SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা একটি বর্ষণমুখর রাত

ভূমিকা:
নীল আকাশ কালাে মেঘে ছেয়ে আছে। সারাদিন অবিশ্রান্ত বৃষ্টি। বিকেলের এক ঝলক রােদের পরে আবারও জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। মেঘ। বিষন্ন সন্ধ্যায় মেঘাবৃত আকাশ। রাতে মেঘের গুরু-গর্জনে ও আকাশের বিদ্যুৎ-চমকানির মধ্যে দিয়ে অন্ধকার পৃথিবী যেন হঠাৎ আলাের ঝলকানিতে মুখর হয়ে ওঠছে; বষর্ণমুখর রাতের এ এক দুর্লভ রূপ। রাতের আগমন: প্রকৃতি আবছা অন্ধকারে ক্রমে অস্পষ্ট ও অদৃশ্য হতে শুরু করায় বুঝতে পারলাম রাত নেমে আসছে । আকাশে মেঘের ঘনঘাটায় রাত যেন আজ আগেই হাজির হয়েছে। মানুষের কর্মব্যস্ততা নেই। থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ায় সকলে ঘরের ভেতর আবদ্ধ। প্রকৃতি যেন আজ বেশি নিস্তব্ধ, নিথর। শ্রাবণের বর্ষণমুখর দিবাবসানে একসময় আঁধার ঘনীভূত হয়ে আসে। রিমঝিম শব্দ অঝাের ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। অবিশ্রান্ত বর্ষণের সুরলহরিতে মনটা তন্ময় হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতাে তাই বলতে ইচ্ছে করে-
'এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘন ঘাের বরিষায়।'
প্রকৃতির বিষন্নতা: বর্ষণ রজনী শ্রাবণ-সন্ধ্যা; গ্রামান্তের পথ নির্জন; প্রকৃতির কোলজুড়ে বিষন্নতা। কোথাও যেন প্রিয়জন হারানাের আর্তনাদ বেদনায় অন্তলীন বাদল বাতাসের দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে যেন তার চোখের জল ঝরে পড়ছে। প্রকৃতির এমন বেদনাবিধুর ক্ষণে কিছুতেই ঘর থেকে বাইরে যেতে ইচ্ছে করে না। পৃথিবীর এ বিষণ্নবেলায় রবি ঠাকুরের সেই বাণী মনে পড়ে যায়- 
'ওগাে আজ তােরা যাসনে ঘরের বাহিরে।' 
বৃষ্টি পতনধ্বনির ভাষা: ভাষাহীন অন্ধকারে বৃষ্টিপাতের অবিরাম শব্দ যেন বােবা প্রকৃতির বহুদিনের সংগীতমুখর অব্যক্ত ভাষা। যেন হঠাৎ নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গের পর অবিরাম নূপুরের ছন্দ তুলে বয়ে চলা। জানালার পাশে বসে বৃষ্টি-পতনের এ ধ্বনি কার না হৃদয়ে সংগীতের সুরমূর্ধনা জাগায়। কার না হৃদয়ে কাব্যের অনুভূতি দোলা দেয়। 
মেঘদূতের ভাষা: শ্রাবণ-রজনীর ভাষা যেন কালিদাসের মেঘদূতেরই ভাষা। বর্ষণমুখর রাত্রী আমাকে জনশূন্য শৈলশৃঙ্গের শিলাতলে সঙ্গীহীন করে ছেড়ে দেয়। সেই পৃথিবীর বনে-বনে, গ্রামে-গ্রামে, শৃঙ্গে-শৃঙ্গে, নদীর কূলে-কূলে ফিরতে ফিরতে অপরিচিত সুন্দরের পরিচয় নিতে উৎসুক হয়ে ওঠে মন। বৃষ্টিবিষন্ন নির্জনপথে দু-এক জন পথচারীর ছুটে চলা, থেকে থেকে গুরুগম্ভীর বজ্র নিনাদ আর পথের পাশে ডােবার ধারে ব্যাঙের ডাক যেন এ শ্রাবণ-রজনীর হৃদয়ের ব্যথিত সংগীত। 
রাতের সৌন্দর্য উপভােগ: ধীরে ধীরে রাত নেমে আসে। রাতের শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশ ভেঙে টিনের চালে, উঠানের বুকে পত্র-পল্লবে শ্রাবণধারা প্রবল বেগে নিনাদ বাজিয়ে অঝােরে ঝরতে থাকে। পরীক্ষার পড়ার জন্যে বই নিয়ে বসলাম কিন্তু মন বসাতে পারলাম না। এমন দিন প্রকৃতির কবি রবীন্দ্রনাথের 'সঞ্চয়িতা' নিয়ে বর্ষার কবিতাগুলাে পড়তে ইচ্ছা হলাে। আমার মন আশ্রয় খুঁজে পেতে চাইল 'ছিন্নপত্র'-এর পাতায় পাতায় -
এ সময় গৃহত্যাগী মন আমার মুক্তগতি মেঘপৃষ্ঠে নিয়েছে আসন। আমার ছিন্নবাঁধা পলাতক এ মন লঘুপক্ষ হংস বলাকার মতাে মেঘের সঙ্গী হয়ে দিক থেকে দিগন্তে ঘুরে বেড়ায়। কোথাওবা বৃষ্টিস্নাত শ্যামলী ধবলী গােহালে প্রত্যাগমনরত, কোথাওবা নিঃসঙ্গ পথিক ওপারে যাবে বলে বর্ষণস্ফীত নদীতীরে মাঝিকে ঘন ঘন ডাকছে। আমি ঠিক বলতে পারি না, ঠিক এমন বৃষ্টিস্নাত রাতের কবি শেলী Ode to the west wind' কিংবা রবীন্দ্রনাথ বর্ষা’ কবিতা লিখেছেন কিনা। এ কথা সত্য যে, এমন দিনে বর্ষার কবিতা লিখার জন্যে মনে ভাব জাগে। কিন্তু স্যাতসেঁতে মন নিয়ে আমি যখন মেঘের কোলে ঘুরে বেড়াই সেই বিশেষ মুহর্তে কবিতা লেখার কথা ভুলে যাই। অবশ্য এমনও হতে পারে যে, এ কাজল-কালাে মেঘের রূপ দেখে কুঁচবরণ কন্যার মেঘবরণ কেশ মনে পড়তে পারে। বাদলের ঝরঝর ধারা কারও অশ্রুধারার মতাে মনে হতে পারে এবং বিশেষ মনােভাবের বাহ্যিক প্রকাশ হতে পারে কবিতায়। কিন্তু আমার মনে কবিতা রচনার কোনাে অনুপ্রেরণা দেখি না। আমি দেখছি রাতের আকাশ মেঘে মেঘে ছেয়ে গেছে। তারার মালা গেছে ছিড়ে, তার চিহ্ন পর্যন্ত নেই। তবে কবিরা বর্ষার প্রেমিক। বর্ষার বর্ষণ ধারার মধ্যেও দৃষ্টি তাদের প্রসারিত। অনুভবের দশ-দিগন্ত হতে বৃস্টিস্নাত এ রাতে কবির দু-একটি কবিতা মুক্তি পেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে বর্ষণমুখর অন্ধকারে সুন্দরের জোনাক জ্বলে এ কথা অস্বীকার করতে পারি না। বর্ষণমুখর রাতের এ সৌন্দর্যমণ্ডিত রূপটি উপভােগ্য, ভুলে যাওয়ার নয়। 
কাব্যে শ্রাবণ-রাত্রী: কবিদের দৃষ্টিতে শ্রাবণ-রাত্রী ভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে উপস্থিত হয়। বর্ষা কবিদের মনে নতুন শিহরণ জাগায়। তাই তারা বর্ষাকে নিয়ে রচনা করেন অসংখ্য কবিতা। বৃষ্টিসিক্ত বর্ষার রূপ তারা শিল্পসৌন্দর্যে মণ্ডিত করে কবিতায় তুলে ধরেন। বর্ষণমুখর রজনীর দৃশ্য, অনুভূতি সাধারণ মানুষ ও কবির মাঝে আলাদা বৈশিষ্ট্যে ধরা দেয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বর্ষার বাস্তবচিত্র তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন এভাবে- 
'নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে 
তিল ঠাই আর নাহিরে।' 
উপসংহার: পরীক্ষা সমাগত, আলাে জ্বালিয়ে তাই পড়তে বসি। বাইরে অবিশ্রান্ত পত্র-মর্মরে বাদল-বাতাসের হা-হুতাশ। কিন্তু পড়ায় আর মন বসে না। বৈষ্ণব কবির সুললিত কবিতাটির কথা মনে পড়ে যায়- 
'রজনী শাওন ঘন ঘন দেয়া গরজন 
রিমিঝিমি শব্দে বরিষে 
পালঙ্কে শয়ান রঙ্গে বিগলিত চির অঙ্গে 
নিন্দ যাই মনের হরিষে।'

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment