আর্সেনিক দূষণ প্রক্রিয়া: আর্সেনিক এমন এক ধরনের পদার্থ যার কোনাে বর্ণ, গন্ধ বা স্বাদ নেই। বিভিন্ন ধাতুর সঙ্গে আর্সেনিক যুক্ত অবস্থায় থাকে এবং অক্সাইড, সালফাইড ও আর্সেনেট ইত্যাদিরূপে প্রকৃতিতে যৌগ অবস্থায় থাকে। মানবদেহে আর্সেনিক আক্রমণের মূল মাধ্যম হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি। ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণ প্রাকৃতিক নিয়মেই হয়ে থাকে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, হাজার হাজার বছর ধরে উচ্চমাত্রার আর্সেনিকযুক্ত নুড়িপাথর, হিমালয় ও অন্যান্য উঁচু পাহাড়-পর্বত থেকে নিচে পতিত হয়ে আর্সেনিক যৌগস্তরের সৃষ্টি হয়। এ স্তর বহুকাল যাবৎ শিলাস্তরে নিরুপদ্রবে ছিল। গত কয়েক দশক যাবৎ উচ্চ ফলনশীল ফসল উৎপাদনের জন্যে হাজার হাজার গভীর নলকূপ বসিয়ে পানি উত্তোলন করাহচ্ছে। ফলে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে আর্সেনিক যৌগস্তর এবং তা পানির সঙ্গে ওপরে উঠে আসছে। প্রবাহিত হচ্ছে নদী-নালায়। আর এ পানি ব্যবহারের ফলেই ছড়িয়ে পড়ছে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া।
বাংলাদেশে আর্সেনিক সমস্যা: বাংলাদেশে আর্সেনিক সমস্যা ক্রমেই উদ্বেগজনকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ক্রমসম্প্রসারণশীল আক্রমণ দেখে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। স্থানীয় সরকার পল্লীউন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং জনম্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ব্রিটিশ সরকার এবং ব্রিটিশ ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের সহযােগিতায় (৯৯-২০০০) আর্সেনিক দূষণের ওপর পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা বাদ দিয়ে সব জেলায় ব্যাপক জরিপ চালিয়েছিল। এতে দেশের ৫৩টি জেলায় নলকূপের পানিতে আর্সেনিক দূষণমাত্রা গ্রহণসীমার উর্ধ্বে পাওয়া গেছে। এছাড়া ঢাকার কমিউনিটি হাসপাতাল জয়দেবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিভাগের সহায়তায় একটি জরিপ চালিয়ে দেখেছে- দেশের ৬৪টি জেলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আর্সেনিক হুমকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশের চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ, গােপালগঞ্জ, মাদারীপুর, সাতক্ষীরা, কুমিল্লা, ফরিদপুর, মেহেরপুর, বাগেরহাট এবং লক্ষ্মীপুর জেলার নলকূপের পানিতে আর্সেনিক দূষণ প্রকট।
পানিতে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা প্রতি লিটারে ০:০৫ মিলিগ্রাম। কিন্তু আমাদের দেশের কোনাে কোনাে জেলার নলকূপের পানিতে ৪০ থেকে ৮০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গোপালগঞ্জ জেলার ৫টি থানার ২৫০টি অগভীর নলকূপের পানি পরীক্ষা করে জন্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (মে-জুন ১৯৯৮)। এসব নলকূপের মধ্যে ৭৫ ভাগ নলকূপে ০১--০৫ এবং ২৫ ভাগ নলকূপে ০১--০৯ মিলিগ্রাম আর্সেনিকের সন্ধান পেয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। এছাড়া ২৫ ভাগ নলকূপে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে ০৪ মিলিগ্রাম বেশি পরিমাণ আর্সেনিক রয়েছে। অগভীর নলকূপগুলাে গভীর নলকূপের পানির তুলনায় বিপজ্জনক মাত্রায় আর্সেনিকযুক্ত, যা পান করে দেশের ব্যাপক জনগােষ্ঠী আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে, দেশের প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি মানুষ আর্সেনিকোসিস নামক রােগে আক্রান্ত।
আর্সেনিক আক্রমণের প্রতিক্রিয়া: শারীরিক বিভিন্ন লক্ষণ থেকে আর্সেনিক দূষণ নির্ণয় করা যায়। আর্সেনিক আক্রান্ত ব্যক্তির দেহের চামড়া খসখসে হয়ে যায়, হাত-পায়ের তালু ফেটে যায়, শরীরে কালাে কালাে দাগ দেখা দেয়। আক্রান্ত ব্যক্তি ক্রমেই দুর্বল হয়ে যায়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে চামড়া ফেটে রক্তক্ষরণও হয়। আর্সেনিক বিষক্রিয়ার প্রভাবে লিভারের বা কিডনির রােগ, নিউমােনিয়া, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি হতে পারে। চূড়ান্ত পর্যায়ে গ্যাংগ্রিন, শ্বাসনালী ও ত্বকে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।
দূষণ প্রতিরােধের উপায়: আর্সেনিক দূষণ যতটা প্রতিরােধক ততটা প্রতিষেধক নয়। কাজেই আক্রান্ত হওয়ার আগেই প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এর জন্যে প্রয়ােজন আর্সেনিকমুক্ত পানি পান করা। আর সে লক্ষ্যে আমাদের করণীয় কাজ হলাে ১. গ্রাম-গঞ্জের সকল নলকূপের পানি পরীক্ষা করে তা চিহ্নিত করা। ২, পানিকে আর্সেনিকমুক্ত করার প্ল্যান্ট নির্মাণ করা। ৩. আর্সেনিক দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করা। ৪. মাঠকর্মীদের মাধ্যমে জনগণকে আর্সেনিকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করে তােলা। বলা বাহুল্য আর্সেনিক সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় প্রচার মাধ্যম অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। গ্রাম-গঞ্জে বিদ্যুৎ সরবরাহ হওয়ায় বেতার যন্ত্র ও টেলিভিশন পৌছে গেছে প্রায় ঘরে ঘরে। প্রচার-মাধ্যমে খাবার পানিকে আর্সেনিক মুক্ত করার সহজলন্ধ উপায় প্রচারের জন্যে অবদান রাখতে পারেন নাট্যকর্মী, চিকিৎসক, শিল্পী ও সচেতন মানুষ।
আর্সেনিক দূষণ মােকাবেলা: বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি সকল পর্যায়ে ইতােমধ্যেই আর্সেনিক দূষণের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতার প্রেক্ষিতে দৃষণ মােকাবেলার জন্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আর্সেনিক কবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, আর্সেনিক দূষণের কারণ নির্ণয় ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন এসব প্রকল্পের আওতাভুক্ত। পানিকে আর্সেনিকমুক্তকরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সেক্ষেত্রে অনেকাংশে সফলতাও লাভ করেছে।
উপসংহার: পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু সেই পানিই এখন মানুষের জীবন-মরণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেশের ৯৭ ভাগ মানুষ নলকূপের পানি পান করে। নলকূপের পানি বিশুদ্ধ বলে বিবেচিত। কিন্তু বর্তমানে সেই নলকূপের পানি খেয়েই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে আর্সেনিক বিষে। কাজেই এর আশু প্রতিকার অত্যন্ত জরুরি।
Post a Comment