SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা গ্রীন হাউজ এফেক্ট বা গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়া ও বাংলাদেশ

ভূমিকা :
মানব সভ্যতার অগ্রগতির প্রেক্ষিতে যার অবদানকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা যায় তা হল বিজ্ঞান। বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানের বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বিস্ময়কর অবদানে মানব জাতি একদিকে যেমন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভােগ করছে, অন্যদিকে তার ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে এক ভয়াবহ সর্বনাশের দিকে। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে প্রাকৃতিক শক্তির ব্যাপক বৈচিত্র্যময় ব্যবহারের পরিণামে বিশ্বের প্রকৃতির ও তার পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়া শুরু হয়েছে। এ ভারসাম্যহীনতার ফলে পৃথিবী নামক গ্রহটির সামনে এগিয়ে আসছে চরম দুর্দিন। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়া।
গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়া কি : বিশ্বের মানুষ তার চারপাশে পরিবেশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে সুপ্রাচীন কাল থেকৈ জীবন যাপন করে আসছে। পরিবেশ বলতে চারপাশের আলাে-বাতাস, মাটি-পানি, পাহাড়-পর্বত, নদী-সাগর, ৩৫৮ উদ্ভিদ, প্রাণী জগৎ-সবকিছুর সম্মিলিত রূপ বােঝায়। মানুষ আর তার পরিবেশের মধ্যে যতদিন সমন্বয় বিদ্যমান ছিল ততদিন মানুষ ছিল নির্ভাবনায়। কিন্তু সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সাম্প্রতিককালে এ বৃদ্ধির হার হয়েছে আশঙ্কাজনক। এখানেই শেষ নয়। আগামী দিনগুলাের জন্য এই সমস্যা আরও প্রকট হতে যাচ্ছে। মানুষ বাড়ার ফলে নগরায়ন, অপরিকল্পিত কলকারখানা প্রতিষ্ঠা, যানবাহনের কালাে ধোঁয়া, ত্রুটিপূর্ণ বায়ু নিষ্কাশন, কীটনাশকের ব্যবহার, রাসাঁয়নিক তেজষ্ক্লিয়তা, বনভূমি কেটে ফেলা-এ ধরনের আরও বহু কারণে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডলের ওজন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সূর্যের ক্ষতিকারক তেজস্ক্রিয় রশ্মিগুলাে পৃথিবীতে এসে পড়ছে। এত পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভূপৃষ্ঠের উত্তাপ বাড়তে পারে বায়ুমণ্ডলে, এমন গ্যাসের পরিমাণ যে বাড়ছে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এসব গ্যাস সূর্য থেকে আসা স্বল্প দৈর্ঘ্য বিকিরণের জন্য স্বচ্ছ কিন্তু লম্বা দৈর্ঘ্য বিকিরণ ধরে রেখে ভূপৃষ্ঠ এবং বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত করে তােলে। বায়ুমণ্ডলে বেশ দূষণের ফলে যেসব গ্যাস জমছে তার অবর্তমানে লম্বা দৈর্ঘ্যের বিকিরণ মহাশূন্যে হারিয়ে যেত। এসব গ্যাস হল কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরােফ্লোরাে কার্বন ইত্যাদি। এসব গ্যাস যদি বর্তমান হারে বৃদ্ধি পায় তাহলে আগামী ২০১৫ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে তা দ্বিগুণ হবে এবং তাতে ভূপৃষ্ঠের উত্তাপ ১.৫ ডিগ্রি থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে বৃদ্ধির এই পরিমাণ মানব ইতিহাসের এক অভাবনীয় ঘটনা বলে বিবেচিত হবে। কারণ, এক ডিগ্রি তাপের কয়েক দশমাংশ উত্তাপ বৃদ্ধি বিশ্বের আবহাওয়ায় এক বিরাট পরিবর্তন আনতে সক্ষম এ গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার ফলে সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে, ঝড়ের তীব্রতা বাড়বে, উপকূল মণ্ডল ও নদ-নদীতে পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে। বাড়বে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। এতে বিশ্বের অনেক ভূমি বন্যা কবলিত হবে এবং লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়বে। পরিণামে শিল্পকারখানা, জনবসতি, কৃষি উৎপাদন, মৎস্য চাষ ও বনাঞ্চলের উপর ভয়াবহ ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দিবে।
বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া : বিশ্বের সবচেয়ে ঘন বসতি দেশ বাংলাদেশ। আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যাধিক্য এখানে বহু সমস্যার সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া অশিক্ষা ও দারিদ্র্যের জন্য এখানে সমস্যা আরও বেশি প্রকট। পরিবেশ দূষণ ক্রিয়া এদেশে ভয়াবহ সমস্যার জন্ম দিচ্ছে। গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়া, বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ আশঙ্কার কারণ হয়ে দাড়াচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং ভূপৃষ্ঠের উত্তাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় সমুদ্র পূষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের মত ব-দ্বীপ অঞ্চলে সবচেয়ে ভয়াবহভাবে অনুভূত হবে। বাংলাদেশের ভূমিতল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অতি সামান্য ওপরে অবস্থিত এবং প্রায় প্রতি বছরই বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়ের মত ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে থাকে। উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বলে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা দিবে।
সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি : আবহাওয়াজনিত কারণে সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি ঘটবে। পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া বাংলাদেশে একটি সাধারণ ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন। তবে কোন কোন জায়গা ঊর্ধ্বমুখী ওঠে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। তলিয়ে যেতে পারে এমন প্রধান প্রধান জায়গা। তা হল সুরমা উপত্যকা, ফরিদপুরের নিম্নাঞ্চল, চলন বিল, ঢাকার জলাভূমি ও খুলনার সুন্দরবন অঞ্চল। উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রতল বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া বিবেচনা করলে লক্ষ্য করা যাবে যে, এক মিটার উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে প্রায় ২৩ হাজার বর্গ কিলােমিটার পানির নিচে তলিয়ে যাবে। এই পরিমাণ বাংলাদেশের ১৫% ভাগের মত। এতে আবাদযােগ্য জমি কমে আসবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে এক কোটি মানুষ। এতে ছিন্নমূল শ্রমজীবী মানুষেরা দ্রুত বর্ধনশীল শহরে ভিড় জমাবে। তাদের জীবনে আসবে অন্তহীন দারিদ্র্য। এই অবস্থায় শস্য উৎপাদন ব্যাহত হবে, বনভূমি ধ্বংস হবে এবং ভৌত সম্পদ ও অবকাঠামাের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠবে।
মূল ভূখণ্ডে প্রতিক্রিয়া : সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন নদীর উচ্চতারও বৃদ্ধি ঘটবে। নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে নদীর উভয় পার্শ্বের বহু সম্পদ এবং শিল্পাঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যাবে। ফলে জলমগ্নতার ব্যাপ্তি ঘটবে। সমুদ্রতলের পরিবর্তনে সুন্দরবন বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সামুদ্রিক জলােচ্ছাস প্রতিরােধ ও জ্বালানি কাঠ সরবরাহের উদ্দেশ্যে সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে যে বনভূমি সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তাও বানচাল হয়ে যাবে।
লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ : বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল বরাবরই লবণাক্ততায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লবণাক্ততা অনুপ্রবেশের ফলে মিঠা পানির এলাকা সঙ্কুচিত হচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়ায়ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্রতল পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্রতল পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা দেশের ভিতরে আরও বেশি করে প্রবেশ করবে। এতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। লবণাক্ততার জন্য জনবসতি ও কল-কারখানার প্রয়ােজনে মিঠা পানি সরবরাহের সমস্যা দেখা দিবে। গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ায় উপকূলীয় বাঁধের ক্ষতি সাধিত হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিষ্কাশনের জন্য তৈরি অনেক বাঁধ আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে পানির নিচে তলিয়ে যাবে।
প্রতিরােধমূলক ব্যবস্থা : গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ায় যেমন সমস্যা দেখা দিবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে তার জন্য প্রতিরােধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক হবে। বন্যা প্রতিরােধের সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এর ক্ষতিকর প্রভাব কমানাে যেতে পারে। আবার নিমজ্জিত ভূমি উদ্ধারের কৌশল অবলম্বন করতে হবে। লবণাক্ততা নিরােধেও ব্যবস্থা করা দরকার হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ফসল উৎপাদন তথা চাষাবাদের ধরন পান্টাতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ রােধ করা এবং এর ক্ষয়-ক্ষতি কমানাের জন্য কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে। আবহাওয়ার সঠিক পূর্বাভাস দিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কায় সচেতন হওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করতে হবে।
উপসংহার : গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার সমস্যাটি শুধু বাংলাদেশের একার নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। আজ এ ব্যাপারে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্ন। উন্নয়নশীল দেশসমূহে এ সমস্যা প্রকট। একে মােকাবিলা করার জন্য উন্নত বিশ্বের সহযােগিতা প্রয়ােজন। আশু কর্তব্য হবে পরিবেশের দূষণ রােধ করা, গ্যাস নিঃসরণ রােধ করা ও বর্জ্য সমস্যা সমাধানের কৌশল বের করা, জ্বালানির ভিন্ন উৎস সন্ধান করা, বনাঞ্চল সৃষ্টি করা। ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার মােকাবিলা করতে হবে। সারাবিশ্বের সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা করলে পুথিবী আগামী দিনে মনুষ্যবাসের উপযােগী থাকবে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment