SkyIsTheLimit
Bookmark

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প রচনা


বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প : সমস্যা ও সম্ভাবনা
বা পর্যটক ও পর্যটন

ভূমিকা : পৃথিবীর অপার সৌন্দর্যের অজানাকে জানা, সুন্দরকে অবলােকন করা, নতুন নতুন আবিষ্কার করা মানুষের অনুসন্ধিৎসু মনের প্রবৃত্তি তাড়না। মূলত এ স্বভাবজাত তাড়না থেকেই মানুষ ঘুরে বেড়ায় পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। আর এখান থেকেই উৎপত্তি হয়েছে পর্যটন শিল্পের ধারণা। এ সম্পর্কে মহানবী (সঃ)-এর একটি হাদিস আছে “তােমরা পৃথিবী ভ্রমণ কর। এখানে মহানবী (সঃ) জ্ঞান অন্বেষণের জন্য পৃথিবী ভ্রমণ করার কথা বলেছেন। তাই মানুষের জ্ঞান, শিক্ষা, সৌন্দর্যের বিকাশের জন্য পর্যটন একান্ত প্রয়ােজন।

পর্যটন : মানুষ স্থায়ীভাবে যেখানে বাস করে, সেখান থেকে অন্য কোন স্থানে বিনােদন, শিক্ষা তথ্যানুসন্ধান, ভ্রমণ কিংবা অন্য কোন কারণে অস্থায়ীভাবে গমনকে পর্যটন বলা হয়। এ ভ্রমণ অনেক কারণে হতে পারে। যেমন সাঃ অবসর কাটানাে ; ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য, পারিবারিক উদ্দেশ্য, সম্মেলন বা মিশনারীর কাজ। আর যিনি উত্ত কারণে স্থানান্তরিত হবেন, তিনিই হলেন পর্যটক।

পর্যটন একটি শিল্প : সুদূর অতীতকালে, খেয়াল কিংবা সখের নেশায় মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করলেও বর্তমান কালে পর্যটন একটি অনন্য শিল্পে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীতে অনেক দেশ রয়েছে যে সব দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একমাত্র পথ হচ্ছে পর্যটন শিল্প। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ পর্যটন শিল্পে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ডের বৈদেশিক মদ্রার্জনের একমাত্র পথ হচ্ছে এ পর্যটন শিল্প। পর্যটন শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে থাইল্যান্ড আজ অনেক উন্নত।

বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা : পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময়ী দেশ। সপ্তম শতাব্দীতে প্রখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ বাংলাদেশে ভ্রমণে এসে আনন্দে উল্লাসিত হয়ে বলেছিলেন, A sleeping beauty emerging from mists and water. অর্থাৎ কুয়াশা এবং পানি থেকে উন্মচিত ঘুমন্ত সৌন্দর্য হিসেবে বর্ণনা করেন। তার সে বর্ণনা সত্য। বাংলাদেশের যে দিকেই তাকানাে যায় সবুজের মেলা পরিলক্ষিত হয়। শহর থেকে আরম্ভ করে গ্রাম-গ্রামান্তর অরণ্যানী সর্বত্রই যে পর্যটনের স্থান। এছাড়াও যে সম্ভাবনাময়ী দিকগুলাে রয়েছে সেগুলাে হল:
ক. পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, বাংলাদেশে।
খ. বাংলাদেশে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বন সুন্দর বন। সুন্দর বনের অভ্যন্তরীণ ছােট ছােট নদী, গাছপালা, হরিণ, জীবজন্তু মানুষকে কাছে টানে। এছাড়াও দেশ জুড়ে রয়েছে অসংখ্য পাহাড়, চা বাগান, যা বিশ্বের অনেক দেশেই নেই। এসব জিনিস সহজেই পর্যটকদেরকে আরাে কাছে টানে।
গ. প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয়। যেমন— পাহাড়পুর, ময়নামতি, মহাস্থানগড় প্রভৃতি স্থান।
ঘ. বাংলাদেশে রয়েছে অসংখ্য ধর্মীয় তীর্থ স্থান, দরগা, এসব পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয়। যেমন, সিলেটের হযরত শাহজালালের মাজার, চট্টগ্রামের রাউজানের মহামুনী বিহার প্রভৃতি। 
ঙ. মাধবকুণ্ডের ঝর্ণাধারা হতে পারে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। 
চ. সিলেটের পামর বেষ্টিত জাফলং পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয়। 
ছ. উপজাতীয় জীবনধারা, সাধারণ মানুষের ধারা এসবও হতে পারে পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ।

বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের সমস্যা : বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উৎকর্ষতা সাধনের রয়েছে অনেক সমস্যা। এ সকল সমস্যা অক্টোপাসের ন্যায় ঘিরে আছে পর্যটন শিল্পকে। নিম্নে তা আলােচনা করা হল: 

১. রাজনৈতিক অস্থিরতা : রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে সবচেয়ে বড় বাধা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তীকাল থেকে আরম্ভ করে অদ্যবধি আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি। হরতাল ভাজ্গচুর সবসময় লেগেই আছে। ফলে, বিদেশী বিনিয়ােগকারীরা যেমন এদেশ বিনিয়ােগ করতে উৎসাহ বােধ করে না তেমনি উৎসাহবােধ করে না বিদেশী পর্যটকরা এদেশ ভ্রমণে। 

২. অবকাঠামােগত দুর্বলতা : পর্যটন শিল্পের অবকাঠামােগত দিক থেকে রয়েছে অনেক দুর্বলতা। এদেশের পরিবহণ ব্যবস্থা মান্দাতার আমলের। তাছাড়া এদেশের যােগাযােগ ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। রাস্তাঘাট সংকীর্ণ, ভঙ্গুর এবং সর্বত্র যানজট। এছাড়াও পর্যাপ্ত হােটেল ও মােটেলের অভাব, অনুন্নত ও অবহেলিত পর্যটন কেন্দ্র, শুল্কমুক্ত বিপণীর অভাব বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায়। 

৩. উন্নত সেবা এবং তথ্যের অভাব : বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশের উন্নত সেবা এবং তথ্যের অনেক অভাব রয়েছে। এখানে দক্ষ, শিক্ষিত এবং মার্জিত জনবলের যেমন অভাব রয়েছে, তেমনি অভাব রয়েছে উন্নত এবং দ্রুত তথ্য প্রাপ্তির। 

৪. সামাজিক সমস্যা : বিদেশী পর্যটকদের সংস্কৃতিকে এদেশের অনেকেই সহজভাবে নিতে পারে না। তাদের প্রতি দুর্ব্যবহার, নেতিবাচক মনােভাব অনেকেই পােষণ করে থাকে। এটা পর্যটন শিল্পের বিকাশে বড় একটি বাধা। 

বিশ্ব ও বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব : পর্যটন শিল্প বিশ্বের এক অন্যতম বৃহৎ শিল্প। বিশ্ব বাণিজ্যের ৫%, বিশ্ব মােট উৎপাদনের ১% এবং প্রতি বছর এ খাতে বিশ্বের ১০০ মিলিয়ন ডলার আয় হয়। সারা বিশ্বের ১১ কোটি মানুষ এ শিল্পে নিয়ােজিত রয়েছে।বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে শুধু সরকারি উদ্যোগই যথেষ্ট নয়, বেসরকারি বিনিয়ােগকারীদেরও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। ১৯৯১ সালে ঘােষিত প্রথম পর্যটন নীতিমালায় পর্যটনকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও আজ অবধি বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উৎকর্ষতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অথচ পর্যটন শিল্প নানান দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন-বেকারত্ব, জাতীয় আয় বৃদ্ধি, সরকারি রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, অপ্রচলিত পণ্য রফতানি, অনুকূল বাণিজ্যিক ভারসাম্য রক্ষা, ভূমি উন্নয়ন সহায়তা, অবকাঠামােগত উন্নয়নে, প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়ন, বৈদেশিক বিনিয়ােগ, আন্তর্জাতিক সম্প্রীতি সৃষ্টি প্রভৃতি ক্ষেত্রে পর্যটন শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। 

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পর্যটন শিল্প : একথা অনস্বীকার্য, বৈদেশিক মুদ্রার্জনে পর্যটন শিল্প এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। থাইল্যান্ড, কাশ্মীর, ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের বহুদেশের বৈদেশিক মুদ্রার্জনের একমাত্র পথ হল পর্যটন শিল্প। পর্যটককে বলা হয় Invisible Export Good” বা “অদৃশ্য রফতানি পণ্য। এ অদৃশ্য পণ্যকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের অনেক দেশ উন্নতির অনেক ধাপ উপরে চলে গেছে। বাংলাদেশে যেখানে রফতানি পণ্য খুবই কম, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের কোন উৎসই যেখানে শক্তিশালা নয় সেক্ষেত্রে পর্যটন শিল্প বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে একটি বিরাট উৎস হতে পারে। আমাদের প্রতিবেশী দেশসমূহ এ সুযােগকে কাজে লাগিয়ে বহুদূর এগিয়ে গেছে। 

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে করণীয় : বাংলাদেশের, সম্ভবনাময়ী পর্যটন শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। সর্বপ্রথম দেশে স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। দেশের যােগাযােগ ব্যবস্থার, উন্নয়নের পাশাপাশি পর্যটকদের জন্য উন্নত পরিবহণের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্ততাদেরও প্রয়ােজনীয় প্রদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়ােগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বেসরকারি বিনিয়ােগ কিংবা বিদেশি বিনিয়ােগ পর্যটন শিল্পের মজবুত ভিত্তি রচনা করতে পারে। এজন্য প্রয়ােজন সরকার এবং রাজনৈতিক দলসমূহের আন্তরিক ভূমিকা। সে সাথে উন্নত অবকাঠামােগত প্রয়ােজনীয় সুযােগ-সুবিধা প্রদান। 

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, আমাদের দেশে পর্যটন শিল্পের উৎকর্ষতা সাধনের মত পর্যাপ্ত সুযােগ রয়েছে। এদেশের অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে। ভৌগােলিক অবস্থান, জলবায়ু, নৈসর্গিক দৃশ্য সবই পর্যটন শিল্পের অনুকূলে। এখন শুধু প্রয়ােজন সুস্থ, স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ এবং দেশপ্রেম। পাশাপাশি বাংলাদেশের সুন্দর, নৈসর্গিক পর্যটনের জন্য আকর্ষণীয় দৃশ্যগুলাে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে। সে সাথে আগমন এবং যাতায়াতের সুযােগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment