বা গণতন্ত্র ও উন্নয়ন
বা গণতন্ত্র ও বাংলাদেশ
ভূমিকা : মানুষ তার অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে আজ পর্যন্ত যতগুলাে শাসন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে তার মধ্যে গণতন্ত্রই শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত। তবে গণতন্ত্রের উদ্ভব একালে হয় নি। প্রাচীন গ্রীসেও গণতন্ত্র ছিল এবং গ্রীকরাই গণতন্ত্র উদ্ভাবন করেছিলেন। তবে গ্রীসে প্রচলিত গণতন্ত্র ও বর্তমানের গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত মুখ্য বিষয় বা Spirit এক হলেও দুই গণতন্ত্রের মধ্যে বিরাট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। যদিও বাস্তবে এ পদ্ধতির সরকার government by the representatives of the people তবুও একেই বলা হয় government by the people. আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ষােড়শ প্রেসিডেন্ট অ্যাব্রাহাম লিঙ্কন গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে ৪ ”Government of the people for the people and by the people". অর্থাৎ, অধিকাংশ ভােটাধিকারপ্রাপ্ত নরনারীর ভােটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত সরকারকে জনগণের সরকার বলা হয় তাই অযৌক্তিক নয়। আমাদের দেশের গণতন্ত্র : বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসনাধীনে। এর সংবিধান প্রণয়ন করেন। এসব প্রতিনিধিরা। সংবিধানেও গণতান্ত্রিক নীতিই সরকারের মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয় এবং নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু গণতন্ত্র হোঁচট খায় ১৯৭৫ -এর প্রথম দিকে যখন 'জরুরি অবস্থা ঘােষিত হয়। তারপর ঐ সালেরই শেষার্ধে দেশে 'সামরিক শাসন জারি হয়। ফলে সংবিধান অকার্যকর হয়ে পড়ে। এরপর ১৯৭৮ সালে পুনরায় সংবিধান বলবৎ করা হয় এবং দেশব্যাপী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তিত হয়। কিন্তু পুনরায় ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে সংবিধান নিষ্ক্রিয় করে সামরিক শাসন জারি করা হয়। ১৯৮৬ সালে পুনরায় সংবিধান কার্যকর করা হয় এবং ঐ বছর ও ১৯৮৮ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রধান দুটি বিরােধী দল অংশ গ্রহণ না করায় ১৯৮৮ সালের নির্বাচনকে জনসাধারণের এক বিশাল অংশ প্রহসন বলে গণ্য করে এবং বিরােধী দলসমূহের বলে গণা ক সালের ডিসেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট এইচ, এম, এরশাদ সংসদ ভেঙ্গে দেন ও পদত্যাগ করেন। পরবর্তী বছরের গােড়ার দিকে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সংসদে অধিবেশনে বসার পর রাষ্ট্রপ্রধান শাসিত সরকার পদ্ধতির পরিবর্ত পূনরায় সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করে এবং গণভােটের মাধ্যমে তা অনুমােদিত হলে সে পদ্ধতির পুনঃপ্রবর্তন হয়।
বর্তমানে গণতন্ত্র : ১৯৯১ সাল থেকে দেশে গণতন্ত্র চালু আছে। তবে অনেকে মনে করেন যে বিশেষ ক্ষমতা আইন বলবৎ থাকার কারণে নিরঙ্কুশ গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়াও ব্যাপক অশিক্ষা, স্থানীয় ক্ষমতাবানদের অনভিপ্রেত প্রভাব ও অর্থের প্রতিপত্তির কারণে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না। আরও আছে জোরজবরদস্তি, ভীতি প্রদর্শন, জাল ভােট প্রদান ইত্যাদি। এগুলাে কোনটাই গণতন্ত্রের অনুকূল নয়। নেতাদের মধ্যে সহনশীলতার অভাব ও চরিত্র হননের প্রবণতাও সুষ্ঠু গণতন্ত্রের বিকাশের পথে অন্যতম অন্তরায়। ক্ষমতায় আরােহণের পর ক্ষমতার অপব্যবহারও গণতন্ত্রের যাত্রাপথকে কণ্টকাকীর্ণ নেতৃত্বাধীনে গণআন্দোলন শুরু হয় । ১৯৯০ করছে। এ কারণে কেউ কেউ আমাদের গণতন্ত্রকে গণতান্ত্রিক স্বৈরাচার বলেও আখ্যায়িত করতে দ্বিধাবােধ করছে না। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের দেশে যেভাবে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে তাকে গণতন্ত্রের সুষ্ঠ চর্চা বলা যায় না। ফলে গণতন্ত্রের পথ ক্রমেই কণ্টকাকীর্ণ হচ্ছে।
গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ : ইংরেজ শাসন আমলে আমাদের জনসাধারণ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভােটাধিকার ভিত্তিতে ১৯৪৬ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তারই ফলাফলের ভিত্তিতে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। সেকালে পৃথক নির্বাচন প্রথা প্রচলিত ছিল। অধিকাংশ মুসলমান পাকিস্তান দাবিকে সমর্থন করে বলে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলকে পৃথক করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পত্তন হয়। এরপর পাকিস্তানে বারবার গণতন্ত্র রাহুগ্রস্ত হয়। সময়ে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশেই গণতন্ত্রের দাবি অধিকতর উচ্চকণ্ঠে উচ্চারিত হয়। গণতন্ত্রের নীতি অনুসারেই বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপিত হয়। যে দেশের জনগণ এত বেশি গণতন্ত্রকামী ও গণতন্ত্রের চর্চায় অভ্যস্ত সে দেশে কেন বারবার গণতন্ত্র বিপন্ন হয় তা এক রহস্য। তারপর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও গণতন্ত্রের নীতিমালা লঙ্ঘিত হতে দেখে সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা শংকিত হয়ে তা প্রকাশ করার পরেও ক্ষমতাসীনরা কেন সতর্ক হন না তা বােঝা কষ্টকর। হয়তাে ক্ষমতার মাদকতায় তারা বিভ্রান্ত হন। অথবা ক্ষমতার আলখেল্লাটা আমাদের নেতাদের গায়ে জুতসইভাবে বসে না। তবে শুধু নেতারাই যে এ অবস্থার জন্য দায়ী তা নয়। ভােটাররাও নানা ভাবে প্রভাবিত হন। রাজনীতিতে তাদের প্রচুর উৎসাহ থাকলেও তাদের অধিকাংশ শিক্ষার অভাবে সহজেই স্থানীয় স্বার্থপর ক্ষুদে নেতাদের দ্বারা প্রভাবিত হন। ধীর গতিতে হলেও শিক্ষার বিস্তার ঘটছে; ফলে জনসাধারণ দেশের স্বার্থ সম্পর্কে ক্রমেই অধিকতর সচেতন হচ্ছেন। নেতারা যদি গণতন্ত্র অব্যাহত রাখতে দৃঢ়সংকল্প হন এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে চলেন ও তাদের সমর্থকদের সেগুলাে মানার নির্দেশ দেন তা হলে ভােটাররা অধিকতর সচেতনতার সাথে যােগ্য প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে ভুল করবেন না
উপসংহার : অনেক সময় নানা কারচুপির মাধ্যমে গণরায়কে নস্যাৎ করে দেয়া হয়। এটা বন্ধ করতে হবে। কেবল প্রশাসন বা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এসব নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলগুলােকেও এসব দিকে মনােযােগ দিতে ও তৎপর হতে হবে। আপাত স্বার্থের জন্য কোন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া সমীচীন নয়। আজ যেটা স্বার্থানুকূল প্রমাণিত হচ্ছে, কালই সেটা স্বার্থের প্রকিকৃলে যেতে পারে। তাই রাজনৈতিক দলগুলাের জন্য সুষ্ঠু পথ অবলম্বন করাই শ্রেয় এবং প্রকৃত ষার্থের অনুকূল। উল্লেখিত অশুভ প্রবণতাগুলােকে রােধ করা গেলে আমাদের দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে বাধ্য এবং চিন্তাশীল প্রত্যেকের প্রত্যাশাও তাই।
Post a Comment