান গাইতে। এদেশের নদী-অরণ্য, পাহাড় সবকিছুই সৌন্দর্যের আধার । নদীতে পালতােলা নৌকা চলতে দেখে বিশ্বকবি বলেছেন- 
'অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া, 
দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া।' 
স্বপ্ন এবং বাস্তবতা : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধিকার অর্জিত হওয়ার ফলে এদেশের মানুষ প্রত্যাশা করেছিল একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশের যেখানে অরাজকতা, সন্ত্রাস-দুর্নীতি, ক্ষুধা-দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, কুসংস্কার প্রভৃতি থাকবে না। মৌলিক অধিকার তথা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও দৈনন্দিন জীবনের নিরাপত্তার জন্যে ভাবতে হবে না এমন একটি দেশই ছিল প্রত্যাশিত। প্রত্যাশা ছিল দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে ও অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রত্যাশা কেবল প্রত্যাশার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল। যে প্রত্যাশা নিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা দেশের স্বাধিকার অর্জনের জন্যে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাস্তবে তাঁদের সে প্রত্যাশা ও স্বপ্ন মুখ থুবড়ে - পড়ে। স্বাধীনতার পর থেকেই এদেশে অরাজকতা, ঘুষ-দুর্নীতি, সন্ত্রাস, খুন, ধর্ষণ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষাক্ষেত্রের বৈষম্য, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রম-অবনতি দিন দিন বেড়েই চলেছে। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-রাজনীতির নামে লাইসেন্স পেয়েছে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি। রাজনীতি দিন দিন কলুষিত ও সন্ত্রাস-নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ধনী দিন দিন আরও ধনী হচ্ছে আর গরিব দিন দিন আরও গরিব হচ্ছে। অথচ এমনটি প্রত্যাশিত ছিল না। প্রত্যাশা ছিল একটি স্বাধীন-সার্বভৌম স্বপ্নের দেশ, যেখানে জীবনের নিরাপত্তার জন্যে ভাবতে হবে না, মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। 
শােষণ মুক্তসমাজ প্রতিষ্ঠা : এদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি প্রত্যাশা করি একটি শােষণমুক্ত সুশীল সমাজ। এখানে প্রভাবশালী ও প্রতিপত্তিশালী কিংবা বিত্তবান বলে কোনাে শব্দ থাকবে না। সকলেরই থাকবে সমান অধিকার। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের মধ্য দিয়ে দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়া সকলের দায়িত্ব। সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও সর্বপ্রকারের অরাজকতা দূরীকরণ সরকার থেকে শুরু করে সমাজের নিম্নস্তর পর্যন্ত প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। নিরক্ষরতা, কুসংস্কার দূরীকরণ ও নৈতিক অবক্ষয় রােধে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই প্রতিষ্ঠিত হবে শােষণমুক্ত সমাজ। এমনটিই আমি প্রত্যাশা করি আমার স্বপ্নের বাংলাদেশে। 
মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা : একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের নাগরিক হিসেবে সকলেরই প্রত্যাশা মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা লাভ করা। মৌলিক অধিকার বলতে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতিকে বােঝায়। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণই একটি দেশের প্রধান কর্তব্য। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের সমস্যা দূরীকরণের মধ্য দিয়ে সাধারণ নাগরিকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে। আর এ কাজে সরকার থেকে শুরু করে শিল্পপতি, আমলা, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল নাগরিকরা রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শিক্ষাক্ষেত্রে একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা কমিশন গঠন, কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা, সকলের জন্যে সমান শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করা একান্ত প্রয়ােজন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের কোনাে মিল নেই। এটা মােটেই প্রত্যাশিত নয়। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও আমরা বেশ পিছিয়ে আছি। ২০০৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি ৩৮৬৬ জনের জন্যে মাত্র একজন ডাক্তার রয়েছে। যা প্রয়ােজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। প্রতিবছরই এদেশে অসংখ্য মানুষ চিকিৎসার অভাবে অকালে জীবন হারাচ্ছে। তাই প্রয়ােজন যুগােপযােগী চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রবর্তন ও প্রয়ােগ করা। আর এসব মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারলেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। 
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ : স্বাধীনতার পূর্বে এদেশের জনসংখ্যা ছিল মাত্র সাত কোটি। বর্তমান বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। স্বাধীনতার পর থেকেই এ সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলছে। যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে সে হারে বাড়ছে না আমাদের সম্পদ। জনসংখ্যার এ ক্রমবৃদ্ধির ফলে দিন দিন সংকটের কবলে পড়ছে দেশ ও দেশের জনগণ। দৈনন্দিন জীবনযাপনের সুযােগ-সুবিধা এবং কর্মক্ষেত্রের পরিধি সে হারে বাড়ছে না যে হারে বাড়ছে আমাদের জনসংখ্যা। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং একটি কার্যকর জনসংখ্যা নীতি প্রণয়নের মধ্য দিয়ে জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান করতে হবে। বিভিন্ন কর্মক্ষেত্র গড়ে তুলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে জনসম্পদ ও জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। 
নিরক্ষরতা দূরীকরণ : নিরক্ষরতা যে কোনাে জাতির জীবনে এক ভয়াবহ অভিশাপ। বাংলাদেশের মােট অধিবাসীর অর্ধেকটাই নিরক্ষর। আর দেশের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে এ নিরক্ষরতা সমস্যার কারণে। যদিও পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ ইতােমধ্যে নিরক্ষরতা দূরীকরণে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করেছে এবং তা দূরীকরণে সফল হয়েছে কিন্তু আমরা পিছিয়ে আছি। ২০০৮ সাল নাগাদ সবার জন্যে শিক্ষার যে আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার ঘােষিত হয়েছিল, বাংলাদেশ তার সাথে একীভূত হয়ে সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। বর্তমানে নিরক্ষরতা দূরীকরণ শুধু সরকারি কার্যক্রমেই সীমাবদ্ধ নেই, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রত্যাশা করা যায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়ে খুব  দ্রুতই এদেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণ সম্ভব হবে।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা : বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই নিরক্ষরতা দূরীকরণ সম্ভব হবে। সর্বস্তরের জনসাধারণের দাবি ও প্রত্যাশা ছিল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। দেশের সর্বস্তরের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, জীবনের নিরাপত্তা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা আইনের শাসন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশের সর্বস্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসনের অন্যতম দিক। তাই সুখী সমৃদ্ধ, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা একান্ত প্রয়ােজন । 
বর্তমান রাজনীতির ধারা পরিবর্তন : স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। ফলে রাজনীতির সঠিক লক্ষ্য ও কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য হয়ে পড়েছে। ক্ষমতা দখল। ফলে রাজনীতিতে পেশিশক্তির আধিপত্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। রাজনীতি সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করে দলীয় লেজুড়বৃত্তি ও স্বার্থ অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সন্ত্রাস, দলীয় কোন্দল, হানাহানি, প্রতিহিংসা ও খুনখারাবি বাংলাদেশের রাজনীতির নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আমাদের প্রত্যাশিত ও স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বর্তমান রাজনীতির ধারা পরিবর্তন করা একান্তই জরুরি। রাজনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের মৌলিক চাহিদা, তাদের মতামত ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। যদি তা করা সম্ভব হয় তাহলেই প্রতিষ্ঠিত হবে সােনার দেশ, বাংলাদেশ। 
উপসংহার : বাংলাদেশ আমার স্বপ্নের দেশ। এদেশের জল মাটি মেখে আমার বেড়ে ওঠা। এদেশের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হলেই প্রতিষ্ঠিত হবে বাংলার চৌদ্দ কোটি মানুষের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন। এজন্যে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা অর্জন, সকল প্রকারের দুর্নীতি ও অরাজকতা দূরীকরণ, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ, আইন-শৃঙ্খলার ক্রমােন্নতি, কর্মমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা সম্ভব হলে প্রতিষ্ঠিত হবে স্বাধীন-সার্বভৌম, উন্নত স্বপ্নের দেশ সােনার বাংলাদেশ। আর তখনই প্রতিটি নাগরিকের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে সমন্বয় সাধিত হবে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment