টেকসই উন্নয়ন কী?: উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা হয়। সকল পন্থায় যে পরিবেশ তথা জীব বৈচিত্র্যকে স্বাভাবিক রাখার কথা ভাবা হয় তা কিন্তু নয়। আর এ ভাবনাকে ধারণ করে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণে উদ্ভাবিত একটি নতুন কৌশল । এ প্রক্রিয়ার নামই হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন। যেখানে উন্নয়নও হবে আবার পরিবেশও ঠিক থাকবে এমন একটি প্রক্রিয়া হলাে টেকসই উন্নয়ন। টেকসই উন্নয়ন হলাে পরিবেশকে ভিত্তি করে সংগঠিত আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ছাড়া বিশ্বের উন্নয়ন সম্ভব নয়। পরিবেশকে অবিবেচ্য রেখেও পৃথিবীর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। দুইয়ের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সাথে পরিবেশের প্রতি গুরুত্ব আরােপ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বিশ্ব সংরক্ষণ করে যে প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা যায় সেটাই টেকসই উন্নয়ন।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGS): ২৫-২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সম্মেলনের প্রথম দিনে ২৫ সেপ্টেম্বর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGS) গৃহীত হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীকে পুরােপুরি দারিদ্র্যমুক্ত করাসহ উন্নয়নকে টেকসই করতে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য রাষ্ট্র সর্বসম্মতভাবে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ গ্রহণ করে।
Transfarming Our World : The 2030 Agenda for Sustanable Development শীর্ষক এ কর্মসূচিতে কতগুলো বিস্তারিত, সুদূরপ্রসারী ও গণকেন্দ্রিক বিশ্বজনীন ও রূপান্তর সৃষ্টিকারী লক্ষ ও টার্গেট অন্তর্ভুক্ত হয়, যা Global Goals of 2030 Agenda হিসেবে অভিহিত। এ দলিল হলাে মানব উন্নয়নের দিকদর্শন, যার ভিত্তি Five Ps-People, Prosperity, Peace and Partnership। ১৫ বছর মেয়াদি এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু হয় ১ জানুয়ারি ২০১৬। এ কর্মসূচির আওতায় ১৭টি লক্ষ (Goals)-এর অন্তর্গত ১৬৯ বৈশ্বিক লক্ষমাত্রার (Targets) মূল লক্ষ হলাে সকলের অংশগ্রহণে জনগণের জন্য বাসযােগ্য, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ পৃথিবী গড়ার প্রত্যয়, সেখানে সকলের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত বিষয়গুলােতে প্রগতি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত হবে এবং বৈশ্বিক উন্নয়নের আশীর্বাদ থেকে কাউকে বাইরে রাখা হবে না।
১. দারিদ্র্য বিমােচন: সর্বত্র সব ধরনের দারিদ্র্য নির্মূল করা।
২. ক্ষুধা মুক্তি: ক্ষুধা মুক্তি, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টির লক্ষ অর্জন ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থা চালু।
৩. সুস্বাস্থ্য: স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করা ও সব বয়সের সবার কল্যাণে কাজ করা।
৪. মানসম্মত শিক্ষা: অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযােগ তৈরি করা।
৫. লিঙ্গ সমতা: লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং সব নারীর ক্ষমতায়ন করা।
৬. সুপেয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা: সবার জন্য পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের সহজপ্রাপ্যতা ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
৭. নবায়নযােগ্য ও ব্যয়সাধ্য জ্বালানি: সবার জন্য ব্যয়সাধ্য, টেকসই ও আধুনিক জ্বালানি সুবিধা নিশ্চিত করা।
৮. কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি: সবার সামর্থ্য অনুযায়ী উৎপাদনমুখী কর্মসংস্থান এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করা।
৯. উদ্ভাবন ও উন্নত অবকাঠামাে: দীর্ঘস্থায়ী অবকাঠামাে তৈরি করা, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই শিল্পায়ন করা এবং উদ্ভাবনে উৎসাহিত করা।
১০. বৈষম্য হ্রাস: দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় বৈষম্য হ্রাস করা।
১১. টেকসই নগর ও সম্প্রদায়: নগর ও মানব বসতিগুলােকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ, দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই করে তােলা ।
১২. সম্পদের দায়িত্বপূর্ণ ব্যবহার: টেকসই ভােক্তা ও উৎপাদন রীতি নিশ্চিত করা।
১৩. জলবায়ু বিষয়ে পদক্ষেপ: জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব মােকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
১৪. টেকসই মহাসাগর: টেকসই উন্নয়নের জন্য মহাসাগর, সাগর ও সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ ও সেগুলাের টেকসই ব্যবহার করা।
১৫. ভূমির টেকসই ব্যবহার: ভূ-পৃষ্ঠে প্রতিবেশের সুরক্ষা, ক্ষয় পুনরুদ্ধার ও টেকসই ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, বনাঞ্চল ও অরণ্য সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা, মরুকরণ মােকাবিলায় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ভূমি ক্ষয় রােধ ও জীববৈচিত্র্য বিনাশের বিপরীতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ
১৬. শান্তি, ন্যায়বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান: টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তৈরি করা, সবার জন্য ন্যায়বিচারের সুযােগ প্রদান করা এবং সর্বস্তরের কার্যকর, জবাবদিহিমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলা ।
১৭. টেকসই উন্নয়নের জন্য অংশীদারিত্ব: টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়নের পদ্ধতি শক্তিশালীকরণ এবং এ উদ্দেশ্যে বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব জোরদারকরণ।
বিশ্বায়নের ফলে অর্থনৈতিক একীভূতকরণ হয়েছে। এ অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের মধ্যেই মানবসভ্যতার উন্নয়ন নিহিত এবং পারস্পরিক সহযােগিতার ভিত্তিতে তা নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়ন কোনাে প্রতিযােগিতা নয়, যেখানে এক দেশ আর এক দেশকে বঞ্চিত করে অগ্রসর হবে। বরং উন্নয়ন হলাে সকলকে নিয়ে অগ্রযাত্রা। এক দেশের পরিবেশগত, সামাজিক বা অর্থনৈতিক বিপর্যয় শেষ পর্যন্ত মানবসমাজের একমাত্র আবাসস্থল পৃথিবীর জন্য প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে ক্ষতির কারণ হয়। সে জন্য এসডিজিতে সামষ্টিকভাবে উন্নয়ন চিন্তার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বাস্তব দৃষ্টিতে বিচার করলে বিশ্ব হতে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অস্বাস্থ্য ও অশিক্ষা দূর করতে; প্রাকৃতিক পানির সুষ্ঠু ব্যবহার, সুষম নগরায়ণ, সর্বজনীন কর্মসংস্থান ও কর্মপরিবেশ, দূষণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মােকাবিলা করাসহ বিশ্বব্যাপী মানুষের মর্যাদা সমুন্নত রাখা; সুশামন প্রতিষ্ঠা ও মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করতে হলে সম্মিলিত এ রূপরেখা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের প্রতিজ্ঞাও জরুরি।
(SDGS) অর্জনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: ডিজিটাল বাংলাদেশে এসডিজি অর্জনে তথ্য প্রযুক্তির ভূমিকা অপরিসীম। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ তিউনিস শীর্ষ সম্মেলনে তথ্য সমাজ বিনির্মাণে তথ্য প্রযুক্তির ভূমিকা একীভূত করে একে টুলস বা অঙ্গীভূত কৌশল হিসেবে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যবহার করার পরামর্শে সকল সদস্যরাষ্ট্র সম্মত হয়। সেই থেকে সব দেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তথ্য প্রযুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে সঙ্গত কারণেই এর বিশেষত্ব তাৎপর্যময়। এসডিজির ১৭টি অভীষ্ট লক্ষ্যের তৃতীয়টি হলাে 'সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ। এই তৃতীয় অভীষ্ট অর্জনের সুস্পষ্ট লক্ষমাত্রা হলাে ১৩টি, যার অন্যতম হলাে ৩.৪ যাতে উল্লেখ আছে প্রতিরােধ ও চিকিৎসার মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রােগের কারণে অকাল মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনা এবং মানসিক সুস্থতা ও কল্যাণ নিশ্চিতে সহায়তা প্রদান করা। স্বাস্থ্যসেবায় দুনিয়াব্যাপী তথ্য-প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার বেড়েছে। যা চিকিৎসা সেবাকে সাশ্রয়ী, আধুনিক ও সহজলভ্য করেছে। উন্নত বিশ্বে ফার্মাসিউটিক্যাল কূটনীতি বা ওষুধ কোম্পানিগুলাের এক ধরনের রাজনীতি আছে, যা প্রযুক্তি ব্যবহারকে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে বিতর্কিত করার অথবা প্যাটেন্টের নামে একচেটিয়া করার কূটকৌশল আছে। এর উদ্দেশ্য বাণিজ্যিক এতে কোনাে সন্দেহ না থাকলেও এসডিজি-৩ বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট অভীষ্ট ও সূচক নির্ধারিত থাকার ফলে দেশগুলাের সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ' অর্জনে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযােগ অনেকটাই বেড়েছে।
তাছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থায়ও এখন বাংলাদেশে প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। বাংলাদেশে শহর থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়ের অধিকাংশ স্কুল, কলেজে কম্পিউটার ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ডিজিটাল ক্লাসরুমে এখন ক্লাস নেওয়া হচ্ছে এবং বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে। এর ফলে অনেক কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে। এর মাধ্যমে বেকার সমস্যারও সমাধান করাও সম্ভব হবে বলে মনে করেন অনেক বিশেজ্ঞরা। মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনেক কিছু সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করছে। ফলে বাংলাদেশের তথা ৩য় বিশ্বের অনেক দেশ তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হয়েছে।
উপসংহার: তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। কাজেই টেকসই উন্নয়নের লক্ষমাত্রা অর্জনের জন্য প্রযুক্তিগত সহযােগিতা আরও বাড়াতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য রাষ্ট্র ও সরকারের পাশাপাশি জনগণকে আত্মনিয়ােগ করতে হবে। দলমত নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের উন্নয়নে নিজেকে নিয়ােজিত করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত, সমৃদ্ধ, সুন্দর এবং বাসযােগ্য বাংলাদেশ উপহার দিতে এর কোনাে বিকল্প নেই। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, শােষণ ও বঞ্নামুক্ত সােনার বাংলা গড়ে তুলতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাই অবদান রাখবে এটাই প্রত্যাশা।
1 comment