বেকারত্বের বিভিন্ন রূপ: বেকার সমস্যা আমাদের জাতিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে, অক্টোপাসের মতাে আমাদের গ্রাস করতে উদ্যত হচ্ছে। আমাদের যুবসমাজের বেকারত্ব দু ভাবে সমস্যা সৃষ্টি করছে ১, ব্যক্তিগত সমস্যা ও ২. সামাজিক সমস্যা। ব্যক্তিগত ক্ষতির দিক হলাে- বেকারতু ব্যক্তিগত জীবনে হতাশা ও দুৰে বয়ে আনে, বেকাররা নিজেদেরকে অভিশপ্ত মনে করে, পরিবারে শান্তি-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায়, কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে ইত্যাদি। সামাজিক সমস্যাও ব্যক্তিগত সমস্যা থেকেই সৃষ্টি হয়, তবে শিক্ষিত মানুষের বেকারত্বের জন্যে অনেকটাই সমাজ দায়ী। শিক্ষিত বেকার বেকারত্ব নিরসনে নিজেদের জমিতে চাষাবাদ কিংবা মৎস্য চাষে উদ্যোগী হলে আমাদের সংকীর্ণ সমাজ সমালোচনায় পণ্ডমুখ হয়ে ওঠে। ফলে শিক্ষিত বেকার কর্মের অনুসন্ধান পেলেও সামাজিক কারণেই বেকারত্বের অভিশাপে আত্মাহুতি দেয়। বেকারত্বের কারণে তখন সে অবৈধ ও বেআইনি পথে পা বাড়ায়। এভাবে ব্যক্তি কর্মহীন থাকার ফলে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত হয়।
বেকার সমস্যার জটিলতা: বহুল আলােচিত এ বেকার সমস্যাকে জটিল করে তুলেছে কর্মহীন মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত ও শ্রমিক সম্প্রদায়। জনসংখ্যার সিংহভাগ অর্থাৎ কৃষিকাজের সাথে জড়িত মানুষেরা বছরের কিছু সময় কাজ করে এবং বছরের বাকি সময়টুকু অলস জীবনযাপন করে। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেও অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি কর্মহীন হয়ে রয়েছে। শুধু চাকরির মাধ্যমে এ জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বেকার সমস্যা শুধু আমাদের দেশেরই সমস্যা নয়। বিশ্বের প্রায় দেশেই এ সমস্যা কমবেশি বিদ্যমান।
বেকার সমস্যা সৃষ্টির কারণ: বিগত অর্ধশতাব্দীর ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, এ সময়ে আমাদের জনসংখ্যা বেড়েছে ব্যাপকহারে এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তেমন কোনাে উন্নতি সাধিত হয়নি। অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং অর্থনেতিক অসচ্ছলতা বেকার সমস্যাকে দারুণভাবে প্রভাবিত ছে। বেকারত্ব সৃষ্টির উল্লেখযােগ্য কারণগুলাে নিম্নে সংক্ষেপে আলােচনা করা হলাে-
প্রথমত: আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও কৃষিব্যবস্থা খুবই অনুন্নত। দেশের কৃষি ব্যবস্থায় শতকরা ৮৫ জন নাগরিক সরাসরি জড়িত। বছরের নির্দিষ্ট সময় কৃষিকাজে অংশ নেওয়ার পর বাকি সময়ে তাদের অধিকাংশ বেকার হয়ে পড়ে। বিকল্প কাজ না থাকায় তাদেরকে অলস সময় কাটাতে হয়। এ ছাড়া মান্ধাতার আমলের চাষাবাদ পদ্ধতির কারণে কৃষিতে উৎপাদন বাড়ছে না। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষি তেমন কোনাে উল্লেখযােগ্য অবদান রাখতে পারছে না। এ কারণে বেকার সমস্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত: শিল্প-কারখানাতেও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। অনুন্নত শিল্প-কারখানার জন্যে শিল্প-কারখানায় কর্মসংস্থানের তেমন কোনাে ব্যবস্থা হচ্ছে না। অনেক ডিগ্রিধারী শিক্ষিত ব্যক্তিকে তাই কর্মক্ষম হওয়া সত্ত্বেও কর্মহীন হয়ে বসে থাকতে হয়।
তৃতীয়ত: ব্যবসা-বাণিজ্যে বিমুখতাও বেকার সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ। যুগের প্রেক্ষাপটেই ব্যবসা-বাণিজ্যে আত্মনিয়ােগ না করে চাকরির সন্ধানে প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়ায় ডিগ্রিধারী শিক্ষিত যুবকেরা। চাকরির আকাঙ্ক্ষা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে বিমুখতা বেকার সমস্যাকে আরও তীব্রতর করে তুলছে।
চতুর্থত: অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেকার সমস্যাকে আরও তীব্র করে তুলছে। যন্ত্রে সহায়তায় পাঁচ জনের কাজ বর্তমানে একজনকে দিয়েই করাতে পারে বলে শিল্প-কারখানায় দিনদিন কর্মকর্তা-কর্মচারী, শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। ফলে দেশে ক্রমশ বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পঞ্চমত: বর্তমান যুগে কারিগরি জ্ঞানের কোনাে বিকল্প নেই। আমাদের দেশের অধিকাংশ ব্যক্তির কারিগরি জ্ঞান না থাকার কারণে বেকার হয়ে পড়ছে।
বেকার সমস্যার সমাধান: বেকার সমস্যা এতই জটিল যে, এর সমাধান খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য। এটা সমাধানের লক্ষ্যে নিম্নোক্ত ব্যবস্থাগুলাে গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়ছে।
ক. কৃষিব্যবস্থার উন্নয়ন: এদেশের বেশিরভাগ লােক সরাসরি কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু কৃষিব্যবস্থা খুবই অনুন্নত। শিক্ষিত কর্মহীন লােকদের কৃষির প্রতি মনােযােগী করতে হবে। শিক্ষিত যুবকেরা কৃষিকাজে আত্মনিয়ােগ করলে, কৃষিব্যবস্থায় অভূতপূর্ব সাফল্য দেখা দেবে। এজন্যে মান্ধাতার আমলের কৃষি উপকরণের পরিবর্তে আধুনিক কৃষি উপকরণ সরবরাহ করতে হবে। কৃষিব্যবস্থার উন্নতি ঘটলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হবে এবং বেকার সমস্যা হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়।
খ. বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষার প্রচলন: দেশে বেকার সমস্যা সমাধানের জন্যে দ্রুত শিল্পায়নের পদক্ষপ নিতে হবে। এসব শিল্প- কারখানায় কাজের উপযুক্ত জনশক্তি দরকার। তাই কল-কারখানায় শ্রমের উপযােগী করে যুবসমাজকে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে।
গ. কুটিরশিল্পের পুনরুদ্ধার ও ক্ষুদ্রায়তন শিল্পের প্রতিষ্ঠা: দেশের কুটিরশিল্পের হারানাে ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করে ও ক্ষুদ্রায়তন শিল্পের বেকার সমস্যার সমাধান করতে হবে। এতে বেকার সম্প্রদায়ের অর্থ উপার্জনের পথ প্রশস্ত হবে। যুব সম্প্রদায়কে কুটিরশিল্প ও ক্ষুদ্র শিল্প বিষয়ক শিক্ষাদান করতে হবে।
ঘ. চাকরির মােহ ত্যাগ: আমাদের জনগণ একটু শিক্ষিত হলেই চাকরি ছাড়া অন্যকোনাে কাজ করতে চায় না। কায়িক শ্রমকে তারা অপমানজনক আসতে প্রতিষ্ঠা করে মনে করায় বেকার সমস্যার সমাধান হয় না। যুবক সম্প্রদায়কে এ ধরনের মনােভাব ত্যাগ করে ছােট-বড় সব ধরনের কাজে এগিয়ে হবে। কোনাে কাজকে হেয় করা চলবে না। এ ছাড়া শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে।
ঙ. আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা: বেকারত্ব নিরসনে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকার স্বাবলম্বী হবার সুযােগ খুঁজে পাবে। এজন্যে সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বেকার ও শিক্ষিত বেকারদের কৃষি, কারিগরি, মৎস্য চাষের যথাযথ প্রশিক্ষণ দান করে দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করে আত্মকর্মসংস্থানের জন্যে উপযুক্ত করে তৈরি করা যেতে পারে।
উপসংহার: বেকার সমস্যার সমাধান করতে হলে সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ের সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়ােজন। বাংলাদেশে জনসংখ্যা সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করায় বেকার সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করছে। বেকার সমস্যা সমাধানের জন্যে আমাদের শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়কে কানাে কাজকে হেয় না করে সকল কাজে এগিয়ে আসতে হবে এবং গ্রামমুখী হতে হবে। কৃষিকাজের প্রতি মনােযােগী হতে হবে। জনসংখ্যা স্ফীতি রােধ করে এবং কর্মমুখী শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে বেকার সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
Post a Comment