SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোেধ

 ভদ্রতা 
বা সৌজন্যবােধ ও শিষ্টাচার
ভূমিকা: বিদ্যা মানুষের মূল্যবান সম্পদ। কিন্তু শিষ্টাচার অধিকতর মূল্যবান। ভদ্রতা, সৌজন্যবােধ, পরিমার্জিত শ্রদ্ধা প্রদর্শনকারী ব্যক্তি মাত্রই শিষ্টাচারে গুণান্বিত ব্যক্তি বলে বিবেচিত। সে কারণেই বলতে হয় যে, কেবল শিক্ষিত বা বিদ্বান বলেই কোনাে লােক সমাজে সমাদর লাভের যােগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। অর্থাৎ শিষ্টাচারহীন ব্যক্তি যদি নানা বিদ্যায় জ্ঞানভাণ্ডার পূর্ণ করেও থাকে, তথাপি তার সঙ্গ পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। মূলত শিষ্টাচারী লােক সর্বত্রই মহীয়ান। কবি তাই বলেছেন-
'শিষ্টাচার উন্নতির প্রধান সােপান
শিষ্টাচারে মানব হয় মহা মহীয়ান।'
শিষ্টাচার বলতে যা বােঝায়: আত্মীয়-অনাত্মীয়, পরিচিত-অপরিচিত সকলের সঙ্গে প্রীতিপূর্ণ, রুচি-সম্মত ব্যবহারই শিষ্টাচার। শিষ্টাচারে সকলেই মুগ্ধ হয়। শিষ্টাচার বলতে বাইরের মার্জিত ব্যবহারই শুধু নয়, নয় ভদ্রতার সামাজিক রীতি অনুসরণ; এর সঙ্গে যুক্ত আছে সুজনের মহৎ হৃদয়ের গভীর উষ্ণ স্পর্শ। আছে অন্তর-সৌন্দর্যের বিকশিত মহিমা, আছে হৃদয়সমুদ্র মন্থনের অমৃত। 
শিষ্টাচার লাভের উপায়: শিষ্টাচার সভ্যতার অবদান। শিষ্টাচার শিক্ষার জন্যে মানুষের অর্থ ব্যয়ের প্রয়ােজন হয় না বরং এটা অর্জনের জন্যে প্রয়ােজন একনিষ্ঠ সাধনা । ইচ্ছা করলেই যে কেউ যখন তখন শিষ্টাচারী হতে পারে না। শিশুকাল থেকেই একটু একটু করে শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়ার মধ্য দিয়ে মানবশিশু শিষ্টাচারী হয়ে উঠতে পারে । যুগ যুগ ধরে সাধনা করেই মানুষকে শিষ্টাচার অর্জন করতে হয়। সাফল্যময় জীবনের মূলে রয়েছে শিষ্টাচার। আজকের শিশুর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাকে শিষ্টাচারী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। 
শিষ্টাচারের গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা: সমাজজীবনে শিষ্টাচারের গুরুত্ব ও প্রয়ােজন অনেক। শেক্সপিয়রের মতে 'দরিদ্র অথচ সদাচারী এবং ভদ্রজনের কাছে দেশ-বিদেশ থেকে বন্ধুত্ব ও প্রীতির বাণী আসে।An honest man is the noblest work of God.'- পােপের এ কথাটি কোনাে মানুষই অস্বীকার করতে পারবে না। প্রকৃতপক্ষে জীবনের সর্বক্ষেত্রে শিষ্টাচারের প্রয়ােজন। শুধু ব্যক্তি স্বার্থে নয়, জাতীয় স্বার্থেও এর ভূমিকা অনন্য। পৃথিবীর যে কোনাে উন্নত দেশের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, তাদের সকল উন্নতির মূলে রয়েছে শিষ্টাচার। শিষ্টাচার দিয়ে মানুষ অতি সহজে মানুষকে জয় করে যে কোনাে কাজ উদ্ধার করতে পারে। শিষ্টাচার অনুশীলিত মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ সম্পদের ক্রমপুঞ্জিত যােগফল, মানুষের অন্তর সমুদ্র মন্থনজাত দুর্লভ অমৃত ফল। 
শিষ্টাচার লাভে পরিবেশের প্রভাব: শিষ্টাচার আত্মীয়তার চেয়ে কিছু কম এবং সামাজিকতার চেয়ে কিছু বেশি। আত্মীয়তা আন্তরিক, সামাজিকতা আনুষ্ঠানিক। শিষ্টাচার উভয়ের মধ্যে সেতুস্বরূপ। তাই শিষ্টাচার লাভ করার ব্যাপারে পারিপার্শ্বিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শিশুকাল থেকে মানুষ যে পরিবেশে বড় হয় পরবর্তীকালে কাজে-কর্মে, আচার-আচরণে সেই পরিবেশের শিক্ষা-দীক্ষা এবং রীতি-নীতি তার চরিত্রে ফুটে ওঠে। 
ছাত্রজীবনে শিষ্টাচারের স্থান: ছাত্রজীবন ভবিষ্যতের প্রস্তুতিক্ষেত্র। এ সময়টি তার শিষ্টাচার ও সৌজন্য আহরণের যথার্থ কাল। শিষ্টাচারের ছোঁয়াতেই ছাত্র হয় বিনীত ও ভদ্র। নতুন প্রাণ-সম্পদে হয় গৌরবান্বিত। ছাত্রজীবনে যে গুরুজনদের শ্রদ্ধা করতে শেখে না, যার উদ্ধত-অবিনীত ব্যবহারে শিক্ষক বিরক্ত; যার রূঢ় অমার্জিত আচরণে সহ-বন্ধুরা ক্ষুব্ধ-বেদনাহত; পরবর্তী জীবনেও তার একই আচরণের পুনরাবৃত্তি ঘটে। তখন সে হয় অশুভ-শক্তি, অকল্যাণের মূর্ত প্রতীক। হতাশা, ব্যর্থতার তিল তিল দংশন জ্বালায় সে নিজেকে নিঃশেষ করে। আর সমাজের বুকে ছড়িয়ে দিয়ে যায় অমৃতের বদলে গরল। ছাত্রজীবনই মানুষের সুপ্ত সুকুমারবৃত্তি লালনের শুভক্ষণ। শিষ্টাচার তাে তার মনুষ্যত্ব অর্জনেরই সােপান। এরই মধ্যে আছে নিজেকে সুন্দর ও সার্থকতায় পরিপূর্ণ করে তােলার মহাশক্তি। বিনয়ী, ভদ্র ছাত্র শুধু শিক্ষকের স্নেহই কেড়ে নেয় না, সে পায় শিক্ষকের আশীর্বাদ, পায় তাঁর সাহায্য। সৌজন্য ও শিষ্টাচারের অভাব ছাত্রকে অবিনীত, স্বার্থপর, নিষ্ঠুর করে। 
মানবজীবনে শিষ্টাচারের স্থান: জনৈক সাহিত্যিক বলেছেন যে, মানবজীবনের সবচেয়ে বড় গুণ শিষ্টাচার ও সৌজন্যবােধ। মানবজীবনের সার্বিক কল্যাণে শিষ্টাচারের স্থান অতি উচ্চে। পৃথিবীর যে কোনাে মহামানবের উন্নতির মূলে রয়েছে শিষ্টাচার। শিষ্টাচার মানুষকে সমাজের উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করে। সামাজিক জীবনকে করে সর্বাত্মক সুন্দর। আমাদেরকে জীবনের সবক্ষেত্রে শিষ্টাচারী হতে হবে। 
শিষ্টাচারহীনতার বর্তমান চিত্র:  আজ সমাজের নানা ক্ষেত্রেই শিষ্টাচারু-সৌজন্যহীনতার নিষ্ঠুর চিত্র। দিন দিনই মানুষের উচ্ছঙ্খলতা বাড়ছে। বাড়ছে তার সীমাহীন ঔদ্ধত্য। বাংলাদেশের জীবন-দর্শন, সামাজিক আচার-আচরণের শাশ্বত মূল্যবােধ, বিদেশি ভাবধারায় লুষ্ঠিত। জন্ম নিচ্ছে। বিছিন্নতাবােধ। সৃষ্টি হচ্ছে মানুষে মানুষে বিরোধ। বিত্তবানের নির্লজ্জ ঔদ্ধত্য। প্রবলের সীমাহীন অত্যাচার আজ শিষ্টাচার ও সৌজন্য দুর্বলের ভীরুতারই অসহায় প্রকাশমাত্র। মানুষকে অপমান করতে পারলেই বুঝি তৃপ্তি। অবিনয় আজ আর তার লজ্জা নয়। দুব্যবহার, মূর্খতা আর অগৌরবের নয়। দুবাক্য এখন বাচন-অলংকার। শিষ্টাচার ও সৌজন্যবােধের সৌন্দর্য হারিয়ে মানুষ আজ নিঃস্ব, হৃদয়হীন। অন্তরের পুষ্পিত শতদল আজ ছিন্নভিন্ন । আজকের মানুষ হৃদয়-ঐশ্বর্যে স্বর্গ থেকে নির্বাসিত। কিন্তু কেনাে তার জীবনে আজ এ নির্দয় অভিশাপ? কেনাে সে আজ এভাবে নিঃস্ব, দেউলে হয়ে গেল? মানুষ তাে একদিন তপস্যা আর দীর্ঘ অনুশীলনের ফলে অর্জন করেছিল এ শিষ্টাচার ও সৌজন্যবােধ। একদিন তাে সে উপলব্ধি করেছিল এ তার গৌরব-আভরণ। তবু কেননা মানুষ আজ হৃদয়ের ঐশ্বর্য-বঞ্চিত হয়ে এমন আত্মকেন্দ্রিক, এমন অন্তঃসারশূন্য? মানুষ পুরনাে মূল্যবােধে বিশ্বাস হারালাে, অথচ নতুন প্রত্যয়ের জন্ম হলাে না। জাতির জীবনে এ যেন এক সর্বনাশা ঝড়ের সংকেত‌। 
প্রতিকারের উপায়: আজ দিকে দিকে যখন সামাজিক অসাম্য, ধনবানের উদ্ধত আচরণ, বিচারের বাণী নীরবে-নিভূতে কাঁদে, নির্লজ্জ অশালীন ব্যবহারে মানুষ কুষ্ঠিত নয়, তখন তা সমাজের এক অন্তঃসারশূন্যতারই করুণ চিত্র তুলে ধরে। আজ যদি জাতিকে নতুন প্রাণস্পন্দনে অনুপ্রাণিত করতে হয়, যদি জাতিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, তবে নতুন করে প্রয়ােজন সৌজন্য ও শিষ্টাচারের উদ্বোধন। গ্রহণ করতে হবে এ দুর্লভ চারিত্রিক ঐশ্বর্য আয়ত্তের শিক্ষাসূচি। গৃহ-পরিবেশ, স্কুল-কলেজ, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এগুলোই হলো তার যথার্থ ক্ষেত্র। এখান থেকেই মানুষ ভবিষ্যৎ জীবনের পাঠ নেবে। এর অনুশীলনই তাকে নম্র, সুন্দর করবে। সমাজ অমার্জিত, শিষ্টাচারহীনতার কলঙ্ক থেকে বাঁচবে। 
উপসংহার: প্রবাদ আছে যে, কোনাে কোনাে বিষধর সর্পের মস্তকে মণি থাকে। মণি মূল্যবান পদার্থ বটে। কিন্তু তাই বলে যেমন মণি লাভের আশায়  বিষধর সর্পের সাহচর্যে থাকা কোনাে বুদ্ধিমান ব্যক্তির কাজ নয়; সেরূপ মহাপণ্ডিতও যদি শিষ্টাচারহীন হন তবে সেই দুর্জনের কাছে গমন উচিত নয়। অতএব শিষ্টাচারের ব্যাপারে আমাদের সকলকে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে। মূল্যবােধের অবক্ষয়ের এ ক্রান্তিলগ্নে শিষ্টাচার খুবই প্রয়ােজন। মানুষের সবগুণের নির্যাস হলাে শিষ্টাচার, তা কারও একার ব্যাপার নয়। শিষ্টাচার ও সৌজন্যবােধ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সার্থুক হাক মানবসভ্যতা।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment