বা কম্পিউটার ও আধুনিক জীবন
বা কম্পিউটার: বিজ্ঞানের এক বিস্ময়
বা কম্পিউটার: আধুনিক জীবনের বিস্ময়
বা আধুনিক জীবনে কম্পিউটারের গুরুত্ব
বা আধুনিক জীবনে কম্পিউটার শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা
ভূমিকা: শিল্পবিপ্লবের পর থেকে যন্ত্রবিজ্ঞানের জয়যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। বাষ্পশক্তি, বিদ্যুৎশক্তি ও আণবিকশক্তি যন্ত্রবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার নিত্য নতুন দ্বার দিয়েছে খুলে। ফলে অসংখ্য আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষ য্ত্রশক্তিতে হয়েছে দুর্বার শক্তির অধিকারী। যন্ত্র আজ তার হাতের ক্রীড়নক। তার কর্মজীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে অনুগত ভৃত্যের মতাে হুকুম তামিল করতে যে যন্ত্রটি সদা ব্যস্ত, তার নাম কম্পিউটার। কম্পিউটার বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী বিস্ময় ও আধুনিকতম আবিষ্কার। ল্যাটিন শব্দ 'কম্পিউটেয়ার' থেকে কম্পিউটার শব্দটির উদ্ভব।
কম্পিউটারের সংজ্ঞা: কম্পিউটার হলাে এমন একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র যা অগণিত উপাত্ত ও তথ্য গ্রহণ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্লেষণ করে দুত সিদ্ধান্ত দিতে পারে। 'কম্পিউটার শব্দটির বাংলা অর্থ গণকযন্ত্র। এর উৎস ইলেকট্রন। এটি খুবই দ্রুত কাজ করে এবং তা নির্ভরযােগ্য। টাইপ রাইটার, লাইন প্রিন্ট, কার্ড রিভার, কার্ড পাঞ্চিং, ম্যাগনেটিক, টেপ ট্রানজিস্টার, সার্কিট প্রভৃতি সর্বাধিক গণনামূলক ব্যবস্থাই হচ্ছে কম্পিউটার।
উদ্ভাবন ও ক্রমােন্নতি: কম্পিউটার উদ্ভাবনার জনক হিসেবে খ্যাতির অধিকারী হলেন ব্রিটিশ গণিতবিদ চার্লস ব্যাবেজ। তার পরিকল্পিত গণকন্ত্রই পরবর্তীকালে কম্পিউটার নির্মাণের প্রেরণা যুগিয়েছে। ব্যাবেজের গণক্যন্ত্রের পরিকল্পনা ছিল উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। এর প্রায় এক শতাব্দীকাল পরে ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তিবিদ্যার মেলবন্ধনে মানুষের হাতে এল ইলেকট্রনিক গণকযন্ত্র। ব্যাবেজই প্রথম পাঁচটি ভাগে পুরাে আধুনিক কম্পিউটারের গঠনতত্ত্ব আবিষ্কার করেন। এ পাঁচটি অংশ হলাে- ১. স্টোর বা ভাণ্ডার, ২. মিল, ৩. কন্ট্রোল, ৪. ইনপুট ও ৫. আউটপুট। এ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে তিনি উনিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে অ্যানালিটিক্যাইল ইঞ্জিন' ও ‘ডিফারেন ইঞ্জিন' নামে দুটি কম্পিউটার তৈরির চেষ্টা করেন। ধাতব যন্ত্রাংশ দিয়ে তার কম্পিউটার তৈরি হয়েছিল। তিনি এর পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে না পারলেও আজকের ইলেকট্রনিক কম্পিউটারেও তার গঠনরীতিই অনুসৃত হয়। এজন্যে ব্যাবেজকেই আধুনিক কম্পিউটারের জনক বলা হয়। সময়ের সঙ্গে কম্পিউটারের গঠনপ্রণালিতে ক্রমােন্নতি এসেছে। গঠনপ্রণালির এক একটি ধারা অর্থাৎ এক/একটি জেনারেশন পার করে পঞ্চম জেনারেশনের কম্পিউটার ইতােমধ্যে আমরা পেয়েছি। আইবিএম-৬৪০, ইউনিভ্যাক-১, সিস্টেম- ৩৬০, আইসিএ-২৯০০, এডস্যাক-৪৩০০, ক্রে-১, ক্রে-২, ইত্যাদি নতুন নতুন কম্পিউটার আমাদের হাতে পৌঁছেছে।
কম্পিউটার ও তার কার্যকারিতা: কম্পিউটার যেন যন্ত্রমস্তিষ্ক। কম্পিউটারের থাকে তিনটি সুস্পষ্ট অংশ- এক: সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট সিপিইউ, দুই: ইনপুট, তিন: আউটপুট। যেকোনাে সমস্যা সংক্রান্ত সবরকম তথ্য নিয়ে কাজ করে 'সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট। "ইনপুট' তথ্য সংবলিত নির্দেশ প্রদান করে আর 'আউটপুট' প্রকাশ করে গণনা সংবলিত ফল। যে যাবতীয় তথ্য নিয়ে কম্পিউটার কাজ করে তাকে বলে 'প্রােগ্রাম'। কম্পিউটারে তথ্য ও নির্দেশ প্রদানের জন্যে যে বিশেষ ভাষা ব্যবহার করা হয় তাকে বলে 'প্রােগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ'। কম্পিউটারের কার্যকারিতা ও প্রয়ােগক্ষেত্র ব্যাপক। কারণ কম্পিউটারের আছে অতি দ্রুত গণনার শক্তি, বহু তথ্যকে গুছিয়ে মগজে ধরে রাখার ক্ষমতা।
কম্পিউটার ও আধুনিক জীবন: কম্পিউটার আধুনিক যুগের মানুষের পরম নির্ভরশীল বন্ধু। কোটি কোটি সংখ্যার অঙ্ক মিলিয়ে নির্ভুল হিসাব ব্যাংকের ক্যাশিয়ারের হাতে অতি অল্প সময়ে তুলে দিয়ে তাকে নিশ্চিন্ত নির্ভাবনায় ঘরমুখাে করে দিতে পারে কম্পিউটার। কম্পিউটার দ্বারা বড় বড় কল-কারখানার মালিকেরা অফিসে বসে উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে; শ্রমিক নিয়ােগ- বরখাস্ত করছে, লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ করছে। চিকিৎসাক্ষেত্রে রােগ নির্ণয়ে ব্যবহার হয় কম্পিউটার। যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় কৃষি খামারে কম্পিউটারের প্রচলন রয়েছে। রেলওয়ে, এয়ারলাইন্স, ব্যাংক, রিসার্চ সেন্টার, ইনসিওরেন্স প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটারের অপ্রতিহত আধিপত্য। পরীক্ষার ফল প্রকাশ, অপরাধীকে খজে বের করা পুরােনাে মামলার নথিপত্র খুঁজে তথ্য সংগ্রহ করে দেওয়া, বিজ্ঞাপন প্রচার করা- এ সমস্তই এখন করছে মানুষের সৃষ্ট ঐ যন্ত্র-মগজ। কম্পিউটার চালিত স্ক্যানার' খুঁজে এনেছিল আটলান্টিক মহাসাগরে ভেঙে পড়া বিমানের 'র্ল্যাকবক্স'। যেসব দুরূহ কাজ মানুষের অসাধ্য, যেসব দুর্গম স্থান মানুষের নাগালের বাইরে- সেখানেই কম্পিউটারের প্রয়ােগ, আর সেখানে তার সাফল্য অকল্পনীয়। আধুনিক জীবনে কম্পিউটার তাই অপরিহার্য। এ ছাড়া যােগাযােগের ক্ষেত্রেও কম্পিউটার এনেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। ই-মেইল, অনলাইন, চ্যাটিং, ফেইসবুক প্রভৃতির মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ খুব সহজেই একে অন্যের খোঁজখবর নিতে পারছে। বাংলাদেশেও কম্পিউটারের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এদেশে এখন মুদ্রণ শিল্প, ব্যাংক-অফিস এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ।
কম্পিউটার ও বেকারত্ব: কম্পিউটার বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় এ যন্ত্রদানবের ক্ষমতা এখন অপরিসীম। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, মানুষের সৃষ্ট এ যন্ত্রদানবকে দিয়ে কাজ করাতে করাতে এমন এক সময় আসবে, যখন কাজের ক্ষুধায় উন্মত্ত দানব তার স্রষ্টা মানুষকেই করবে ক্লীতদাস। কথাটাকে একটু ঘুরিয়ে দেখলেই বাস্তব সত্যটা স্পষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। কম্পিউটারের ব্যাপক প্রয়ােগ ও ব্যবহার মানুষকে করবে সাময়িক কর্মহীন। যন্ত্র তখন মানুষের ক্রীড়নক না হয়ে মানুষ হবে যন্ত্রের ক্রীড়নক। মানুষের কাজ কেড়ে নেওয়ায় বেকারের মিছিলে ভরে যাবে দেশ। কম্পিউটারের ব্যবহারে ইতােমধ্যে অফিসে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানে, বিভিন্ন সংস্থায় কর্মীর সংখ্যা উল্লেখযােগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। অবশ্য অপরদিকে কম্পিউটার বহু নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করছে। অপারেটর, প্রােগ্রামার, হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি পদে বহুলােকের কর্মসংস্থানও হচ্ছে। এভাবে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে কম্পিউটার সাময়িকভাবে কর্মহীনতার সৃষ্টি করলেও সামগ্রিকভাবে এটা ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযােগও সৃষ্টি করছে।
উপসংহার: বিজ্ঞানের আশীর্বাদ থেকে মানুষ পিছিয়ে থাকতে পারে না। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলােতে আজ আধুনিক প্রযুক্তবিদ্যার প্রবেশ ও প্রয়ােজনীয়তা অপরিহার্য। কম্পিউটারকে আজ আর ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। অনিবার্যভাবেই তার আগমন ঘটে গেছে সারা দুনিয়ায়। সেক্ষেত্রে আমাদের দেশের বাস্তব অবস্থাকে স্বীকার করেই এর প্রয়ােগক্ষেত্র নির্বাচন করতে হবে। শতাব্দীর এ বিস্ময়কর আবিষ্কারকে কাজে লাগানাের ওপর আমাদের সফলতা ও সার্বিক অগ্রগতি বহুলাংশে নির্ভর করছে।
Post a Comment