মুক্তিযুদ্ধের চেতনা: বাংলাদেশের মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধ মানেই এক রক্তাক্ত স্মৃতিময় অধ্যায়। অসংখ্য মায়ের বুক খালি করে বহু তরুণ-তাজা প্রাণের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। মুক্তি-পাগল বাঙালি জাতির কাছে তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস স্বর্ণময় এক গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস, রচিত হয় নি। তবে আমাদের সাহিত্য মুক্তিযুদ্ধকে ও তার চেতনাকে ধারণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে এবং এ প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের কবি-সাহিত্যিকেরা যে ভাষা-চিত্র নির্মাণ করেছেন, তা বিশাল ও ব্যাপক। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচনাসমূহ আমাদের জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত, গৌরবান্বিত, মহিমান্বিত ও দীপান্বিত করেছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হলে একদিকে যেমন এর সঠিক ইতিহাস রচনা করতে হবে, তেমনি শিল্পী-সাহিত্যিকদেরও আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের জাতীয় চেতনাবােধকে সুসংহত-সুদৃঢ় করতে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যকর্মের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যকর্ম : বাংলা সাহিত্যের বিশাল অংশে বিশেষত বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। নয় মাসব্যাপী সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের নানা অনুষঙ্গ-প্রসঙ্গ নিয়ে সাহিত্য রচিত হয়েছে। উল্লেখ্য এসব সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের খণ্ড খণ্ড যে চিত্র নির্মিত হয়েছে তাতে আমাদের জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি সঠিক দিক নির্দেশনাও রয়েছে। কবি ও বিশিষ্ট লেখক হাসান হাফিজুর রহমান সংকলিত ষােলাে খণ্ডে রচিত 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও দলিল মূলত ইতিহাস হলেও এর সাহিত্যমূল্য অনস্বীকার্য। বাংলা কবিতা-উপন্যাসে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে বার বার উচ্চারিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের কথা। কবি আহসান হাবীব স্বাধীনতা কবিতায় স্বাধীনতাকে লাল-নীল-সবুজ রঙে আঁকতে চেয়েছেন বুকের মধ্যে। স্বাধীনতা তুমি' কবিতায় কবি শামসুর রাহমানের অকুষ্ঠ উচ্চারণ -
'স্বাধীনতা তুমি
রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানাে
মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা।'
শামসুর রাহমান আরও লিখেছেন, 'আজকে আমি বলি শুধু/ যুদ্ধ জয়ের কথা,/ যার সুবাদে পেয়ে গেছি/ সাধের স্বাধীনতা।' বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অন্যতম উপাদান। মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত করুণ কাহিনি ও বীরত্বগাথা নিয়ে গল্প-উপন্যাস- নাটক, সংগীত ও কবিতা রচিত হয়েছে অসংখ্য। বাংলাদেশের উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন প্রস্গে মাহবুবুল আলম বলেছেন -
যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের যথেষ্ট প্রতিফলন লক্ষণীয়। স্বাধীনতা-সংগ্রামের পটভূমিতে এখানকার জীবনে যে প্রবল আলােড়ন সৃষ্টি হয়েছিল তা প্রত্যক্ষদর্শী ঔপন্যাসিকগণ উপেক্ষা করতে পারেন নি। তাই এখানকার উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের চিত্রাঙ্কনের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধোত্তর কালের জীবনের রূপায়ণেরও নিদর্শন প্রকাশিত হচ্ছে।
আনােয়ার পাশার 'রাইফেল রােটি আওরাত'; শওকত ওসমানের দুই সৈনিক'; সৈয়দ শামসুল হকের নীল দংশন'; রিজিয়া রহমানের 'রক্তের অক্ষর; সেলিনা হােসেনের 'হাঙর নদী গ্রেনেড'; শিরীন মজিদের 'অপু বিজয় দেখে নি' প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিখ্যাত উপন্যাস। শওকত ওসমানের { জন্ম যদি তব বঙ্গে গল্পগ্রন্থের সবগুলােই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা। নবীন ও প্রবীণ প্রায় সকল কবির কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পাওয়া যায়। জসীমউদ্দীনের দ্গ্রাম'; আহসান হাবীবের মার্চ'; সিকান্দার আবু জাফরের বাঙলা ছাড়াে'; আলাউদ্দিন আল আজাদের মুক্তিযােদ্ধ’; ফজল শাহাবুদ্দীনের বাংলাদেশ একাত্তরে'; মহাদেব সাহার একজন মুক্তিযােদ্ধার ডায়েরী'; আবদুল মান্নান সৈয়দের মুক্তিযুদ্ধ'; হুমায়ুন আজাদের মুক্তিবাহিনীর জন্যে প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিষয়ক উল্লেখযোগ্য কবিতা । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অসংখ্য নাটক রচিত হয়েছে বাংলাদেশের সাহিত্যে। সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়; মমতাজউদ্দীন আহমদের বকুলপুরের স্বাধীনতা', 'সাতঘাটের কানাকড়ি, 'স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'; কল্যাণ মিত্রের 'জল্লাদের দরবারে, একটি জাতির ইতিহাস', ‘মীর জাফর সাবধান'; আবদুল্লাহ আল মামুনের সুবচন নির্বাসনে'; মােরশেদ চৌধুরীর এরা ছিল এধারে প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধ । নিয়ে রচিত উল্লেখযােগ্য নাটক। এছাড়াও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শে-চেতনায় উজ্জীবিত অনেক লেখক-সাহিত্যিকের গ্রন্থের মধ্যে হাসান হাফিজুর রহমানের অব্যক্ত সূর্যোদয়; আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'চিলেকেোঠার সেপাই'; শওকত ওসমানের জাহান্নাম হতে বিদায়', 'নেকড়ে অরণ্য', 'জলাংগী'; সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লােবান'; শামসুর রাহমানের বন্দী শিবির থেকে'; নীলিমা ইব্রাহীমের 'আমি বীরাঙ্গনা বলছি'; জহির রায়হানের 'আরেক ফালুন'; আবদুল গাফফার চৌধুরীর বাংলাদেশ কথা কয়'; বদরুদ্দীন উমরের যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ'; আবদুল হাফিজের 'রক্তাক্ত মানচিত্র'; জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি', 'বুকের ভিতর আগুন'; সৈয়দ আলী আহসানের যখন সময় এলাে'; সেলিনা হােসেনের একাত্তরের ঢাকা', 'যাপিত জীবন'; রাবেয়া খাতুনের 'ফেরারী সূর্য', 'একাত্তরের নিশান; জুবাইদা গুলশান আরার 'বাতাসে বারুদ রক্তে উল্লাস'; শাহরিয়ার কবিরের 'একাত্তরের যিশু'; মামুনুর রশীদের 'জয়জয়ন্তী'; মঈনুল আহসান সাবেরের পাথর সময়; রশীদ হায়দারের পূর্বাপর'; দাউদ হায়দারের 'রাজপুত্র'; মঞ্জু সরকারের 'যুদ্ধে যাবার সময়'; হুমায়ূন আহমেদের 'আগুনের পরশমণি, শ্যামল ছায়া'; ইমদাদুল হক মিলনের কালাে ঘােড়া' প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এসব সাহিত্যকর্মে যুদ্ধকালীন দীর্ঘ নয় মাসের ভয়াবহতা, পাকিস্তানি সৈন্যদের হিংস্রতা, বর্বরতা প্রভৃতি যেমন চিত্রিত, তেমনি বাঙালির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম, সাহসিকতা সর্বোপরি জাতির চাওয়া-পাওয়ার ইতিকথা অনুপম ভাষা-চিত্রে অংকিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যের প্রয়ােজনীয়তা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় জীবনেতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কবি-সাহিত্যিকগণ যদি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বা মুক্তিযুদ্ধের বিষয়-উপাদান নিয়ে সাহিত্যকর্ম রচনা না করেন, তাহলে আমাদের আগামী প্রজন্ম বাঙালি জাতির গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যাবে। সুতরাং মনে-মননে এবং জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ বিষয়ক সাহিত্যের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য। সাহিত্য যেহেতু মানুষের সুকুমারবৃত্তি গড়ে তােলে, সেহেতু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাহিত্যের গুরুত্ব অপরিসীম
উপসংহার : সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিল্প মানবজীবনে বিশেষত মানুষের মনন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে এবং বিশ্ববাসীর অবগতির জন্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক সাহিত্য রচনায় সাহিত্যিকগণকে আরও অধিকতর সচেতন প্রয়াস গ্রহণ করতে হবে। বাঙালি জাতির আত্মপরিচিতি, অর্জন-প্রত্যাশা সবকিছুই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যে সার্থকভাবে রূপায়িত হয়েছে। এ সাহিত্য আমাদের অস্তিত্বের অংশ হিসেবে বিবেচিত
Post a Comment