বা বাংলাদেশে শীতের প্রভাব
বা শীতের প্রাতঃকাল
ভূমিকা : পূর্ব দিগন্তে তখনও আলাের সুরমা পরিপূর্ণরূপে ফুটে T নি। অথচ বনে বনে পাখিদের হৃদয়ে তার গােপন উঠে সবার অলক্ষ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। বনান্তরালে তাদের মধুর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে উঠল দিবারম্ডের কল মুখরিত আনন্দ রাগিনী। এখনই পূর্ব দিগন্তে রাখালের বেশে আবির্ভূত হবে সকাল স্নিগ্ধ শীতল শীতের সকাল। তাকে স্বাগত সম্ভাষণ জানাবার জন্যে বনে বনে পাখির কণ্ঠে উঠছে মধুর আহ্বান গীতি। তাদের শিশির সিক্ত কণ্ঠে আনন্দের অনবদ্য জোয়ার লাগল। কুয়াশা জড়িত বনভূমি প্লাবিত করে তাদের কলমধুর গানের সুরলহরী ছড়িয়ে পড়ল দিক দিগন্তে। আর বিলম্ধ বেশি নেই। স্ল্পসময়ের মধ্যেই কুয়াশার জাল ছিন্ন ভিন্ন করে আমাদের দ্বারে এসে দাড়াবে আলাে ঝলমল একটি পরিপূর্ণ সকাল। সূর্যোদয়ের পূর্বে শীতের সকাল : লেপের তলা হতে উঠি উঠি করেও উঠতে ইচ্ছে হয় না; শিয়রে হিংস্র শীত কেশর ফুলিয়ে থাবা পেতে বসে আছে। গরম বিছানার স্বরচিত উত্তাপ ছেড়ে উঠতে গেলে কেমন এক দুর্নিবার আলস্য সমস্ত চেতনা ঘিরে ধরে। তন্দ্রা বিজড়িত চেতনায় দূর বনান্তরালে পাখিদের কল কুজন শােনা যায়, আর শােনা যায় পথচারীদের বাতাসে ভেসে আসা দু'একটি বিচ্ছিন্ন সংলাপ। অথচ চারদিকে পৃথিবী এক আশ্চর্য নিস্তব্ধতায় মগ্ন। এক সীমাহীন বিষন্নতা ও বৈরাগ্যে সকলের হৃদয় কানায় কানায় ভরে উঠেছে। শূন্যতাই বুঝি তার সঠিক পরিচয়। শীতের সকালে তাই এক নিসঙ্গ জড়তা সকলের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কর্মের আহ্বান সত্ত্বেও এক সুদূর ব্যাপ্ত নৈষ্কর্ম্যের জড়তায় মানুষ আরামের শয্যায় পড়ে থাকে এবং কল্পনা করতে পারে, শীতের বুড়ি কুয়াশার কম্বল গায়ে দিয়ে আগুন পােহাবার জন্য শুকনাে পাতা কুড়াতে বনের ভেতর দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে চলেছে।
শীতের সকালের ভাবরূপ: পূর্ব দিগন্তে ধীরে ধীরে আলাে ফুটতে থাকে। উত্তর দিক হতে হিমগর্ভ ঠাণ্ডা বাতাস একটি দীর্ঘশ্বাসের মতাে হঠাৎ শিরশির করে বনের গাছগুলাের পাতার ফাক দিয়ে বয়ে যায়। টুপটাপ করে শিশির ঝরে পড়ে। বনের পথ শিশির সিক্ত হয়ে উঠেছে। টিনের চালে এবং ঘাসে ঘাসে শিশির বিন্দু জমে ভােরের আলাে ঝলমল করছে। দূরে কোথাও খেজুর রস জ্বাল দেয়া হচ্ছে। বাতাসে তার লােভনীয় মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। গ্রামের রাস্তায় কৃষাণেরা বলদ ইাকিয়ে মাঠের দিকে চলেছে। মুগ, মসুর, ছােলা, অড়হর ইত্যাদি কলাই বুনার জন্য সময় মত ক্ষেত প্রস্তুত করা চাই। এদিকে সরিষার ক্ষেতে মৌমাছিদের গুঞ্জরণ উঠতে শুরু করেছে। দূরে গ্রামের পাঠশালায় ছােট ছােট ছেলেমেয়েরা এক বিচিত্র সুরে কবিতা মুখস্থ করছে। চারদিকে এ কর্ম প্রবাহের ব্যস্ততার মধ্যে বিছানায় পড়ে গভীর আলস্যে তন্দ্রামুখ উপভােগ করা অনুচিত।
শীতের সকালের বৈরাগ্য মূর্তি : দিকে দিকে কর্মের মুখরতায় শীতের সকাল কর্মব্যস্ত হয়ে উঠেছে। পূর্ব দিগন্তে আলাে ছড়িয়ে সূর্যের রথ আকাশ পরিক্রমায় বের হয়ে পড়েছে। একটি নীলকণ্ঠ পাখি রিক্তপাত্র বাবলার ডালে বসে রৌদ্র পােহাচ্ছে। এক জোড়া খঞ্জনা পাখি ডানায় বাতাস কেটে কুয়াশার ভেতর দিয়ে কোথায় উড়ে গেল। শীতের সকাল যেন এক প্রৌঢা কুলবধূ। তার সলজ্জ মুখখানি দিগন্ত বিস্তৃত বাড়তে থাকে। শীতের সকালও তার অবগুষ্ঠন ধীরে ধীরে খুলতে থাকে। তার বৈরাগ্য ধূসর অঙ্গ হতে শুভ্র সমুজ্জ্বল ত্যাগের সুষমা ছড়িয়ে পড়ছে। সে তার সমস্ত সঞ্চয় নিঃশেষে উজাড় করে দিয়ে ধারণ করেছে এক সর্ব ত্যাগিনী তাপসী মূর্তি।
ত্যাগের মূর্তি : তার হাতে বৈরাগিণীর একতারা। সে তার এক তারার নিঃসঙ্গ তারে হানে নির্মম আঘাত। তার ফলে বনের শুষ্ক বিবর্ণ পাতাগুলাে একে একে ঝড়ে পড়ে। উত্তরের হিমগর্ভ হাওয়া তাদের দুহাতে লুফে নিয়ে অবলীলায় উড়িয়ে দেয় বনের বুকে, শুষ্ক পাতার জীর্ণ কবর স্থূপীকৃত হয়ে উঠল। তার উপর দিয়ে উত্তরের শীতল হাওয়া হাহাকার করে কেঁদে চলে। কোথাও আবার আমের মুকুল ছুঁয়ে শিশিরের কান্না ঝরছে। এদিকে মাঠে মাঠে দেখা যাচ্ছে রাশি রাশি সবুজ কলাই। কুয়াশার গন্ধ, পাকা ধানের গন্ধ, সবুজ কলাই এর গন্ধ, দূর হতে ভেসে আসা খেজুর রসের গন্ধ-সমস্ত মিলে ধরণীর মাটির পাত্রটিকে কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে তুলেছে।
রূপ বদল : তারপর বেলা বাড়তে থাকে। শীতের সূর্য পূর্ব দিগন্তের কুয়াশার জাল ছিন্ন ভিন্ন করে এক গভীর আলস্যে উপরে উঠতে থাকে। তার কিরণবাণে পর্যুদস্ত হয় শীতের তীব্রতা। দূরে রাখাল ছেলে বাঁশী বাজায়। মাঠে গরুগুলাে লেজ দুলিয়ে মনের আনন্দে চরতে থাকে। ধীরে ধীরে রৌদ্রের তাপ বাড়তে থাকে। উত্তরের বাতাসের ধারও ধীরে ধীরে কমে আসে। গায়ের গরম জামাকাপড়গুলােকে তখন হালকা করার প্রয়ােজন অনুভূত হয়।
উপসংহার : শহরের ইট, কাঠ পাথরের নিদারুণ চাপে শীতের সকাল তার নিজস্ব মূর্তিতে প্রকাশিত হতে পারে না। এখানে কুয়াশার সে স্নিগ্ধ জুলস নেই। শহরের উদ্ধত রাজপথে শীতের রূপ কুণ্ঠিত হলেও গরম চা ও তেলে ভাজার গন্ধে তাকে সংগােপনে আত্মপ্রকাশ করতে দেখা যায়। কিন্তু শীতের সকালের প্রধান আকর্ষণ খেজুর রস কিংবা পায়েস ও পিঠে পুলি, তার জন্য শহর ছেড়ে দূরে গ্রামে যেতে হবে। সেখানেই শীতের সকাল তার সেন্দির্যের ও মাধুর্যের অনবদ্য পসরা সাজিয়ে আজও বসে আছে।
Post a Comment