বা চৈত্রের খরতা
বা গ্রীষ্মের দুপুর
ভূমিকা ও প্রকৃতি : চৈত্রের দুপুর। তবু যেন নিদাঘের প্রথর মার্তগ তাপসম "জ্বলিছে চতুর্দিক। বসন্ত দুপুরেও চারিদিকে কেবল খা খা ও ঝা-ঝা সমারােহ। চৈত্র মাস। মধু ঋতু শেষার্ধ। ফাগুনে 'মাঠে জ্বলে নি আগুন। তখন প্রতি বৃক্ষে ছিল নব পত্র পল্লবের সমারােহ, ছিল প্রতি শাখায় পুষ্প মঞ্জুরির স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ মহিমা; ছিল মধুমক্ষিকার মধু গুঞ্জরণ এবং প্রজাপতির বিচিত্র পক্ষসঞ্চালন; ছিল সেখানে প্রকৃতির শ্যামলীমায় প্রাণ প্রাচুর্যের আলােড়ন আন্দোলন, জাগায়ে তুলেছিল এক অভূতপূর্ব দোলা শিহরণ। বসন্তের আনন্দ মধুর চিত্রশালা চৈত্রের শেষ পর্যায়ে একান্তভাবেই অনুপস্থিতির ইতিরেখা টেনে দেয়। উৎসবমুখর নাট্যমন্দিরে দীর্ঘ সময় ব্যাপী ঢাকের আওয়াজ যেমন একটি অবিশ্রান্ত সুর আধিক্যের স্মরণে সৃষ্টি করে থাকে, ফায়ুনের সমারােহ অনুরূপ সুরের এক মহিমার সৃজন করেছিল। উৎসবের শেষে আমরা চাই একটি প্রশান্তি; একটি বিরতি , ষসিতি। আকাশে জ্বলন্ত সূর্য। দ্বিপ্রহরের তাপ আরও দুর্বিসহ। বিজ্ঞানী সভ্যতা অবশ্য বিদ্যুৎ ছড়ায়েছে বৈদ্যুতিক পাখার বাতাস, বরফ, সরবত সামনেই যে চৈত্র সংক্রান্তি, শিবের গাজন, বিরাট মেলা সেখানে যে ঘুড়ি উড়াবার পালা। গৃহবধূদের দুপুরে কাঁথা সেলাই শ্রাবণের অবসর যাপনকেও হারায়ে গিয়েছে। বর্ষীয়সী রমণীগণ নিজেদের পুত্রকন্যার কথা ভেবে আকুল হচ্ছেন, যুবতীরা তাদের পতির আবেদন, নিবেদন, শাসন প্রভৃতির কথা ভেবে আকুল চিত্ত হচ্ছে। সমস্ত দিকে চৈত্র দুপুরের নিস্তব্ধ নিঝুম ভাবটিকে যেন নির্বিবাদে গিলতে চাচ্ছে।
চৈত্রের দুপুরের স্বরূপ : গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ; স্মৃতি রােমন্থনের এক দুর্লভ মুহূর্ত। অসংযত মন নিজের ইচ্ছাতেই হেঁটে চলে অতীতে। তারপর এক বিশেষ মুহূর্তে এসে থেমে পড়ে। সে মুহূর্ত কখনও অশ্রসজল কখনও আনন্দ উদ্বেল। হঠাৎ বের হয়ে পড়লাম। বন্ধু ডেকেছে। অস্বীকার করব কি করে? গাছের পাতারা এমন সুন্দর সুন্দর ফঁাক তৈরি করেছে যে, চলতে চলতে মনে হচ্ছিল সূর্যের রশিজলে ধূলির ধরণীতে যেন এক বিচিত্র আল্পনা এঁকে রেখেছে, তপ্ত বায়ু হিল্লোল। শরীরে লাগতেই মনে হয় যেন পুড়ে ছাই হয়ে গেলাম। অবশ্যই এখন বিশ্রাম চাই। কিছুটা স্বস্তির প্রয়ােজন; কিন্তু পল্লীমায়ের বিস্তৃত অঞ্চলে এসবের সুযােগ কোথায়? তাদের জন্য রয়েছে ভাল বৃন্তের রজনী। প্রকৃতির এ অবদানই আসলে পাওনা। মাধবী দুপুর। সূর্য যেন একটি অগ্নিপিণ্ড। সবখানেই প্রচণ্ড উত্তাপ। বাইরের আকাশে একটি উত্তপ্ততা যেন থেকে থেকে কেবলই বলতছে-“ বাইরে এসাে না, বাইরে এসাে না।” এমনি খরতর চৈত্র দুপুরটিও যে দুর্গম গতিতে দুর্বার অভিযাত্রীর সাজে চলতে অজ্ঞাতসারে ঝিমায়ে পড়তে চাহে। সে তখন অলস দ্বিপ্রহর হয়ে উঠে। এ যেন চৈত্র দুপুরের এক তন্দ্রালসার গম্ডীর রূপায়ণ। সবখানেই একটি বিরাট নিস্তব্ধতা। চারপাশের বনস্পতির দীর্ঘশ্বাস যেন মাঝে মাঝে ঝরে পড়ছে। পত্রের অন্তরালে ঘুঘু মিথুন অবিরাম শব্দে, ও সুরে মনকে উদাস করে তােলে। রস মুখে মত্ত ঘুঘু দম্পতি সময়ে বা অসময়ে বা নিদ্রার আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে চায়। কিন্তু হঠাৎ আসে আকস্মিকতার আঘাত। কোথা হতে হুড়মুড় শব্দে বন বিটপীর প্রান্তদেশ ভেদ হয়ে আসে দুটি প্রাণী কপােত কপােতী।
অন্তসারশূন্য দুপুর : পথ আছে; কিন্তু একটি বিরাট শূন্যতা চারদিকে। উর্ধ্বে অনলবর্ষী সূর্য, নিম্নে উত্তপ্ত পথ। মাঠ প্রান্তর ধু- ধু করছে। মাঝে মধ্যে এক-আধটি প্রাণীকে পথেপ্রান্তরে দেখা যায়। মাঠ আছে, কৃষক আছে; কিন্তু কাজ নেই। কৃষকের পক্ষেও এটা কি মধুময় অবসন্ন যাপন? কেউবা মাঠের পূর্ব প্রান্তরে বটগাছটির নিচে দিবানিদ্রা দিতেছে। কেউবা তামাক টানছে। কেউবা দলবদ্ধ হয়ে খােসগল্প করছে। কেউবা তন্দ্রায় ঢুলছে। অনেকে আবার অফিসের মৌতাতে চক্ষু বুঝছে। হঠাৎ পার্শ্ববর্তী গৃহ হতে এমন মর্মছেড়া কান্না কেন? তাও আবার পাশাপাশি দুটি গৃহ হতে। জানলাম, এক বাড়িতে এমনি একজন এক্ষুণি বিদায় গ্রহণ করেছে।
উপসংহার : ষড়ঋতুর চক্রাবর্তনে প্রতিবারই চৈত্র আসে। চৈত্র মাসের, দুপুরে মন তাই পথ খুঁজে বনে তেপান্তরের পারে যেখানে শুধু শূন্যতা।
Post a Comment