বা উন্নয়নে ধর্মঘটের প্রতিফলন
বা ধর্মঘটের কুফল ও বাংলাদেশ
ভূমিকা : ধর্মঘট শব্দটি ইংরেজি Strike শব্দের তুল্য। স্ট্রাইক শব্দটিতে একটি দৃঢ় অঙ্গীকার বা প্রত্যয়ের দ্যোতনা আছে। ধর্মঘট শব্দটি এখন আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত। ধর্মঘট কি : সংঘবদ্ধ হয়ে কোন কর্তব্য থেকে বিরত থাকার নাম ধর্মঘট। এ বিরত থাকার কতকগুলা শর্ত থাকে, শর্ত পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘটীরা তাদের কর্তব্য পালনে বিরত থাকে। ধর্মঘটকারীরা কঠোর প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে যতক্ষণ তাদের দাবী আদায় না হবে তারা কাজে যােগদান করবে না। শুধু কাজের বেলায়ই নয়-নানা ক্ষেত্রে ধর্মিঘট হতে পারে। যেমন- স্কুল , কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, দোকানপাট ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বর্তমান ধর্মঘটের প্রচলন অত্যধিক। আমদের দেশে সবচেয়ে বেশি রে ধর্মঘট হয় দাবি দাওয়া আদায়ে ও রাজনৈতিক ব্যাপারে। প্রথমে শ্রমিক শ্রেণী ধর্মঘটের প্রচলন করে। বর্তমানে ধর্মঘটের আওতা বেড়ে গেছে। ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ সকলেই দাবী আদায়ে বা বিক্ষোভ প্রদর্শনে ধর্মঘটের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। তবে শ্রমিক শ্রেণী ধর্মঘটের সময় যেভাবে সংঘবদ্ধ হয় অন্য কেউ সেভাবে হতে পারে না। সেজন্যই দেখা যায় শ্রমিকের ধর্মঘট বহুলাংশে সফলতা লাভ করে।
ধর্মঘটের কারণ : ধর্মঘট কেন করা হয়? তার কারণ নানাবিধ। সমাজে মানুষ যখন বঞ্চিত হয়, অত্যাচারিত হয়, অন্যায়ের শিকার হয় তখন সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ ছাড়া আর উপায় থাকে না। শ্রমিকের রক্ত শােষণ করে ধনীরা অর্থের পাহাড় গড়েছে। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি তারা দেয় না। দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা ধনীক শ্রেণীর হাতে। তারা কলকারখানার মালিক। তাদের স্বার্থের যূপকাষ্ঠে শ্রমিকদের স্বার্থ বলি দেয়া হয়। পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষিত হয়, আর শ্রমিকদের স্বার্থ হয় উপেক্ষিত। পরিশ্রম করে উপযুক্ত মজুরি তারা পায় না। এ অন্যায় অবিচার থেকে শমিক অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠে এবং ন্যায্য পাওনা আদায়ের দাবি উঠে। দাবি আদায় না হলে ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কলকারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়।
ধর্মঘটের প্রকার : ধর্মঘট নানা ধরনের হতে পারে- প্রতীক ধর্মঘট, অনশন গ্রহণ, এক নাগাড়ে বহুদিনের জন্য ধর্মঘট। প্রতীক ধর্মঘট অল্পস্থায়ী। কয়েক ঘণ্টার কর্মবিরতিই প্রতীক ধর্মঘট। এ ধরনের ধর্মঘটের উদ্দেশ্য মালিক পক্ষকে সচেতন করে দেয়া । দাবি পূরণ না হলে দীর্ঘদিনের ধর্মঘটে যাবার সংকেত জ্ঞাপন। অনশন ধর্মঘট মানুষের বিবেককে নাড়া দেবার জন্য করা হয়। মানুষ সাধারণভাবে সংবেদনশীল প্রাণী। কোন বৃহত্তর স্বার্থে যদি কোন লােক বা লােকদল না খেয়ে মরণপণ করে দাবি আদায়ের পন্থা নেয় তাহলে স্বভাবতই মানুষের বিবেক জাগ্রত হয়। কেউ অনশন করে মৃত্যুবরণ করলে তার ফল ভয়াবহ হবে ভেবেই মালিক পক্ষ বা রাজনৈতিক ব্যক্তিরা দাবি মানার কথা বিবেচনা করেন। একনাগাড়ে সে ধর্মঘাট চলে দীর্ঘ সময়ব্যাপী। এমনও দেখা যায় যে, মাসের পর মাস ধর্মঘট লেগে আছে। ধর্মঘটীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে অনেক সময় মালিক পক্ষ ধর্মঘটের অবসান ঘটাতে চেষ্টা করেন। এতে দু'দলের প্রচণ্ড বিক্ষোভ, বাক-বিতণ্ডা ও দাংগা-হাজগামা দেখা দেয়। অনেক সময় হত্যা, লুণ্ঠনও হয়। মালিক পক্ষ লক আউট ঘােষণা করলে কারখানা বন্ধ হয়ে যায় বিপদে পড়ে। বেকার শ্রমিক অভাব ও দারিদ্র্যের পীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। তখন শ্রমিকরা রাজনৈতিক কারণে আজকাল প্রায়ই ধর্মঘট ডাকা হয়। এরূপ ধর্মঘট ডাকা হলে সবকিছু বন্ধ হয়ে থাকে। সাধারণত শহর এলাকাতেই এরূপ ধর্মঘট হয়ে থাকে। যানবাহন চলে না, দোকানপাট বন্ধ থাকে, অফিস, আদালতের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রসমাজের ডাকেও হরতাল বা ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার প্রেক্ষিতে ধর্মঘট ডাকা হয়। তবে ছাত্রদের দাবি দাওয়া শুধু লেখাপড়ার সুযােগ সুবিধার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না। রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রেও তার প্রতিফলন ঘটে।
ধর্মঘটের সুফল : শােষিতের স্বার্থরক্ষার অঙ্গীকার হচ্ছে ধর্মঘট। এর দ্বারা দাবি সম্মানিত হয়। শিল্প বিপ্লবের ফলে সমাজে শ্ৰেণীবৈষম্যের উদ্ভব হয়। ফলে মুষ্টিমের কয়েকজনের হাতে প্রায় সমুদয় সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়। অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ হতভাগ্য শ্রমিক শ্রেণী নিগৃহীত ও বঞ্চিত হয়ে আসছে। ধর্মঘট এ ঘােরতর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ফলে অর্থনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। ধর্মঘট ধনীক শ্রেণীর অর্থ শােষণে বাধা সৃষ্টি করে এবং বৃহত্তর অংশের কল্যাণ সাধনে সমর্থ হয়। ত ছাড়া ধর্মঘট দেশের মানুষকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সচেতন করে তােলে। ফলে দেশের মানুষের মনে নিজের স্বার্থ ও অধিকার সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণার জন্ম দেয়।
কুফল : ধর্মঘট বিশেষ কোন লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করলেও সবসময় কল্যাণ বয়ে আনে না। তুচ্ছ কারণে ধর্মঘট ডাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা পড়ে এবং দেশের সমূহ ক্ষতি হয়। নানা ধরনের জটিলতা ও সমস্যা দেখা দেয়। জনজীবন অচল হয়, জিনিসের দাম বাড়ে, প্রয়ােজনীয় জিনিস হাতের কাছে পাওয়া যায় না এবং শেষ পর্যন্ত চরম বিশৃংখলা দেখা দেয়। কোন দেশের কোমল মতি ছাত্র সমাজ যখন ধর্মঘটের মাধ্যমে পেনসিল কাগজের দাম কমানাের জন্যে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে তখন স্বভাবতই দেশটি উন্নত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন একটি তৃতীয় শ্রেণীর দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। আর অন্যদিকে রাজনীতিবিদদের কৌশলী হাতে পড়ে ধর্মঘট অনেকাংশে হয়েছে অধর্ম, ক্ষতিকর প্রক্রিয়া যার প্রত্যক্ষ ফল বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে এখন বিদ্যমান।
উপসংহার : ধর্মঘট আমাদের দেশে অতি পরিচিত একটি শব্দ। ধর্মঘট চলছে এবং চলবে। যতদিন পুঁজিপতিদের দৌরাত্ম থাকবে, রাজনীতিতে আত্মস্বার্থ থাকবে, অন্যায় নিপীড়ন থাকবে ততদিন ধর্মঘট চলতেই থাকবে। সমাজ বা দেশ থেকে বঞ্চনা, জুলুম, অন্যায় উঠে গেলে তবেই ধর্মঘটের অবসান কল্পনা করা যায়।
Post a Comment