SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা বাঙালি সংস্কৃতি

ভূমিকা : প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আছে। যে জাতির সংস্কৃতি যত সমৃদ্ধ তারা তত উন্নত। সংস্কৃতি জাতির মন মননজাত মানসিকতার উৎকর্ষের ব্যঞ্জনাময় প্রকাশ ও সম্মিলিত প্রয়াসের সমষ্টি। একটি জাতির যুগ-যুগান্তরের ভাবলােকের সমুন্নতির মাধ্যমে সংস্কৃতির, ধারা সৃষ্টি হয়। জাতির চিন্তা-চেতনা, ভাবধারা ও কর্মপ্রবণতার গৌরবােজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি তার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে। মানুষের আচার-আচরণ, শিক্ষা, মানস-প্রবণতা এবং পরিবেশ- প্রতিবেশের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা জীবনধারাই হচ্ছে সংস্কৃতি। কোনাে জাতির সামগ্রিক বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ ও চরমতম প্রকাশ ঘটে সংস্কৃতির মাধ্যমে। অতএব সংস্কৃতির আয়নায় ভেসে ওঠে জাতির এমন একটি মানস-প্রবণতা, অনুষ্ঠানময়তা, শিল্প-সাহিত্যের বিকাশ-উন্নতি, ধর্মের ভাব-প্রেরণা ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের চরম প্রকাশ, যা জাতির যুগ- যুগান্তরের নিরবচ্ছিন্ন সাধনার তথা অবচেতন মনের সামষ্টিক প্রয়াস।
সংস্কৃতির পরিচয় : সংস্কৃতির মধ্যে কোনা জাতির সামগ্রিকতার ও কৃতিত্বময়তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। প্রত্যেক জাতিই উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সংস্কৃতির জীবন্ত ধারা প্রতিনিয়ত নির্মাণ-বিনির্মাণ করে চলেছে। জাতীয় প্রাণময়তার সামগ্রিক অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটে সংস্কৃতির মাধ্যমে। মানুষ তার আচার-আচরণে, কথা-বার্তায়, চলনে-বলনে, পােশাক-পরিচ্ছদে, খেলাধুলায়, আনন্দ-উল্লাসে প্রতিনিয়ত বিচিত্র সংস্কৃতি-ধারা সৃষ্টি করে চলেছে। এরই মাধ্যমে সে জাতীয় সংস্কৃতির বহমানতা রক্ষা করে চলেছে অবচেতনে, অলক্ষ্যে। যে জাতির সংস্কৃতির রূপান্তর-পরিবর্তন, ক্রমবিবর্তন নেই, তাদের সংস্কৃতি মৃত হিসেবে গণ্য। কেননা গতিশীল সংস্কৃতির মাধ্যমেই জাতির প্রাণস্পন্দন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়। 
বাঙালি সংস্কৃতির উদ্ভব-বিকাশ : বাঙালি সংস্কৃতির উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের মূলে আছে এ শস্য-শ্যামলা প্রকৃতির অবারিত দাক্ষিণ্য এবং মা-মাটি-মানুষের অফুরন্ত প্রাণ-প্রাচুর্য। আর্যদের উন্নত সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ ও নিবিড় যোগ থাকা সত্ত্বেও সাফল্যমণ্ডিত অভিব্যক্তিতে এর নিজস্বতা বিকশিত হয়ে উঠেছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের গঙ্গা যেমন কোমল মাটির স্পর্শে পদ্মা ও ভাগীরথী নাম নিয়েছে, তেমনি এ উপমহাদেশীয় সাংস্কৃতিক ধারা অসংখ্য বাঙালি মনীষীর বিশুদ্ধ হৃদয়াভিব্যক্তির বিশিষ্টতায় বাঙালি সংস্কৃতি নামে স্বতন্ত্র মহিমার উজ্জ্বলতায় প্রতিভাত হয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতির অন্তরে অস্ট্রিক-দ্রাবিড়, আর্য-অনার্য, মােগল-পাঠান ও ইংরেজ সকলে ফল্পু-ধারার ন্যায় বহমান। এ দেশের মানুষ কাউকেই দূরে সরিয়ে রাখতে চায় নি কিংবা পারে নি; সবাইকে উদার-চিত্তে গ্রহণ করেছে, বিশ্বাস করেছে। এর ফলে সকল জাতির নিকট থেকে তিল তিল করে সােনা ধার করে নিয়ে নিজের তিলােত্তমা বাঙালি সংস্কৃতি নির্মাণ করেছে। এর মাঝেই বাঙালি সংস্কৃতির অনন্যতা-বিশিষ্টতা-স্বকীয়তা। 
বাঙালি সংস্কৃতির ভূ-প্রকৃতি ও পরিবেশ : বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণ-ভূমি গ্রাম। কৃষিনির্ভর এ বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনা, রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠানই তার সংস্কৃতিকে লালন ও পরিবর্ধন করেছে। প্রকৃতির অবারিত প্রসন্ন অঙ্গনেই এ সংস্কৃতির বিচিত্রমুখী অভিব্যক্তি ছিল। এখানে ষড়ঋতুর নিত্যলীলা। শুধু ঋতু-লীলাই নয়, এখানে বাংলার নৈসর্গিক সংগঠনও বিচিত্র। সােনার বাংলা, মাথায় তার হিমালয়ের কিরীট, গঙ্গা-পদ্মা-যমুনা-মেঘনা তার কণ্ঠের মালা। আবহাওয়া আর্দ্র ও শস্যশ্যামলা। ঐশ্বর্যময়ী সমতলভূমি। এখানকার শালবনে, গৈরিক ধূলিতে দিগন্তহারা প্রান্তরে লােকাতীত রহস্যের আভাস। সৃষ্টি ও ধ্বংসের লীলাচপল প্রকৃতির কোলে জীবন ও মরণের অনন্ত দোলার মধ্যে সংগ্রামশীল মানুষ। প্রকৃতির বিচিত্র মহিমাই বাংলার সংস্কৃতিকে বিশিষ্ট মর্যাদায় ভূষিত করেছে। দিয়েছে স্বতন্ত্র মানসিকতা। তারপর তার সংস্কৃতি হলাে শহরমুখী। 
বাঙালি সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য : বাঙালি কাউকেই দূরে সরিয়ে না দিয়ে সকলকেই নিজের করে গ্রহণ করেছে। সকল সংস্কৃতির ধারা থেকেই অতি যত্নে তুলে নিয়েছে একটি একটি করে অমূল্য শক্তি। তাই দিয়ে সে তার সংস্কৃতির অনুপম বিগ্রহ রচনা করেছে ; তাকে স্বতন্ত্র মর্যাদার সম্মান দিয়েছে; দিয়েছে বিশিষ্টতার অনন্য-মহিমা। বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যেই রয়েছে আত্মীয়করণের প্রাণশক্তি। অফুরন্ত প্রাণ-প্রাচুর্যই তার  সংস্কৃতির সৃষ্টি ও বিকাশের মূল। তাই বৈদিক যাগযজ্ঞ সে যেমন গ্রহণ করেছে, তেমনি অনার্য পৌত্তলিকতাকেও সে বর্জন করে নি। ইসলামের ভ্রাতৃত্ববােধ গ্রহণেও সে যেমন কুণ্ঠাহীন, তেমনি বৈষ্ণব প্রেমগীতিও তার কাছে এক প্রার্থিত সম্পদ। 
ধর্ম ও সংস্কৃতি : ধর্ম সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণবস্তু। বাঙালি সংস্কৃতির মূলেও আছে এক সুগভীর ধর্মবােধ, ধর্মপ্রাণতা। ধর্মই তার সমাজের অন্যতম নিয়ন্ত্রণশক্তি। ধর্মকে আশ্রয় করেই তার সংস্কৃতির বিকাশ ও সমৃদ্ধি। লৌকিক ও পৌরাণিক যুগলবন্দিতে সেই ধর্মের পূর্ণতা। পারস্পরিক বিরােধ নয়, বরং সমন্বয়ের বিশ্বাসেই সুবিশাল সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। 
বাংলা লােকসাহিত্য ও সংস্কৃতি : বাঙালি তার মনের রুদ্ধ দুয়ার খুলে দিয়েছে বাংলার লােকসাহিত্যে। শিবায়ন-মঙ্গলকাব্যে, ময়নামতি- গােপীচন্দ্রের গানে, ব্রত-পার্বণ-ছড়া-যাত্রাপালায়-কবিগানে, সারি-জারি বাউল-কীর্তন-ভাটিয়ালি-গম্ভীরায় বাঙালি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। ফুল্লরা-খুল্লনা, মেনকা-ইমা, কালু-লখ্যা, মহুয়া-মলুয়া, চন্দ্রধর-সনকা, বেহুলা-লখিন্দরের মতাে কত চরিত্রই তাে বাঙালি তার মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃষ্টি করেছে। এদের আশ্রয় করেই বাঙালির অশু-উৎস হয়েছে অবারিত। নবমী রজনী শেষে মা মেনকার আর্তি তা প্রতিটি বাঙালি মায়েরই তনয়া- বিরহের সকরুণ হাহাকার। মহুয়া-মলুয়া, লীলা-কক উপাখ্যান বাঙালির অনন্ত বিরহ-বেদনার অশ্রুময় চিত্র। বেহুলার সকরুণ বিলাপে কত না  অশ্রু বিসর্জিত হয়েছে বাঙালির।
কারুশিল্প ও সংস্কৃতি : বাঙালি সংস্কৃতির অমিত স্বাক্ষর তার পট-অঙ্কনে, গৃহনির্মাণ পদ্ধতিতে, মৃৎশিল্পে, অলংকার শিল্পের সুনিপুণ কারুকার্যে, চাল- চিত্রের রঙে-রেখায়, আল্পনায়, গৃহশয্যায়। বাঙালি কারিগরের মতাে আটচালা নির্মাণের নৈপুণ্য আর কারাে নেই। বাংলার মেয়েদের আঁকা নকশি-কাঁথা আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এ ছাড়া হাঁড়ি, কলসি, বাসন ও বস্ত্রের সূক্ষ্ম শিল্পকর্মে, স্বর্ণকারের জড়ােয়া শিল্পে, শাঁখারীর শঙ্খশিল্প-কর্মে, শীতলপাটি, জাদুর মােড়া ও আসন তৈরিতে বাঙালি সংস্কৃতির রয়েছে স্মরণীয় পরিচিতি। তার ঢাক-ঢােল-মৃদঙ্গেও সংস্কৃতির অনন্য স্বাক্ষর
আধুনিক যুগ ও বাংলা সংস্কৃতি : ইংরেজদের আগমনের মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির আধুনিক যুগের সূত্রপাত ঘটে। বাঙালি গ্রহণ করে ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির ধারার প্রয়ােজনীয় উপকরণ। রাজা রামমােহন রায় প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ভাবধারার সংমিশ্রণে বাঙালির মনে নতুন ভারতবর্ষের সৃষ্টি করলেন। এ সময় বাঙালির জীবনে নতুন সংস্কৃতির জোয়ার এসেছিল। এসেছিল নবজাগরণের সুপ্রভাত । শিক্ষা দীক্ষায়, সমাজ-সংস্কারে, শিল্পে-সাহিত্যে, ধর্মে-কর্মে নতুন উদ্যম- উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল। ডিরােজিও, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, ভূদেব, বঙ্কিম, শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ মনীষী বাঙালি জাতিকে উদার ও বৃহত্তর মানবিকতার মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন‌।
বাঙালি সংস্কৃতির সংকট : অবশেষে বঙ্গ-সংস্কৃতির জীবনে এল সংকটমুহূর্ত। এল অন্ধকারের কালরাত্রি। অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা সে হারাল । বিশ্বাসবােধে লাগল ভাঙনের প্রচণ্ড আঘাত। অনুকরণ-প্রিয়তার কারণেই এখন এদেশে পাশ্চাত্য-সংস্কৃতির আগ্রাসন চলছে। অবশ্য বিশ্বব্যাপী যন্ত্র-সভ্যতার বিষ-নিঃশ্বাস ছড়িয়ে পড়ায়, বাঙালি সংস্কৃতি এ রকমের অপসংস্কৃতির কবলে পড়েছে। সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া বিকৃতি সমগ্র বাঙালি জাতিকে যেন গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে। সাহিত্যের নামে এক ধরনের কুরুচিপূর্ণ রচনায় বাজার ভরে গেছে। এখন অবলীলায় ধর্মের নামে লােক দেখানাে আচার-অনুষ্ঠানের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। তা ছাড়া শিক্ষার নামে কু-শিক্ষা তাে আছেই। আরও আছে সমাজ-সেবার নামে সামাজিক-কোন্দল, সংগীতের নামে উৎকট হৈ-হুল্লোড়, পােশাক-পরিচ্ছদের নামে হাস্যকর-কদাকার বেশভূষণ যা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিকে গ্লানিময় করে তুলেছে। 
উপসংহার : সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলার মাটি রাজনৈতিক ঝড়ঝঞ্চায় বিক্ষুব্ধ, নিপীড়িত, অত্যাচারিত, নির্যাতিত, শােষিত হয়েছে বারবার। তারপরও বাঙালি জাতি নির্ভীক চিত্তে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। কিন্তু এরপরও নতুন করে এ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মুখে পড়ে বাঙালির অস্তিত্ব বিপন্নপ্রায়। তবে অল্প-সময়ের মাধ্যেই বাঙালি জাতি আবার জেগে উঠতে সক্ষম হবে; কেননা এরা সহজাতভাবেই সংগ্রাম-মনস্ক। আমাদের বিশ্বাস হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ বাঙালির সংস্কৃতি অবশ্যই যুগ বাস্তবতার প্রেক্ষিতে নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে সক্ষম হবে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment