বা আদর্শ ব্যক্তিত্ব
বা তােমার প্রিয় শিক্ষক
ভূমিকা : জীবনে চলার পথ কুসুমাস্তীর্ন নয়, কণ্টকাকীর্ন। কিন্তু তাকে সহজ, সাবলীল করে তােলার জন্য যারা আমাকে পাঠ দান করে, জ্ঞান বিতরণ করে, চলার পথকে নিষ্কণ্টক করতে অবদান রেখেছেন তারা আমার শিক্ষক, অধ্যাপক এবং পথপ্রদর্শক। । জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশে তাঁরা আমাকে নির্ভুল পথ নির্দেশ দিয়েছেন। আমার স্কুল ও কলেজ জীবন কেটেছে স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে। কাজেই নানা বাধা প্রতিবন্ধক সত্ত্বেও জ্ঞানপিপাসা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা অনন্য, বিচিত্র ও অনুকরণীয়। তারা আমার জীবনে পরশ পাথরের মত। তাঁদের ব্যক্তিত্বের ছোঁয়ায় আমার ভেতরের 'আমিত্ব জেগে উঠেছিল। পরিচয় পর্ব : তিনি প্রথম ও দ্বিতীয় সারির ছাত্রদের পরিচয় নিলেন একে একে। জেলা কমিশনারের ছােট ভাই আমার সহপাঠী। আমারই বয়সী স্যার প্রথম দিন আমাদের পড়ালেন না। তিনি তার বক্তৃতার সূত্রপাত করলেন ছাত্রছাত্রীদের কর্তব্যবােধ সম্বন্ধে আলােচনা করে। বলা দরকার কলেজটিতে কোএডুকেশন চালু ছিল। তাঁর বলার ভজ্গিটা উপদেশেের। ইদানিং ছাত্ররা পড়াশােনা করে না, তারা রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠক হিসেবে কাজ করে, পরীক্ষার সময় নকল করে, যা মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলােতে জ্ঞানচর্চা অবহেলিত, ছেলেমেয়েরা লাইব্রেরীতে পড়ে না। সত্যিকার অর্থে যদি জ্ঞানচর্চা থেকে তারা বিড়ম্বিত হয় তবে উচ্চশিক্ষা লাভ করা আকাশ কুসুমে পরিণত হবে। দেশ আজ স্বাধীন। বিশ্বের মানচিত্রে তার এই যে অবস্থান, কেবল এর ঘােষণা নয়, যথার্থ স্বাধীন নাগরিকরপে ভূমিকা পালন করতে হবে। এভাবে স্যার তার শব্দাবলির উচ্চারণ করে গেলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতাে শনে গেলাম, ভুলে গেলাম স্থান, কাল, পাত্র। যেইমাত্র ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজলাে অমনি আমরা চেতনার রাজ্যে ফিরে এলাম। কলেজ জীবনের সে হলাে শুরু। তারপর একে একে দুটি বছর পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে কলেজ অধ্যাপকরা আমাদের পড়িয়েছেন, তাঁদের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ করেছি। তাদের কাছে জানতে পেরেছি জ্ঞানচর্চার কোন বিকল্প নেই। অনন্য একটি দিন : স্কুলের পরিচিত গণ্ডীর মধ্যে যা ছিল আমার কাছে একেবারে মুখস্থ সে সব পশ্চাতে ফেলে রেখে আমি আজ প্রথম দিন কলেজে ক্লাস করছি। এটা আমার এক নতুন পরিমণ্ডল। স্কুল আর কলেজে কত প্রভদ! যিনি আমার কলেজ জীবনে প্রথম ক্লাসে এসেছিল তিনি বাংলার স্বনামধন্য অধ্যাপক যার বিনম্র কণ্ঠস্বর আমাকে আকৃষ্ট করে, তিনি বিশিষ্ট সাহিত্যিক দেলােয়ার হােসেন। অধ্যাপক দেলােয়ার হােসেন ধীমান সাহিত্যিক, একজন গ্রন্থকার। আগেই জানা ছিল যে, কুলের শাসানি নেই এখানে। এখানে ছাত্রদের পড়াশােনায় কর্মকাণ্ডে পূর্ণ স্বাধীনতা। এ কথা ভাবতেই শরীরে মনে রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। একদিন টেলিভিশনে যার ছবি দেখেছি, কণ্ঠস্বর শুনেছি তিনি আমার কলেজ জীবনের প্রথম শিক্ষক, তিনি ক্লাস নিতে এসেছেন। তিনি ক্লাসে ঢুকেই উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের দিকে একবার চকিতে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। সুষাস্থ্যের অধিকারী, মার্জিত চেহারা ও দোহারা গড়নের এক মহান ব্যক্তিত্ব আমার এ স্যার। তিনি তাঁর বক্তৃতার শুরুতে বললেন, আমার তরণ বন্ধুগণ, তােমাদের অভিনন্দন জানাই কলেজ জীবনের শুরুতে স্বাগত জানাই। এবার আমার চমৎকৃত হওয়ার পালা। কি চমৎকার তার শব্দাবলির নির্ভুল উচ্চারণ! সাথে করে এনেছিলেন রােলকলের রেজিস্ট্রি খাতা। কিন্তু রােলকল করলেন না। কারণ, সবার রােল নম্বর খাতায় তােলা হয় নি তখন অবধি ।
জ্ঞানরাজ্যের দ্বার উদ্ঘাটন : দেলােয়ার হােসেন স্যার কলেজে প্রথম দিন যে জ্ঞানরাজ্যের ঘুমন্ত রাজপুরীতে প্রবেশের দ্বার উন্মােচন করলেন সে থেকে শুরু হয়েছে আমাদের বিচরণ। তিনি বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যের রাজদরবারেও তার বিচরণ অবাধ। বাংলা সাহিত্যের গােড়ার কথা তিনি বললেন একদিন। মধ্যযুগের সাহিত্য সম্বন্ধেও তাঁর বক্তব্য আমাদের উৎসাহিত করে। স্যার একদিন কবি চণ্ডীদাস বিদ্যাপতির বৈষ্ণব পদাবলির কথা শােনালেন। মুসলমান কবি আকরাম খাঁ ও ইসমাইল হােসেন সিরাজীর কথা বললেন। আবার ইংরেজি সাহিত্যের প্রাচীন কবি জিওফেচসারের কথা গল্প করলেন। এসব আপাত দৃষ্টিতে আমাদের জন্য নিরর্থক মনে হতে পারে, কিন্তু না, স্যার আমাদের জন্য বিশেষ করে আমার জন্য জ্ঞানের প্রবাহ সৃষ্টি করেন। দেশ-বিদেশের সাহিত্যের প্রতি তিনি আমার জ্ঞানের পিপাসাকে আরও বাড়িয়ে দেন। সেদিন থেকে কেবল পাঠ্য পুস্তকের পাতায় আমার পাঠপৃহা বন্দী হয়ে রইল না। সৌভাগ্যবশত আমার বাসভবনের লাগােয়া ছিল একটি পাবলিক লাইব্রেরী যেখানে প্রতিদিন বিকেল বেলা ভিজিট করা ও পড়াশােনা করা আমার অভ্যেসে পরিণত হয়ে যায়। লাইব্রেরিতে বিভিন্ন বিষয়ের বইপুস্তক থাকে। কলেজ জীবনে পাঠ্যবইগুলাে ভাল করে পড়তে হবে। বাইরের বইও পড়তে হবে। নচেৎ পরীক্ষায় শীর্ষ স্থান লাভ করা বাতুলতা, তা আমার শিক্ষকের কাছেই জানতে পেরেছি। পরীক্ষার বৈতরণী পার হওয়াই শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য হতে পারে না, যােগ্য নাগরিক হওয়ার লক্ষ্যে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। স্যারের দেয়া উপদেশ নির্দেশের ফলে আমরা ছাত্ররা জ্ঞানচর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠলাম, নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা রক্ষায়ও দিক নির্দেশনা পেলাম। সাম্প্রতিকালে যুবক ও তরুণদের মধ্যে নৈতিকতার যে অবক্ষয় ঘটেছে তার প্রতি তিনি আমাদের বারবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেন। সত্যিকার অর্থে আদর্শ নাগরিক হয়ে উঠার জন্য ভাল ছাত্র হতে হবে এবং এ ভালাে ছাত্র হওয়ার জন্য যেসব মৌলিক ও আকর্ষণীয় শর্তসমূহ আছে তার অধিকারী হওয়ার জন্য তিনি গুরুত্ব আরােপ করেন। কলেজে যে একটি বক্তৃতার মঞ্চ গঠন করা হয় তার পেছনে উপদেশ নির্দেশ স্যারই দিয়েছিলেন। এ মঞ্চ থেকে ছাত্রদের ভবিষ্যতে ভাল বক্তা হবার জন্য যে প্লাটফরম দরকার তার ট্রেনিং এখান থেকেই অর্জিত হয়।
বিশিষ্ট এক ব্যক্তিত্ব : দেলােয়ার হােসেন স্যার ছিলেন আসলেই একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তিনি নিজে কোন ধনাট্য পরিবারের সন্তান ছিলেন না। বই, পুস্তক, কেভাব, সংবাদপত্র এবং শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে যে জ্ঞান আহরণ করেছিলেন তার চেয়ে বেশি কৃতজ্ঞতা তাঁর প্রকৃতির অকৃপণ দাক্ষিণ্যের কাছে। আমাদেরও ব্যক্তিত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে লেখাপড়া চালিয়ে যাবার সাথে সাথে প্রকৃতির দাক্ষিণ্যের উপরও নির্ভর করতে বলতেন। স্যার একবার Leader Exchange Programme এ বিলেত গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি মাস খানেক থেকে সে দেশের লেখাপড়া ও জ্ঞানচর্চার ধারাক্রম প্রত্যক্ষ করেন। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার আলােকে কলেজের শিক্ষার্থীদের আলােকিত করার প্রয়াস পান। তিনি ছাত্রদের সাথে সহজভাবে মেলামেশা করতেন; তারাও তার মধুর ব্যক্তিত্বের ছোঁয়ায় বিকশিত হওয়ার সুযােগ পেত। কেউই তার পর ছিল না। আচার আচরণের যে মধুর বাতাবরণ তৈরি হতাে তা কলেজের ছাত্র শিক্ষিক মহলে তাকে জনপ্রিয় শিক্ষকরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। জনপ্রিয়তা যদি একজন সফল অধ্যাপক হওয়ার মাপকাঠি হয় তাহলে আমাদের স্যার নিঃসন্দেহে ভালাে শিক্ষক, সফল অধ্যাপক। আমার আদশ শিক্ষক, প্রিয় শিক্ষক বললে আমি প্রথমে তাকেই নির্বাচন করব। উত্তরকালে আমি আরও অনেক শিক্ষক অধ্যাপকের কাছে লেখাপড়া করার সুযােগ লাভ করেছি, কিন্তু দেলােয়ার হােসেন স্যারের প্রীতি ও ভালােবাসা, তাঁর স্নেহমমতার স্বাদ আর কোথ" পাইনি। একবার এক ভালাে ছাত্র পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল না করতে পারায় তিনি প্রগাঢ় বেদনা বােধ করেন, এবং ছাত্রটিকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে সান্ত্বনা দেন। পরবর্তীতে সে ছাত্র পরীক্ষায় ও বাস্তব জীবনে সূর্যের আলাের মতাে দীপ্যমান হয়ে ওঠে।
উপসংহার : সব দিক থেকেই এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব আমার স্যার জনাব দেলােয়ার হােসেন। তিনি আমার কালের একজন সেরা মানুষ; শিক্ষকদের মধ্যেও তিনি একজন মহান শিক্ষক। তিনি মার্জিত রুচির মানুষ। সৌজন্য ও আচরণে দেখেছি তাঁর অকৃত্রিমতা এবং মনুষ্যত্ব মহিমায় উদ্ভাসিত যিনি তিনিই আমার সম্মানিত শিক্ষক। আমার অভিভাবক জ্ঞান বিতরণে, কলেজে কর্তব্যবােধ ও নিয়মানুবর্তিতায় যিনি নিবেদিত তিনি শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী সবার কাছে আনন্দোজ্জ্বল দীপ্তিতে সমভাবে প্রতিফলিত হতেন। ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশের নাম স্মরণ রাখবার মত স্মরণশক্তি ছিল তাঁর, যাকে একবার দেখতেন, জানতেন তাকে ভুল করতেন না কোনদিন। ছাত্র শিষ্যকে জ্ঞানচর্চায় সংক্রামিত করতেন, স্নেহমমতার অকৃপণ দাক্ষিণ্য দিয়ে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করতেন। বৃহত্তর জীবনের ডাকে কলেজ ছেড়ে গিয়েছি, ক্রমাগত সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, কিন্তু কলেজের দেলােয়ার হােসেন স্যারের কথা আমার চেতনা থেকে কখনাে মুছে যাবে না। উনি আমার প্রিয় শিক্ষক, আদর্শ অধ্যাপক।
Post a Comment