ঋতু পরিক্রমায় শরৎ ও হেমন্ত : বাংলার পল্লিপ্রকৃতিকে হাসিয়ে কাদিয়ে সুন্দরী বর্ষা বিদায় গ্রহণ করলে প্রকৃতির রূপের রঙ্গমঞ্চে আসে পরিবর্তন, আসে শরৎ। বর্ষা বিধৌত, মেঘমুক্ত আকাশের সুনীল রূপ-কান্তি দেখেই বােঝা যায় শরৎ এসেছে তার মনােহারিণী অনুভব উদ্দীপক এবং দৃশ্যসংবলিত অস্তিত্ব নিয়ে। শরৎ-এর এ অস্তিত্বে দেখা যায় বর্ষণক্ষান্ত লঘুভার মেঘ অলস-মন্থর ছন্দে নিরুদ্দেশে ভেসে চলেছে। শরতের এ লঘুচালের ভ্রমণ-কার্যক্রমের সমাপ্তি পর্বের রেশ নিয়ে প্রকৃতিতে আসে হেমন্ত। হেমন্ত শরতের মতাে ভ্রমণ তৃষ্ণায় কাতর নয় বরং একটি স্থির, উদাস চরিত্র নিয়ে সে প্রকৃতিতে বৈরাগ্যের আবেশ ছড়িয়ে দেয়। শরতের মতাে তার বর্ণবাহার নেই, আছে সুদূর ব্যাপ্ত বৈরাগ্যের গভীর বিষন্নতা। হেমন্ত মমতাময়ী নারীর এক অনির্বচনীয় কল্যাণী রূপশ্রী নিয়ে আসে। প্রকৃতিতে তার এ মমতার পরিচয় পাওয়া যায় ফসলভরা মাঠের দিকে তাকালে।
শরৎ ও হেমন্তের রূপ : শরতের প্রকৃতি এক মনােহর দৃশ্যসংবলিত প্রকৃতি। সে সময় চারদিকে সবুজের ছড়াছড়ি। ঘন সবুজের স্নিগ্ধরূপে মন তারুণ্যের উচ্ছাসে উদ্বেলিত হয়ে উঠতে চায়। আর এ সবুজের শােভায় সােনালি রােদের দোল দোল খেলা প্রকৃতিকে এক বিস্ময়কর সৌন্দর্যে সাজিয়ে দেয়, এক অনির্বচনীয় অনুভূতির অভিজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে। মেঘমুক্ত আকাশের সুনীল রূপকান্তি, আলােছায়ার লুকোচুরি, শিউলি ফুলের মন উদাস-করা গন্ধ, নদীতীরে কাশফুলের অপূর্ব সমারােহ শরতের প্রকৃতিকে করে তােলে সুষমামণ্ডিত। রুপালি জোছনার অপরূপ রথে চড়ে যেন শারদ লক্ষ্মীর ঘটে মর্ত্যাবরণ। সাথে সাথে চারদিকে সৌন্দর্যের দরজা খুলে যায়, প্রকৃতির রূপ লাবণ্য কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। এসময় আকাশ নির্মেঘ থাকে। রুপালি রং ধরে শরতের রােদুরে। শরতের ভােরে ঘাসের ডগায় গাছের পাতায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুতে সূর্যের আলাে পড়লে শিশির বিন্দুগুলােকে মুক্তোদানার মতাে চিক চিক করতে দেখা যায়। বর্ষায় যে ফসলের বীজ রােপণ করা হয়, হেমন্তে যে ফসল ঘরে তােলা হয়, শরতে সে ফসলের যৌবন প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। কৃষক তাই শরতের মাঠে তার স্বপ্নের বিস্তার দেখে পুলকিত হয়। প্রকৃতিতে শরতের স্থায়িত্ব খুবই কম সময়। শরতের বিদায়ের বার্তা নিয়ে প্রকৃতিতে হেমন্ত আসলে প্রকৃতিও হেমন্তের বৈশিষ্ট্যের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করে। হেমন্ত যেন ধবল কুয়াশায় মুখ ঢেকে এক নিঃসজা সাধনায় মগ্ন থাকে। সেই সাধনা তার ফসল ফলাবার সাধনা। মাঠে মাঠে ধান পাকে। শরতে মাঠে যে ধানের যৌবন ছিল হেমন্তে সে ধান পরিপক্কতা লাভ করে। খেতে-খামারে হেমন্তের রাশি রাশি ভারা ভারা সােনার ধান দুলতে থাকে। হেমন্তের ভূষণ নেই, তার ফুলের বাহার নেই, রূপসজ্জায়ও নেই অফুরন্ত প্রাচুর্য। হেমন্ত মূলত শীতের আগমন-বার্তা বহন করে প্রকৃতিতে আসে। যে কারণে শীতের আমেজ হেমন্তে উপলব্ধি হয়। প্রকৃতিতে শীতের আগমন-সংকেতে এসময় পাতাঝরা শুরু হয়।
ফসলের সমাহার ও উৎসবের আনন্দ : হেমন্তে ফসল কাটার জোয়ার আসে চাষিদের মাঝে। সােনালি ধানের স্তুপ চাষিদের উঠান ভরে তােলে। কাঁচাধানের গন্ধে চাষিদের মন ভরে ওঠে আনন্দে। বৌ-ঝিরা তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে। উঠোনে উঠোনে বৌ-ঝিদের দেখা যায় ধান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে। ধান আর কেবলই ধান হেমন্তের মমতাময়ী অবদান। হেমন্তে চাষিদের ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব শুরু হয়। নতুন ধানের চালের পিঠা-পুলি তৈরির ধুম সৃষ্টি হয় ঘরে ঘরে। আত্মীয়-পরিবার-পরিজন বেষ্টিত হয়ে চাষিরা এ সময় আনন্দে মেতে ওঠে। প্রকৃতিতে পিঠা-পুলির সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে। শিশু-কিশাের, নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই এ উৎসবে সমান উৎসাহে মেতে ওঠে। তাই বলা যায়, হেমন্ত কৃষকদের কাছে পরম কাঙ্ক্ষিত ঋতু
শীতের রিক্ততা : হেমন্তের প্রৌঢ়ত্বের পর আসে জড়তাগ্রস্ত শীতের নির্মম বার্ধক্য। শুষ্ক কাঠিন্য ও রিক্ততার প্রতিমূর্তিরূপে শীতের আবির্ভাব ঘটে। তার হিমশীতল রূপমূর্তির মধ্যে প্রচ্ছন্ন রয়েছে তপস্যার কঠোর আত্মপীড়ন এবং বৈরাগ্যের ধূসর মহিমা। এ সময় ধানকাটা মাঠে কী সীমাহীন শূন্যতা, কী বিশাল কারুণ্য। সর্বত্যাগী শীত তার সর্বস্ব গ্রাস করে আমাদের খামার পূর্ণ করে দিয়ে নীরবে চলে যায়। ত্যাগের এ অপরূপ মহিমায় ভাস্বর। ভােরের কুয়াশার আবরণের আড়ালে শীতে প্রকৃতি বৈরাগ্য ধারণ করলেও বিভিন্ন রকমের শাক-সবজি আর রং-বেরঙের ফুলের শােভায় তার সর্বাঙ্গ নতুন রূপ ধারণ করে। নতুন ফসল, অফুরন্ত শাকসবজি আর খেজুরের রস পেয়ে বাঙালি পৌষ-পার্বণের উৎসবে মেতে ওঠে।
উপসংহার : রূপসী বাংলায় এ রকম বিচিত্র ঋতুচক্র নানা বর্ণ, গন্ধ, গানের সমারােহ নিয়ে নিত্য আবর্তিত হচ্ছে। এক ঋতু যায়, আরেক ঋতু আসে। বাংলাদেশের রূপসাগরে লাগে ঢেউ। এ ঢেউয়ে শরৎ-হেমন্ত ঋতু রচনা করে এক বিশেষ উন্মাদনা, যে উন্মাদনায় যৌবন ও বার্ধক্যের যুগপৎ উপস্থিতি বিদ্যমান। এ দুই বৈচিত্র্যের সমন্বিত রূপ-কান্তি বাংলাদেশের প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে বিশেষ প্রভাব সৃষ্টি করে।
Post a Comment