SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা মরণােত্তর চক্ষুদান

চক্ষুদান একটি মহৎ সেবাকর্ম
বা আলাের কমল ফোটাবার অঙ্গীকার
ভূমিকা : সেবা পরম ধর্ম। মানুষ বিবেকবান প্রাণী। তার জ্ঞান, কর্ম সবকিছু তার নিজের জন্য নয়, অপরের জন্যও তার অনেক কিছু করার আছে। যুগে যুগে মহৎ মানুষেরা নিজের সুখ-সুবিধা বিসর্জন দিয়ে পরহিতে কাজ করে গেছেন। এখনও মানুষ মানুষের জন্য মঙ্গলজনক কিছু করে আনন্দ পেয়ে থাকে। এ আনন্দ প্রকৃতপক্ষে স্বর্গীয় আনন্দ। পৃথিবীতে বহু লােক দৃষ্টিশক্তিহীন। তারা এ সুন্দর পৃথিবীর দৃশ্য দেখতে পায় না। তাদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেওয়া একটি মহৎ কাজ। কিন্তু এই কিছুকাল আগেও তা সম্ভব ছিল না কিন্তু এখন তা সম্ভব হচ্ছে। কোন মানুষের মৃত্যু হলে অনতিবিলম্বে তার চক্ষু কণিয়া তুলে, অন্ধ ব্যক্তির চোখে তা পুনঃস্থাপন করার কৌশল সৃষ্টিকর্তার কৃপায় বিজ্ঞানের বদৌলতে আজ মানুষের করায়ত্ত। কোন ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় যদি লিখিতভাবে কোন সেবামূলক সংস্থায় তার চক্ষুদান করে যান, তাহলে তার এ মহৎ দানের ফলশ্রুতিতে একজন অন্ধ লােক দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে পারে।
চক্ষুদান ও চক্ষু সংযােজন : মানুষ কর্ণিয়ার সাহায্যে দেখতে পায়। চক্ষুগােলকের মাঝখানে এ কর্ণিয়ার অবস্থান। এ কর্ণিয়া যখন কোন কারণে নষ্ট হয়ে যায় তখন মানুষ আর দেখতে পায় না। তবে অন্য কোন লােকের চোখের কণিয়া তুলে এনে অন্ধ লােকের চোখে স্থাপন করলে সে আবার দেখতে পায়। কিন্তু জীবিত অবস্থায় কোন ব্যক্তি নিজে অন্ধত্ব বরণ করে অপরকে চক্ষুষ্মান করে তুলতে নিশ্চয়ই স্বীকার করবে না। আর স্বীকার করলেও একজনকে অন্ধ করে অপরজনকে দৃষ্টি দান করায় যেমন কোন মহত্ত্ব নেই তেমনি সার্থকতাও নেই। বিজ্ঞানিগণ পরীক্ষা করে দেখেছেন, একজন লােক মারা গেলে, মরণের ছয় ঘণ্টার মধ্যে তার চোখের কর্ণিয়া তুলে অপরের চোখে স্থাপন করলে সে লােক চোখে দেখতে পারে। সুতরাং জীবিত মানুষের চক্ষু না হলেও অন্ধ ব্যক্তিকে চক্ষুম্মান করা যায়, যদি মরণের পর কোন ব্যক্তি তার চক্ষু অন্ধদের কল্যাণে দান করে যায়। মৃত ব্যক্তির চোখের কর্ণিয়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে তা অন্ধ ব্যক্তির চোখে সংযােজন করার পদ্ধতি বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বাস্তবতা পেয়েছে। এতে হাজার হাজার অন্ধ ব্যক্তি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাচ্ছে।
বাংলাদেশে মরণােত্তর চক্ষুদান: বাংলাদেশের অধিকাংশ লােকই অশিক্ষিত, ধর্মভীরু এবং সংস্কার প্রিয়। মরণের পরে চক্ষু পরের কল্যাণে দিয়ে গেলে এতে মৃত ব্যক্তির কোন ক্ষতি হয় না, কিন্তু জীবিত অন্ধ ব্যক্তির অশেষ কল্যাণ সাধিত হয়। এ কল্যাণকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশে সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। অবশ্য এ প্রতিষ্ঠান খুব ধীরগতিতে মরণােত্তর চক্ষুদান কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। তাদের সামনে নানা বাধা বিপত্তি আছে। কারণ, জনগণ এ ব্যাপারে এখনও তেমন সচেতন নয়, উপরন্তু কিছু লােক মরণােত্তর চক্ষুদানকে উৎসাহিত না করে নিরুৎসাহিত করছে। এছাড়া চক্ষু সংগ্রহকারী সমিতির অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। যারা স্বেচ্ছায় চক্ষুদান করে যান, মরণের পর সময়মত যােগাযােগ রক্ষা করে তাদের চোখের কর্ণিয়া সংগ্রহ করা এবং চক্ষু ব্যাংকে তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা কঠিন এবং দায়িত্বশীল কাজ। এ কাজ সুষ্ঠুভাবে পালন করতে গেলে জনশক্তি দক্ষতাসম্পন্ন হতে হবে। RAN4 ৩৬৫ আমাদের দেশে মরণােত্তর চক্ষুদান প্রক্রিয়া এখনও সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করেনি। তাছাড়া সামাজিক প্রতিবন্ধকতাও দূর হয়নি। ফলে এ মহৎ কাজটি এখনও আমাদের দেশে ব্যাপকতা পায়নি। আমাদের দেশের কোন অন্ধ লােকের চোখে কর্নিয়া স্থাপন করতে গেলে এখনও তা অন্য দেশ থেকে কিনে আনতে হয়। প্রতি নিয়তই মানুষ মারা যাচ্ছে। তারা যদি সেচ্ছায় তাদের চক্ষু দান করে যান তাহলে তাদের মরণের পর তা সংগ্রহ করে অন্ধ ব্যক্তির চোখে স্থাপন করলে হাজার হাজার অন্ধ ব্যক্তি তাদের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে পারে। তাই মরণােত্তর চক্ষুদান কর্মসূচিকে সফল করতে হলে সরকারি এবং সামাজিক পর্যায়ে কতকগুলাে কার্যক্রম গ্রহণ করা একান্ত দরকার। এ সব কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযােগ্য-- (১) মরণোেত্তর চক্ষুদান কার্যক্রমকে সামাজিক আন্দোলনে রূপান্তরিত করা। (২) সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করা। (৩) সরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে যােগসূত্রের ভিত্তিতে অভিন্ন কার্যক্রমকে প্রাধান্য দেওয়া। (৪) মরণােক্তর চক্ষুদান যাতে পরিবারের পক্ষ থেকে বাধাগ্রস্ত না হয় তার নিশ্চয়তা অনুমােদন। (৫) ধর্মীয় বিধানে মরণােত্তর চক্ষুদান যে কোন গহিত কাজ নয় এ ব্যাপারে ধর্মীয় নেতাদের অনুমতি আদায়। এ ব্যাপারে সম্প্রতি মক্কাভিত্তিক ইসলামী সংগঠন ফিকহ একাডেমি অভিমত দিয়েছে, “মরণােত্তর অজ ব্যবচ্ছেদ বা সংস্থাপন শরীয়ত বিরােধী নয়। বর্তমান মিশর, মরক্কো, তিউনিসিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের আলেমগণ মরণােত্তর চক্ষুদানকে সমর্থন করেছেন। এছাড়া ও. আই. সি মরণােত্তর চক্ষুদানকে অনুমতি প্রদান করেছে‌। 
বর্তমান কর্তব্য : বাংলাদেশে চিকিৎসা বিজ্ঞান এখনও অন্যান্য দেশ থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। কর্ণিয়া স্থাপন, কিডান স্থাপন, বক্ষ বিদারণ ইত্যাদি বেশ জটিল অঙ্গ। এর জন্য দরকার দক্ষ শিক্ষিত শল্যবিদ। আমাদের দেশে বর্তমানে এ ধরনের শল্যবিদ কিছু পরিমাণে থাকলেও প্রয়ােজনের তুলনায় তা অতি নগণ্য। তাই সরকারি উদ্যোগে জরুরি ভিত্তিতে দক্ষ শল্যবিদ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। 
মরণােত্তর চক্ষুদান সমিতি সন্ধানীর কার্যক্রম : সন্ধানী দীর্ঘদিন যাবত তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজে তাদের ইউনিট আছে। ইতিমধ্যে তারা নয়টি চক্ষুব্যাংকও স্থাপন করেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত ২৫ হাজারের কিছু বেশি ব্যক্তি মরণােত্তর চক্ষুদান সমিতিতে চক্ষুদান করার অঙ্গীকার করেছে এবং এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজারের মত ব্যক্তির চোখে কর্ণিয়া সংযােজন করা হয়েছে যা আশাতীতভাবে সফলতা লাভ করেছে। 
উপসংহার : বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ সালে "অন্ধত্ব মােচন চক্ষুদান অর্ডিন্যান্স ১৯৭৫" নামে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করে চক্ষুদান কার্যক্রমকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। বর্তমানে শুধু প্রয়ােজন এ অর্ডিন্যান্সের আলােকে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ। এ ব্যাপারে এদেশের শিক্ষিত ও সচেতন জনগণের দায়িত্ব এবং কর্তব্য রয়েছে। সে কর্তব্য পালনের ভিতর দিয়ে আমরা বাংলাদেশ থেকে অন্ধত্বের অভিশাপ মােচন করতে পারি। এবং অন্ধ ব্যক্তির চোখে আলাের কমল ফোটাতে পারি।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment