বা মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা
ভূমিকা : আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলাভাষায় আমরা কথা বলি। কাজেই আমরা বাঙালি। শৈশবে এ ভাষায় আমাদের প্রথম বাক্য স্ফুতি হয়েছে। এ ভাষায় আমরা মনের ভাব প্রকাশ করতে পেরেছি। এ ভাষা লিখে, পড়ে, বলে আমরা যত আনন্দ লাভ করি অন্য ভাষায় তা সম্ভব নয়। কবি বলেছেন- 'নানান দেশের নানান ভাষা,
বিনা স্বদেশী ভাষা, মেটে কি আশা?'
সত্যিই তাই। নিজস্ব ভাষা ব্যতীত কিছুতেই আশা পূরণ হয় না। প্রত্যেক মানুষের নিকট তার মাতৃভাষা বিশেষ শ্রদ্ধার এবং সম্মানের বস্তু। সুতরাং, মাতৃভাষা সকলের নিকট অপর সব ভাষা অপেক্ষা মধুরতম।
ভাষার সাথে পরিচয় : শৈশবে মাতৃক্রোড় থেকে যে ভাষায় সর্বপ্রথম মানবশিশু কথা বলে সে ভাষার বর্ণের সাথে পরিচিত হওয়া সর্বাগ্রে প্রয়ােজন। অতঃপর সে ভাষাকে ভিত্তি করে তারই মাধ্যমে উচ্চতর শিক্ষায় অগ্রসর হতে হবে। এটি না হয়ে যদি অন্য কোন ভাষার মাধ্যমে কেউ বিদ্যা শিক্ষা লাভ করতে যত্নবান হয় তা হলে তার বিদ্যাশিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মাতৃভাষা সম্পূর্ণরূপে আয়ত্ত না করতে পারলে তার সম্যক জ্ঞানার্জন হবে না এবং অপর ভাষাও তার নিকট একটি দুর্জেয় বিষয় হয়ে রবে। এখানে দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে, কিন্ডার গার্টেন বিদ্যালয়সমূহের শিক্ষাপদ্ধতির কথা। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষাদান কার্য সম্পন্ন হয়ে থাকে। এ দেশের বাংলা ভাষাভাষী বালক-বালিকাগণ কিণ্ডার গার্টেন বিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে বিদ্যাশিক্ষা করে থাকে। এটি আমাদের দেশের অভিভাবকগণের ভ্রান্তিপূর্ণ অনুকরণপ্রিয়তার উদাহরণ। যেসব কচি শিশুর জীবনের প্রথম পদক্ষেপ এরূপ ত্রুটি ও বিচ্যুতির মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়ে থাকে, উত্তরকালে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের মনােবত্তি বিদেশী ভাবাপন্ন হয়ে যাবে। জাতীয় শিক্ষা অপেক্ষা বিজাতীয় শিক্ষা তাদের অন্তরে প্রসার লাভ করে থাকে। নিজের দেশ অপেক্ষা অন্য দেশ এবং অপর ভাষাকে সে আপনার বলে চিন্তা করতে শিখে। এটি অপেক্ষা লজ্জাকর এবং দুঃখজনক ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না।
ভাষার প্রতি উদাসীনতা : মাতৃভাষার প্রতি উদাসীনতা এবং অবহেলা আমাদের জাতীয় জীবনের অপমৃত্যু বলে মনে করতে হবে। আমাদের মাতৃভাষা কখনই দীনহীন নয়। সমগ্র এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বাংলা ভাষা বিশ্ব সাহিত্যে স্থান লাভের গৌরব অর্জন করেছে। এ ভাষার প্রতি যারা অবজ্ঞার ভাব এখনও পােষণ করেন তাঁদের বুদ্ধিহীনতা সত্যই অনুকম্পার যােগ্য।
অন্য ভাষার তুলনায় শ্রেয় : এক শতাব্দীর অধিক কাল হতে এ দেশের মনীষীবৃন্দ বাংলা ভাষার উন্নতিকল্পে লেখনী ধারণ করেছেন। প্যারীচাদ মিত্র, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হতে আরম্ভ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মীর মােশাররফ হােসেন, কাজী নজরুল ইসলাম এ ভাষায় যে অতুলনীয় সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, ভাষাকে সম্পদশালী এবং ঐশ্বর্যশালিনী করেছেন, তা বিদেশী যে কোন সমৃদ্ধশালী ভাষার সাথে প্রতিযােগিতা করতে সমর্থ। এ ভাষায় যে সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে তা প্রতিবেশীর ভাষা সাহিত্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
ভাষার প্রতি মমত্ববােধ : জাতীয় জীবনকে শক্তিশালী করতে হলে, স্বদেশের প্রতি মমত্ববােধ জাগ্রত এবং একতাবদ্ধকে নিবিড়তর করতে হলে,কেবল মাতৃভাষার মাধ্যমেই তা সম্ভবপর। যার নিজের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস নেই, মাতৃভাষাকেও সে মর্যাদা দিতে জানে না। সামান্য লেখাপড়া শিখে আত্মীয়, বন্ধু বান্ধবের কাছে বাংলায় পত্র লিখতে অনেকে লজ্জাবােধ করে। তারা গর্ব করে বলে বাংলায় ভাষা পত্রাদি লেখা তাদের দ্বারা সম্ভব নয়। এ ভাষাতে ঠিকমত সাজিয়ে গুছিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারা যায় না। পক্ষান্তরে, লেখনী ধারণ মাত্র চিন্তাধারা ইংরেজি ভাষায় অবিরাম প্রকাশ করে থাকে। এ মানসিকতা আজকের দিনে শুধু দাস মনােবৃত্তির পরিচায়ক নয়, এটি আত্মদ্রোহ বলে গণ্য। বস্তুতপক্ষে, মাতৃভাষা মানব জীবনের অমৃতসারণ। আজ পৃথিবীর সকল সভ্য দেশে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদীক্ষা, রাষ্ট্র পরিচালনার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। যে কোন দেশ পৃথিবীর অন্যান্য ভাষা শিক্ষা না করা সত্ত্বেও শুধু মাতৃভাষার মাধ্যমে উন্নতির উচ্চ শিখরে আরােহণ করতে পারে। শিল্প, বাণিজ্য, জ্ঞান গরিমা উন্নতির মূলেও আছে এ মাতৃভাষা।
উপসংহার : মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ সম্পর্কে আজ পৃথিবীর মনীষীবৃন্দ একমত। যাদের মনে দেশাত্মবােধ আছে, তারা সবাই মাতৃভাষাকে যথােচিত সম্মান প্রদান করবেন, এটিই কাম্য। এটি না করলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের জাতীয় জীবনের মৃত্যু অনিবার্য।
Post a Comment