বা শহিদ দিবস ও একুশের চেতনা
বা একুশে ফেব্রুয়ারি
ভূমিকা: মনের ভাব প্রকাশের সর্বোক্তৃষ্ট মাধ্যম হলাে ভাষা। মানুষ তার মাতৃভাষার মাধ্যমেই মনের ভাব আদান-প্রদান করে থাকে। মা ও মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। আমরা বাঙালি জাতি, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। ১৯৫২ সালের ২১-এ ফেব্রুয়ারি এ ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে সংগ্রাম করেছিল আপামর বাঙালি। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে প্রাণ হারাতে হয়েছিল সালাম, বরকত, জব্বার, রফিককে। সেদিন ২১শে ফেব্রুয়ারি জাতীয় ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি না পেলেও, অনেক পরে প্রাদেশিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। স্বাধীনতা লাভের পর তৎকালীন সরকার এ দিনটিকে জাতীয় ভাষা দিবস বা শহীদ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বাঙালির রক্তাক্ত একুশ এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ২০০০ সাল থেকে এ দিনটি সারাবিশ্বে ভাষা দিবস হিসেবে একযােগে পালিত হওয়ার সিদ্ধান্ত ইউনেস্কো কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। মাতৃভাষার জন্যে বাঙালি জাতির আত্মদান ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে তা আরও উচ্চতর মর্যাদায় অভিসিক্ত হয়েছে।
মাতৃভাষা দিবসের পটভূমি: ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত মাতৃভাষা প্রশ্নে বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পূর্ব থেকেই বাংলা ভাষাকে লড়াইয়ে নামতে হয় উর্দুর প্রতিপক্ষ হিসেবে। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদই প্রথম বাংলাকে উর্দুর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেন। তিনি বলেন, ভারতে যেমন হিন্দি রাষ্ট্রভাষা হতে যাচ্ছে, পাকিস্তানেও তেমনি উর্দু রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। সঙ্গে সঙ্গে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এসেছিল এবং বাংলার জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দৈনিক আজাদে এক প্রবন্ধে ১০৪৮ বলেন, অধিকাংশ জনসংখ্যার ভাষা হিসেবে বাংলাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। বস্তুত ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেখা যায়, পাকিস্তানের কোনাে অঞ্চলের মানুষেরই মাতৃভাষা উর্দু নয়। প্রথমবার পাকিস্তান জন্মের মাত্র তিন মাসের মধ্যেই ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে করাচি শিক্ষাসম্মেলনে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার একটি প্রস্তাব পাস করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সুদূরপ্রসারী এবং ১৯৪৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রাজপথে তৎকালীন পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ এর বিরুদ্ধে তীব্র বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। অপরদিকে পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর কায়েদে আজম জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন। হলে ঘােষণা দেন যে, "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা'। এর প্রতিবাদে ছাত্র-জনতা রাজপথে ফেটে পড়ে। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ থেকে ১৫ই মার্চ পর্যন্ত লাগাতার সংগ্রামের ফসল হিসেবে পূর্ব বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ছাত্রদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদার প্রশ্নটি মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৫২ সালের ২৬-এ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে খাজা নাজিমউদ্দিনই মুসলিম লীগের এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে আবার ভাষাবিদ্রোহ উস্কে দেন। তিনি বলেন, 'একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এর ফল হয়েছিল ভয়াবহ এবং ধ্বংসাত্মক। সে বছর একুশে ফেব্রুয়ারি বুকের রক্ত দিয়ে ছাত্রসমাজ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতিকে আদায় করে নিয়েছিল। আজ বিস্মিত হতে হয়, সেই ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তৎকালীন বাঙালি মানসের চেতনার পরিপক্কতার কথা ভেবে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন এদেশের স্বাধীনতার অনুপ্রেরণা। সে প্রেরণা আমাদেরকে উপহার দিয়েছে ১৯৭১-এর মহান স্বাধীনতা। বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো যে চেতনায় প্রস্তাবনা পাস করেছে, ১৯৫২ সালে তৎকালীন ভাষাসংগ্রামীরা সেই প্রেরণাকেই আপামর জনতার সামনে তুলে ধরেছিলেন। আর এটা হলাে সকল মাতৃভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতি।
একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও তাৎপর্য: বাঙালির ইতিহাস সরলরৈখিক না হলেও তাদের ইতিহাসে অসংখ্য উজ্জ্বল বাঁকচিহ্ন আছে যা অর্জনের সমৃদ্ধতায় উজ্জ্বল। এমনি একটি বাকচিহ্ন নিঃসন্দেহে ১৭ই নভেম্বর ১৯৯৯। ইউনেস্কোর সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১-এ ফেব্রুয়ারির স্বীকৃতি বাঙালির জন্যে এক উজ্জ্বল বাঁকচিহ্নের সূচক। এক সিদ্ধান্তের দুটো দিক বিশেষভাবে বিবেচ্য- ক. আন্তর্জাতিক খ. আমাদের ক্ষেত্রে দেশীয়। প্রথমত, এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিশ্বের প্রায় ৪ হাজারের ওপর ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ স্বীকৃতি যে শুধু ভাষার স্বীকৃতি নয়; বরং আরও ব্যাপক স্বীকৃতির দ্যোতক সে কথা না বললেও চলে। দ্বিতীয়ত, ২১শে ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলাদেশের বাঙালির সম্পদ। অমর একুশে বাঙালির অব্যয়-অক্ষয় সম্পদ। অমর একুশের মধ্যে নিহিত বাঙালির ভাষাভিত্তিক স্বাতন্ত্রের বীজ। সুতরাং অমর একুশকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালির প্রতীকী বিজয় নির্দেশিত হয়েছে। ভাষা-শহিদদের আত্মদানে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলেছে। হাজার বছরের বাঙালির জন্যে, তাদের মাতৃভাষা বাংলার জন্যে, অন্য আর কী বড় অর্জন হতে পারে! অমর একুশে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হওয়ার মধ্যে যে প্রতীকী তাৎপর্য তা সাধারণ প্রচলিত প্রতীকী তাৎপর্যের সমার্থক নয়। ইউনেস্কোর সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অমর একুশে এখন বিশ্ব তাৎপর্যমণ্ডিত প্রতীক- যা বাঙালির গর্ব আর অহংকারের দ্যোতক। একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ বাঙালি জাতির জন্যে এক বিরাট গৌরব। সারাবিশ্বের মানুষ বাংলাদেশ নামে একটি দেশের কথা, বাঙালি জাতি ও তাদের ভাষার কথা জানতে পারবে। ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এক বিরাট ভূমিকা পালন করবে। এ দিবসের তাৎপর্য উল্লেখ করে বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদ বলেন-
'আমি মুগ্ধ, আমি প্রীত আমাকে
স্বীকৃতি দিয়েছে, আমার প্রাণের
কথা আমার ভাষায় জানতে পারব
বলে আমার হৃদয় স্পন্দন বেড়েছে,
সত্যি গর্বিত আমি।'
মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা: ইউনেস্কো ২০০০ সাল থেকে বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিয়ে সদস্য দেশগুলাের কাছে মাতৃভাষা দিবসের তারিখ নির্ণয়ের সুপারিশ চেয়ে আহ্বান করে। অন্যান্য দেশের মতাে বাংলাদেশও দিবসটি পালনের তাৎপর্য জাতিসংঘে উপস্থাপন করে এবং ভাষার জন্যে সবচেয়ে গৌরবজনক তারিখটি উল্লেখ করে। ভাষার জন্যে জীবন দিয়েছে, যুদ্ধ করেছে একমাত্র বাঙালিরা। এ রক্তদান, কারণেই বাংলাদেশের প্রস্তাবিত তারিখটিকেই জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়। বাংলা ভাষাকে অবহেলা করা চলে না। ভাষাভাষীর দিক দিয়ে বাংলা পৃথিবীর পঞ্চম প্রধান ভাষা। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের দেশ হলেও, তার ভাষা তাকে সম্মানের সুউচ্চ শিখরে পদার্পণে সহায়তা করেছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও বাঙালি জাতির আনন্দ উৎসব: মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়ায় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৯৯৯ সালের ৭ই ডিসেম্বর উৎসবের আয়ােজন করে। ২০০০ সালের ২১-এ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে এ উৎসবটি পালিত হয়। দিনভর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আনন্দ শােভাযাত্রা, আলােচনা, আবৃত্তি, নাচ-গান ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। বিপুল সংখ্যক মানুষ সমবেত হয় এ আনন্দ আয়ােজনে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন ও বাংলাদেশের গুরুত্ব: ২১-এ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে মর্যাদা লাভ করায় আমাদের ভাষা শহিদদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যে সারাদেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ছুটে যায় শহিদ মিনারে। মহান একুশ আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব ভাষা দিবস হিসেবে। বাংলাদেশের বাইরে বৃটেন, আমেরিকা, জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত শহিদ মিনারের অনুরূপ শহিদ মিনার করে ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে থাকে। আজ আমরা গর্ব করে বলতে পারি- বাঙালিরাই একমাত্র জাতি, যারা মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে বুকের রক্ত ঢেলে দিতে দ্বিধা করেনি। বিশ্ববাসী স্বীকৃতি দিয়েছে আমাদের মাতৃভাষাকে। জাতিসংঘের মহাসচিব এ দিবসটি উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বার্তা প্রেরণ করেন। এ দিবসটি পালনের মাধ্যমে বিশ্ববাসী তাদের জাতিসত্তার প্রধান অনুষঙ্গ মাতৃভাষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। যেকোনাে আক্রমণ থেকে মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্যে বিশ্ববাসী আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠবে একুশে ফেব্রুয়ারি' দিনটি তাই মাতৃভাষা রক্ষার প্রতীক হয়ে থাকবে।
ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির সেতুবন্ধন: আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটিকে প্রথমবারের মতাে বিশ্বের প্রায় ১৮৮টি দেশ পালন করেছে। ফলে তারা বাংলাদেশের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হবে। বাংলার বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিকদের সৃষ্টি সম্পর্কে জানবে। বিশ্বের দরবারে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি একটি বিশিষ্ট স্থান লাভ করবে। বিশ্ব জানবে, বাঙালিই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছে। মে দিবসে বিশ্ববাসী যেমন শিকাগাের শ্রমিক আন্দোলনকে স্মরণ করে, তেমনিভাবে বাংলার ভাষাশহিদদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। ফলে আমাদের মাতৃভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতার সঙ্গে বিশ্ববাসীর সেতুবন্ধন তৈরি হবে।
উপসংহার: বিশ শতকের শেষ প্রান্তে এসে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো মাতৃভাষাগুলাের অধিকার এবং একে মর্যাদাপূর্ণভাবে টিকিয়ে রাখতে যে অনন্যসাধারণ সংগ্রামের সূচনা করল, তা সমগ্র বিশ্বের ভাষাপ্রবাহে অসামান্য অবদান রাখবে। কাল থেকে কালান্তরে মাতৃভাষার প্রতি সমগ্র জাতির দায়িত্ব বহুগুণে বেড়ে গেল।
Post a Comment