বা বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য
ভূমিকা: অপরূপ রূপময়ী দেশ আমাদের এ বাংলাদেশ। ঋতুতে ঋতুতে তাঁর দিগন্ত জুড়ে রূপের মেলা বসে। আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির প্রেরণায় পৃথিবী তার সূর্য পরিক্রমার পথে অগ্রসর হয়ে চলে। তার সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে চলে ঋতুর পর ঋতুর এক বর্ণাঢ্য শােভাযাত্রা। ঋতুবৈচিত্র্যের এমন অপরূপ প্রকাশ বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও তেমন দেখা যায় না। তাই জীবনানন্দ দাশ বাংলাদেশকে বলেছেন- 'রূপসী বাংলা। প্রতিটি ঋতু এখানে প্রকৃতিকে সাজায় তার অনুপম রূপসজ্জায়; তারপর তার সেই রূপ আবার মুছে দিয়ে বিদায় নেয়। এক ঋতু যায়, আসে অন্য ঋতু।
গ্রীষ্ম: বাংলাদেশের প্রকৃতির রঙ্গশালার প্রথম ঋতু গ্রীষ্ম। ধূধূ রুক্ষ দুই চোখে প্রখর অগ্নিদাহ নিয়ে আবির্ভাব ঘটে এ রুদ্র তাপসের। সর্বত্রই যেন বিস্তৃত মরুভূমির তপ্ত প্রান্তর। সমগ্র জীবজগৎ ও উদ্ভিদ জগতে নেমে আসে এক প্রাণহীন, রসহীন বিবর্ণতার পাণ্ডুর ছায়া। এসময়েই প্রকৃতিকে তােলপাড় করে দিয়ে যায় কালবৈশাখীর ভয়াল ছােবল। তার সেই রুদ্র মূর্তি, সেই ভীষণ রূপ দেখা যায় শুধু বাংলাদেশের আকাশেই। এসময় দুপুরটা দারুণ গরমে মাঝে মাঝে দুঃসহ হয়ে ওঠে, তবে রাত্রিটা ভারি মনােরম। পাকা আমের বৈভব আছে গ্রীষ্মকালে। আছে কালাে জামের নিবিড় প্রাচুর্য।
বর্ষা: বাংলাদেশে বর্ষা আসে মহা সমারােহে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিকাশ ও গরগম্নীর বজধ্বনির অতি ভৈরব হরষে'র মধ্যে সূচিত হয় তার শুভাগমন। আকাশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ঘন কালাে পুঞ্জিভূত মেঘের আনাগােনা দেখা যায়। দিগন্তের ওপার হতে বন্ধনহীন বায়ুপ্রবাহ দুরন্ত বেগে ছুটে আসে, শুরু হয় শীতল ধারাবর্ষণ। শুষ্ক প্রান্তর, মাঠ-জলাশয়, নদীনালা, খালবিলে অনেকদিন পরে জাগে প্রাণের প্রবল উচ্ছ্বাস। প্রকৃতির সব অঙ্গ হতে গ্রাম্মের ধূসর ক্লান্তি মুছে যায়, উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সজল বর্ষার নয়ন-রঞ্জন রূপশ্রী। পুষ্প সৌরভের ঐশ্বর্যে চারদিক কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। রিমঝিম বর্ষা দিনরাত আমাদের কানে যেন সেতার বাজিয়ে চলে। আমাদের মন এসময় হয়ে ওঠে মেঘের সঙ্গী। বর্ষার সংগীত রিমঝিম বাজে, আর দেখতে দেখতে সবুজ হয়ে ওঠে ধরিত্রী। তারপর শেষ বর্ষণের পালাগান গেয়ে পথে পথে কদম্ব কেশরের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলে, বাংলার পল্পি-প্রকৃতিকে হাসিয়ে-কাদিয়ে সুন্দরী বর্ষা বিদায় গ্রহণ করে।
শরৎ: বর্ষার বিদায়ের পর আবার বঙ্গ প্রকৃতির রূপের রঙ্গমঞে ঘটে পট পরিবর্তন। বর্ষণ ক্ষান্ত লঘুভার মেঘ অলস-মন্থর ছন্দে নিরুদ্দেশে ভেসে চলে। বর্ষণ-ধৌত, মেঘমুক্ত আকাশের সুনীল রূপ-কান্তি, আলাে-ছায়ার লুকোচুরি, শিউলি ফুলের মন-উদাস করা গন্ধ, নদী তীরে কাশফুলের অপূর্ব সমারােহ, এ অনুপম রূপশ্রী নিয়ে ঘটে শারদ লক্ষ্মীর আনন্দময় আবির্ভাব। বুপালি জ্যোৎস্নার অপরূপ রথে চড়ে যেন শারদ লক্ষ্মীর ঘটে মর্ত্যাগমন। চারদিকে সৌন্দর্যের দরজা খুলে যায়, বাংলাদেশের রূপ-লাবণ্য যেন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। সােনার রং ধরে শরতের রােদ্দুরে। আসে শারদীয় উৎসব। হিন্দু সম্প্রদায় দুর্গা পূজার আনন্দে মেতে ওঠে।
হেমন্ত: শরতের পরেই আসে হেমন্ত। কিন্তু হেমন্তের নেই শরতের মতাে বর্ণ বাহার, আছে সুদূর ব্যাপ্ত বৈরাগ্যের গভীর বিষণ্নতা। হেমন্ত যেন ধবল কুয়াশার আবরণে মুখ ঢেকে এক নিঃসঙ্গ সাধনায় মগ্ন থাকে। আর সেই সাধনা তার ফসল ফলাবার সাধনা। মাঠে মাঠে ধান পাকে। ক্ষেতে-খামারে হেমন্তের রাশি রাশি ভারা ভারা সােনার ধান উঠতে থাকে। কৃষকের সময় কাটে এক অন্তহীন কর্মব্যস্ততার মধ্যে। হেমন্তের ভূষণ নেই। তার ফুলের বাহার নেই, সৌন্দর্যের জৌলুস নেই, রূপসজ্জারও নেই অফুরন্ত প্রাচুর্য; কিন্তু আছে মমতাময়ী নারীর এক অনির্বচনীয় কল্যাণী বূপশ্রী। নিশির শিশিরে সি্ত হয় সবুজ ঘাস, গুল্মলতা ও বৃক্ষরাজি। রুপালি হেমন্ত মানবমনে বয়ে নিয়ে আসে আনন্দ, তারপর শিশিরের নিঃশব্দ চরণে সেও একদিন নেয় বিদায়।
শীত: হেমন্তের প্রৌড়ত্বের পর আসে জড়তাগ্রস্ত শীতের নির্মম বার্ধক্য। শুষ্ক কাঠিন্য ও রিক্ততার বিষাদময় প্রতিমূর্তিরূপে শীতের আবির্ভাব ঘটে। তার হিমশীতল রূপমূর্তির মধ্যে প্রচ্ছন্ন রয়েছে তপস্যার কঠোর আত্মপীড়ন এবং বৈরাগ্যের ধূসর মহিমা। এ সময়ে ধান কাটা মাঠে কী সীমাহীন শূন্যতা, কী বিশাল কারুণ্য। তারপরও ঘরে ঘরে আনন্দ। কনকনে শীতের তীব্রতায় খেজুর রসের মিষ্টি মধুর আবেশে শিশিরভেজা ভােরের উদীয়মান রবির কিরণ বাড়ির উঠোনকে যখন আলােকিত করে, তখন রােদে পিঠ ফিরিয়ে বাড়ির আঙিনায় পিঠা-পায়েস ও মুড়কি-মােয়ার আনন্দ সবাই আস্বাদন করে শীতের রূপবৈচিত্র্যকে। সর্বত্যাগী শীত তার সর্বস্ব ত্যাগ করে আমাদের পূর্ণ করে দিয়ে নীরবে চলে যায়। ত্যাগের কী অপরূপ মহিমা! এ ত্যাগের অপরূপ মহিমায় তার সর্বাঙ্গ ভাস্বর।
বসন্ত: বসন্তের আবির্ভাবকে সম্ভব করে তুলবার জন্যেই মৌন-তাপস শীতের যেন কঠোর তপস্যা। আসে ঋতুরাজ বসন্ত, আসে পুষ্পমালা বিরচনের লগ্ন। দক্ষিণের মৃদুমন্দ বাতাসের যাদুস্পর্শে শীতের জরাগ্রস্ত পৃথিবীর সর্বাঙ্গে লাগে অপূর্ব শিহরণ। বাতাসের মর্মর ধ্বনির এবং দূর বনান্তরাল থেকে ভেসে আসা কোকিলের কুহু গীতি পৃথিবীতে অনুরাগের প্লাবন ছােটায়। শিমুল কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম উচ্ছাসে, মধু-মালতী ও মাধবী মঞ্জুরীর গন্ধ ও বর্ণের তুমুল কোলাহলে লেগে যায় এক আশ্চর্য মাতামাতি। তার উজ্জ্বল বর্ণ ও গন্ধের আবির্ভাবে শূন্যতার অবসান হয়। অফুরন্ত প্রাণ-বন্যায় মেতে ওঠে মানুষ ও প্রকৃতি। আবার শেষ-বসন্তে তার এ বর্ণ বিলাস, প্রাণ-প্রাচুর্যের জোয়ারে আসে ভাটা। গ্রীষ্মের জন্যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে ঋতুরাজ বসন্ত নেয় বিদায়।
উপসংহার: রূপসী বাংলার এ রকম বিচিত্র ঋতুচক্র নানা বর্ণ-গন্ধ গানের সমারােহ নিয়ে নিত্য আবর্তিত হচ্ছে। এক ঋতু যায়, আসে আরেক ঋতু। বাংলাদেশের রূপসাগরে লাগে ঢেউ। কিন্তু শহরবাসী ও শহরমুখী বাঙালি আজ আর অন্তরে তার নিমন্ত্রণ অনুভব করে না। আজ আমরা প্রকৃতিকে নির্বাসিত করে বরণ করে নিচ্ছি উগ্র নাগরিকতার তপ্ত নিঃশ্বাস। কিন্তু উপেক্ষিত প্রকৃতি একদিন না একদিন হয়তাে এর প্রতিশােধ নিতে চাইবে।
Post a Comment