বা প্রযুক্তিতে নতুনত্ব
ভূমিকা : প্রযুক্তি বিজ্ঞানের অর্থ হচ্ছে জীবনযাত্রার প্রতিটি মাধ্যমে প্রকৃষ্টভাবে বিজ্ঞান শক্তি যুক্ত হওয়া। প্রযুক্তিবিদ্যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Technical Science বােঝানাে হলেও প্রযুক্তিবিদ্যার পরিধি এত বিশাল ও ব্যাপক যে খুব কম কথায় এর ব্যাখ্যা করা এবং এর সমগ্র পরিচয় দেওয়া কঠিন। আধুনিক সভ্যতায় ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞান শক্তির প্রয়ােগ বিষয়ক কর্মকাণ্ডই হচ্ছে প্রযুক্তি বিজ্ঞানের কাজ। বিজ্ঞানের জ্ঞানকে যে পদ্ধতির মাধ্যমে বিভিন্ন আবিষ্কার বা উৎপাদনের রূপ দেওয়া হয় তাকে বলে প্রযুক্তিবিদ্যা। বিজ্ঞান যখন মানুষের প্রয়ােজনের সীমায় বাধা পড়ে তখন প্রযুক্তিবিদ্যার জন্ম হয়। মানুষের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের জন্য প্রযুক্তিবিদ্যার কল্যাণে বিজ্ঞানের অভিজ্ঞতা কাজে লাগে। প্রযুক্তিবিদ্যার সীমাহীন কল্যাণে আমাদের জীবনে, এসেছে সুখ-সম্পদ, আরাম-আয়েশ, সময় ও দূরত্বের নিকটত্ব। অর্থাৎ জীবনকে সুখময় করার জন্য যা কিছু প্রয়ােজন, জীবনের বিকাশের জন্য যা কিছু সমাবেশ সবই প্রযুক্তিবিদ্যার বিচিত্র অবদান হিসেবে বিবেচ্য।
প্রযুক্তিবিদ্যার প্রকৃতি : বিজ্ঞানকে মানুষের কল্যাণে নিয়ােজিত করার প্রবণতা থেকে প্রযুক্তিবিদ্যার বিকাশ। মানুষের প্রয়ােজন। মেটানাের জন্য প্রযুক্তিবিদ্যা এসেছে বিজ্ঞানের সহায়ক হিসেবে। প্রযুক্তির বিচিত্র কৌশল প্রয়ােগ করে তা মানুষের প্রসারিত প্রয়ােজনের পরিধিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে তৈরি হচ্ছে নিত্য নতুন উপকরণ ও যন্ত্রপাতি। যন্ত্র ছাড়া বর্তমান যুগ ও অচল। পঙ্গু দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তােলে উন্নত উৎপাদন ব্যবস্থা। আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে কৃষির প্রযুক্তিকে মানুষ বেঁধে রাখল। নানা সুখভােগের উপায় উদ্ভাবনে, উৎপাদনে, তাকে ছড়িয়ে দিল মনের সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা মেটানাের কাজে। তাই বিমান ভ্রমণের সুখেই সে তৃপ্ত নয়, সে এখন মহাশূন্যচারী, চাদে গিয়েও মানুষের তৃপ্তি মেটেনি, সে এখন যাবে আরও দূরের গ্রহে, যাচ্ছে অতলান্ত সাগরে তার রত্ন আহরণে, জ্ঞান আহরণে। জ্ঞান রাজ্যে বিচরণে মানুষ এখন আর গতানুগতিক ছাপাখানায় বসে নেই, ফটোকম্পােজ আর কম্পিউটার এসেছে আকর্ষণীয়তা নিয়ে। মানুষের মনের সীমাহীন বায়না যােগায় এখন প্রযুক্তিবিদ্যা। প্রযুক্তির কল্যাণেই মানুষ আজ নতুনকে স্বাগত জানাতে অভ্যস্ত হয়েছে। দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, যােগাযােগ ব্যবস্থা শক্তিশালী জাতি গঠনের এসব অপরিহার্য দিকগুলাে উন্নত করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির উপর নির্ভর করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। এসবের সুষ্ঠু বিকাশ জাতিকে শক্তিশালী করে তােলে।
আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার আবির্ভাব : অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যাণ্ডে প্রযুক্তিগত বিপ্লবের পথ ধরে এল শিল্প বিপ্লব। দ্রুত তা ছড়িয়ে গেল উন্নত বিশ্বে। ক্রমে কুটির শিল্পের স্থান গ্রহণ করল যন্ত্রশিল্প। মানুষ পরিণত হল যন্ত্রে। আধুনিক যুগে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিবিদ্যা একই স্রোতধারায় প্রবর্তিত হতে লাগল। প্রযুক্তিবিদ্যার কারিগরি জ্ঞান দিয়ে বিজ্ঞানকে মানব জীবনের সর্বত্র কাজে লাগাল। প্রযুক্তিবিদ্যার আবির্ভাব ও বিকাশকে মলত তিন যুগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম যুগে ছিল বা্পীয় যন্ত্রের প্রাধান্য, দ্বিতীয় যুগে ছিল বিদ্যুতের প্রাধান্য, আর তৃতীয় বা বর্তমান যুগে রয়েছে পারমাণবিক ও সৌরশক্তির প্রাধান্য।
প্রযুক্তির বিকাশ : প্রযুক্তিবিদ্যাই সভ্যতাকে আধুনিক করে তুলেছে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। মানুষের কাছে যখন যান্ত্রিকশক্তি অজানা ছিল তখন জীবন সংগ্রামে মানুষের একমাত্র হাতিয়ার ছিল দৈহিক শ্রম। শস্য উৎপাদনে, হাতিয়ার নির্মাণে, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্যাদি যেমন-কাপড়-চোপড়, ঘরবাড়ি, তৈজসপত্র তৈরিতে মানুষের হাতই ছিল একমাত্র হাতিয়ার, আর দৈহিক শ্রমই ছিল প্রধান শক্তি। প্রযুক্তির প্রথম যুগেও প্রচুর উৎপাদনই ছিল এর বৈশিষ্ট্য। স্বল্পমূল্য ও স্বল্প শ্রমে পণ্য উৎপাদিত হত। দ্বিতীয় যুগে প্রযুক্তি ব্যবহৃত হল মহাযুদ্ধগুলোতে, ভবিষ্যৎ যুদ্ধের আশঙ্কায় প্রযুক্তি এখনও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সমরাস্ত্র তৈরির কাজে। আগে প্রযুক্তিবিদ বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে শ্রম শিলপ ব্যবহার করতেন। এখন সমস্যার প্রতিবিধানের জন্য কলকারখানাগুলােতেই গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত। ফলে উৎপাদনের সকল ক্ষত্রে প্রযুক্তিবিদ্যা কাজ করছে। ডিজাইন, পরিচালনা উৎপাদন—সবকিছুতেই প্রযুক্তিবিদ্যার অবাধ গতি।
প্রযুক্তির সহযােগিতা : আধুনিক যুগে প্রযুক্তিবিদ্যার বিস্ময়কর বিকাশে সারা পৃথিবী জুড়ে নবচেতনার সঞ্চার হয়েছে এবং তা পৃথিবীকে দ্রুত উন্নয়নের দিকে পরিচালিত করছে। এক দেশের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি চালান হচ্ছে অন্য দেশে। প্রযুক্তি জ্ঞানের সুযােগ-সুবিধা গ্রহণ করছে সব দেশ। অনুন্নত দেশের উন্নতির জন্য প্রযুক্তি আহরণ একটা কার্যকর পন্থা। আবার কোন দেশের প্রযুক্তিবিদ্যার সুষ্ঠু রূপায়ণের জন্যে কাঁচামাল যােগাচ্ছে অন্য দেশ। তাই এখন প্রযুক্তি যাদের হাতে তারাই সর্বাধিক সমৃদ্ধ। তারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে প্রযুক্তিকে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করছে। প্রযুক্তি সরবরাহের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে সারা বিশ্বে পারস্পরিক সহযােগিতা।
উপসংহার : এখন প্রযুক্তিবিদ্যার বিজয় সারা বিশ্বে ঘােষিত এর চর্চার জন্যে বিশ্ব জুড়ে সরবরাহের মাধ্যমে গড়ে তি হচ্ছে। এ উঠেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রযুক্তির আরও উৎকর্ষ সাধনে নিয়ােজিত রয়েছে অগণিত গবেষণাকর্মী। আমাদের দেশ একটা উন্নয়নশীল দেশ। এখানে প্রযুক্তির ব্যবহারে উন্নতি সাধন করা কঠিন নয়। নতুন নতুন সম্পদ আহরণ ও বিদ্যমান সম্পদের উন্নয়নে যদি আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়ােগ করা যায় তবে দেশকে দ্রুত সমস্যামুক্ত করা অসম্ভব হবে না।
Post a Comment