বা দেশােন্নয়ন
বা গ্রামােন্নয়ন।
বাংলাদেশের গ্রাম : গ্রামের আনন্দমুখর উৎসব, সুখ শান্তির সুনিবিড় ছায়া আজ আঁধারে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। গােলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, গােয়ালভরা গরু, মাঠে ঘাটে রাখালের বাশির সুর, গলাভরা গান আর তেমন শােনা যায় না। দুঃখ দৈন্যতা, অভাব অনটন, অশিক্ষা, কুশিক্ষা এসব আজ ভাইরাসের মত জীবন পেয়েছে। তাই তাে কবি হুদয়ের কাতর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়,
"বড় দুঃখ, বড় ব্যাথা সম্মুখেতে কষ্টের সংসার,
বড়ই দরিদ্র, বড় শূন্য, বড় ক্ষুদ্র, বড় অন্ধকার।
অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলাে চাই, চাই মুক্ত বায়ু
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উচ্ছল পরমায়ু।"
গ্রামের অতীত ঐতিহ্য : ছায়া সুনিবিড়, কাকলিমুখর গ্রামবাংলা একদা ছিল অফুরন্ত সম্পদ ও সৌন্দর্যে ভরপুর। গােলাভরা ধান, গােয়ালভরা গরু, আর পুকুরভরা মাছের, অফুরন্ত সমভারে গ্রামবাংলায় ছিল সমৃদ্ধির বিপুল প্রাচুর্য, কুটিরশিল্পের সুখ্যাতি ও সমৃদ্ধি। সে সমৃদ্ধির কথা লিখে গেছেন সেকালের পরিব্রাজকরা। শিল্পী যার ছবি আঁকতেন, কবি যার কবিতা লিখতেন, গায়েন যার গান গাইতেন সেই রূপসী ও সম্পদসমৃদ্ধ বাংলার গ্রাম আজ হতশ্রী। গ্রামের সর্বত্র আজ অভাব-অনটন, দুঃখ দৈন্য ও নিরানন্দের ছায়া প্রকট। এককালের সমৃদ্ধ পূর্ববাংলা অনেক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে আজ স্বাধীন।
বর্তমান গ্রামের অবস্থা : কিন্তু বাংলাদেশ জনবহুল দরিদ্র দেশ হলেও তার স্থান আজ পৃথিবীর মানচিত্রে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় গ্রাম আজ অন্নহীন, বস্ত্রহীন, শ্রীহীন। গ্রাম আজ সবদিক থেকেই অবহেলিত, উপেক্ষিত, বঞ্চিত। আজ অভাবের এক জ্বালাময়ী জিহ্বার বিস্তার গ্রামে। সেখানে নেই সম্পদের স্বচ্ছলতা, নেই দহজিলের সান্ধ্য আসর। ভূমিহীন কৃষকের জীবনে নেই সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনের স্বপ্ন সম্ভবনা। এক হিসেবে দেখা যায়, গ্রামােঞ্চলে দারিদ্র্যপীড়িত জনসংখ্যা প্রায় ৪৩ শতাংশ।
গ্রামের দুরবস্থার কারণ : স্বাধীনতার পর বিগত তিন দশকে গ্রামের দারিদ্র্যর্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ব্যাপক কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় নি। ফলে বিপুল সংখ্যক গ্রামবাসী মানবেতর জীবন যাপন করছে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের সামাজিক জীবনও রয়ে গেছে পশ্চাদপদ। সেখানে মানুষ অনেক ন্যায্য মানবিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত। বিপুল সংখ্যক মানুষকে কাটাতে হচ্ছে মানবেতর জীবন। অবহেলিত গ্রামগুলােতে যারা কোন মতে দু'বেলা অনু জোগাড় করতে পারছে না তারা আজ ভাগ্যের অন্বেষণে পাড়ি জমাচ্ছে শহরের অনিশ্চিত জীবনের সাথে। শহরে গিয়েও গ্রামের ছিন্নমূল মানুষ বস্তির ছায়া খুঁজে পায় না। সমস্ত দেশের সম্পদ শােষণ করে গড়ে উঠেছে যে শহর সে শহরেও ছিন্নমূল মানুষের মাথা গোজার ঠাই হয় না। ফুটপাতে, বস্তিতে তাদের অধিকাংশের রাত কাটে। সে শহরে যান্ত্রিকতা, ভণ্ডামি, নীতিহীনতায় ভরা ফাপা মানুষের শহর, যা কবি এলিয়টের ভাষায়,
This is the dead land
This is the cactus land.
তাই সবার সচেতনতা জেগেছে গ্রামবাংলাকে আবার সঞ্জীবিত করতে হবে, সেখানে বইয়ে দিতে হবে প্রাণপ্রবাহ। দূর করতে হবে গ্রাম ও শহরের বৈষম্যমূলক ব্যবধান। এ বাস্তবতারই আকুল মর্মবাণী উচ্চারিত হচ্ছে স্লোগানে : "চল গ্রামে ফিরে যাই”। গ্রামকে জাগানাের মহৎ গুরুত্বের কথা ভেবেই একদা রবীন্দ্রনাথ আহ্বান জানিয়েছিলেন, “ফিরে চল মাটির টানে।” গানের ভাষায় লিখেছেন:
'চল ফিরে চল মাটির পানে
সেখানে বাতাস গন্ধ উদাস
সােহাগ জানায় কানে কানে।'
যার ছবি আঁকতেন, কবি যার কবিতা লিখতেন, গায়েন যার গান গাইতেন সেই রূপসী ও সম্পদসমৃদ্ধ বাংলার গ্রাম আজ হতশ্রী। গ্রামের সর্বত্র আজ অভাব-অনটন, দুঃখ-দৈন্য ও নিরানন্দের ছায়া প্রকট। এককালের সমৃদ্ধ পূর্ববাংলা অনেক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে আজ স্বাধীন। আজ একুশ শতকে নগর জীবনের অস্থিরতা, সমস্যা ও সংকটের ভারাক্রান্ত মানুষও গ্রামে ফেরার কথা ভাবছেন। আর দেশভাবুক মানুষ ভাবছেন, গ্রামবাসী ও জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থে গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা।
বাংলাদেশের উন্নয়ন : গ্রামােন্নয়ন বলতে গ্রামের মানুষের জীবনমান, অবকাঠামােগত গ্রামের শ্বাশত বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে জনজীবনের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকেই বােঝায়। এক কথায় গ্রামােন্নয়ন তথা দেশােন্নয়নের মূল লক্ষ্য গ্রামীণ মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তা রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ রেহমান সােবহান বলেছেন, “উন্নয়ন মানে শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন নয় বরং তার চেয়ে বেশি কিছু। বস্তত খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তাসহ আপামর জনগােষ্ঠীর সার্বিক মৌলিক চাহিদা পূরণ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিরর্থক।
গ্রামােন্নয়নের গুরুত্ব : আমাদের দেশের শতকরা প্রায় পঁচাশি জন অধিবাসীই গ্রামে বসবাস করে। দেশের সম্পদের সিংহভাগ আসে গ্রাম থেকে। কৃষিনির্ভর এদেশের মানুষের জীবনে দীর্ঘকাল ধরে প্রাচুর্য আর স্বাচ্ছন্দ্য এনেছে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম। দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে এবং স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হলে, গ্রাম উন্নয়নের বিকল্প নেই।
গ্রামােন্নয়ন পরিকল্পনা : বর্তমানে গ্রামােন্নয়ন কর্মসূচিকে জাতীয় উন্নয়নের কন্দ্রবিন্দু হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি বেসরকারি প্রচেষ্টা গ্রামােন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। গ্রামের বৃহত্তম জনগােষ্ঠীর আর্থ- সামাজিক উন্নয়ন ঘটানাের জন্যে কৃষি, গবাদি পশুপালন, সমবায়, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, শিক্ষা, দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে প্রশিক্ষণ, গণসচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি কার্যক্রম এ কর্মসূচির আওতায় রয়েছে।
উপসংহার : বাংলাদেশে বর্তমানে গ্রামােন্নয়ন এবং সংস্কারের জন্যে সাধ্যমতাে প্রচেষ্টা চালানাে হচ্ছে। ইতিমধ্যে গ্রামীণ উন্নয়ন সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরণের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এগুলোর বাস্তবায়ন হলে দেশের প্রতিটি গ্রামের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব। আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রতিটি গ্রাম স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে গড়ে উঠলে নাগরিক জীবনের প্রতিটি সুযােগ-সুবিধা এখানে মিলবে। মানুষের জীবন সুস্থ সুন্দর এবং সুখী হয়ে উঠবে। ফলে শহরের যানজট তথা মানুষের অনাকাঙিক্ষত ভীড় কমে যাবে। শহুরে জীবনে ক্লান্ত অনেক আধুনিক বাবুও ফিরে আসতে চাইবে গ্রামবাংলার বুকে। এভাবেই গ্রাম তথা দেশের উন্নয়ন সাধিত হবে।
Post a Comment