বা প্রতিভা ও সম্পদ
বা বাংলাদেশের প্রতিভা
বা প্রতিভা বিকাশের অন্তরায়
ভূমিকা : আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। পবিত্র কুরআন শরীফে মানুষকে 'আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অবশ্য সব মানুষের বুদ্ধি একরকম নয়। বুদ্ধির তারতম্যের ভিত্তিতে মানুষের প্রতিভার মূল্যায়ন করা হয়। তবে 'প্রতিভা শব্দটা কেবল মানুষের জন্যেই প্রযােজ্য। প্রতিভাবান ব্যক্তি পৃথিবীতে প্রতিদিন আসেন না, কালে ভদ্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি সবসময় দেশ ও জাতির গৌরব। প্রতিভা কি : 'প্রতিভা একটা গুরুত্বপূর্ণ শব্দ যার অর্থ হল সতীক্ষ্ম বদ্ধি বা ‘উদ্ভাবনী শক্তি। এ শক্তি সকলের সমানভাবে থাকে না। এজন্যেই একই সময়ে একটা দেশে খুব বেশি প্রতিভাবান লােকের জন্ম হয় না। প্রতিভাধর ব্যক্তিরা অপূর্ব নজ চিন্তাশক্তিসম্পন্ন প্রজ্ঞার অধিকারী হয়ে থাকেন। এজন্যেই প্রতিভাবানদের ক্ষণজন্মা মহান ব্যক্তি বলা হয়ে থাকে।
মানুষ ও প্রতিভা : মানুষের জন্মের আদি ইতিহাস অনুমানের উপর নির্ভরশীল। সভ্যতার সূচনাকাল থেকেই মানুষ তার বুদ্ধি, বিবেচনা, প্রজ্ঞা ও নানা কৌশল প্রয়ােগ করে পৃথিবীতে নিজ নিজ শ্রেষ্ঠত্বের দূষ্টান্ত রেখে আসছে। পৃথিবীতে যতরকম ভালাে দৃষ্টান্ত আছে তার সবকিছুতেই রয়েছে মানুষের মেধা ও বুদ্ধির পরিচয়। মানুষ তার বুদ্ধি বলে পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্ট জীবের উপর তার প্রাধান্য বিস্তার করে আসছে। কারও কারও মতে, প্রতিভা একটা প্রকৃতিগত বিষয়। আবার কেউ কেউ মনে করেন। কঠোর সাধনার দ্বারা প্রতিভা অর্জিত হয়। নানা জনের নানা মত থাকলেও একটা কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, প্রকৃত প্রতিভা ইচ্ছা করলেই তৈরি করা যায় না, যদি সৃষ্টিকর্তা বা আল্লাহ কাউকে দান না করেন। যে কেউ ইচ্ছে করলেই শেক্সপীয়র, সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, আলাওল, মুকুন্দরাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল ইসলাম হতে পারেন না। তবে প্রতিভার যথাযথ বিকাশ ঘটে সাধনার মাধ্যমে। যদি বুদ্ধি, মেধা, প্রজ্ঞা ইত্যাদি থাকে তবে সাধনার দ্বারা তা বাস্তবে রূপায়িত হয়। কারও মেধা কম থাকতে পারে, কিন্তু কঠোর পরিশ্রম বা নিবিড় সাধনার সাহায্যে তা দূষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পৃথিবীতে এমনি অনেক দৃষ্টান্ত উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাই প্রতিভার সাথে মানুষের সাধনার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড।
প্রতিভা বিকাশের পথ : 'সাধনা প্রতিভা বিকাশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পথ। পৃথিবীতে যারা কর্ম বুদ্ধি নিয়ে জন্মেছেন, তারাও তাদের একনিষ্ঠ সাধনার দ্বারা অনেক দৃষ্টান্তমূলক সৃষ্টি কর্ম রেখে গেছেন। বুদ্ধির চর্চাই মানুষকে অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে আলাদা এবং শ্রেষ্ঠ জীবে পরিণত করেছে। কিন্তু প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেও মানুষ যদি অলস হয়, যদি পরিশম না করে তবে তার প্রতিভার স্ফুরণ ঘটবে না। এভাবে নিজের মেধা ও শক্তির উপর আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তখন আর তার কাছ থেকে জাতির কল্যাণ বা মহৎ কিছু আশা করা যায় না। তাই ঘুমন্ত প্রতিভাকে উজ্জ্বল করে তােলার জন্যে নিবিড় সাধনা প্রয়ােজন। সাধনাই প্রতিভাকে বিকশিত হওয়ার সুযোেগ বা পথ করে দেয়। এ প্রসঙ্গে আমরা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম করতে পারি। কঠিন দারিদ্র্য আর প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে বসবাস করেও তিনি একনিষ্ঠ সাধনার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন। কথিত আছে যে, রাস্তার লাইটপােরস্টের নিচে দাড়িয়ে তিনি পড়াশােনা করেছেন। সে পরিশ্রমের আলােই তার জীবনকে আলােকিত করেছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। আবার মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্মগতভাবে প্রতিভাবান হয়েও মাতৃভাষার প্রতি অনীহা প্রদর্শন করতে গিয়ে মাঝপথে স্তিমিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু যখন তিনি অনীহার পথ পরিহার করে সঠিক সাধনায় সক্রিয় হয়েছেন তখন আমরা অল্পকালের মধ্যে পেয়ে গেলাম বাংলা সাহিত্যের একমাত্র সার্থক মহাকাব্য মেঘনাদবধ কাব্য এবং অপূর্ব সৃষ্টি 'চতুর্দশপদী কবিতাবলি। সাধনার ক্ষেত্রে এ এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত। ভূগ্ভস্থ কয়লা খনিতেও হীরক খণ্ড থাকে, তা যদি উত্তোলন করা না হয় তবে তার যেমন কোন কার্যকারিতা নেই, প্রতিভার ক্ষেত্রেও তাই। সাধনাহীন প্রতিভা কয়লা খনিতে লুকিয়ে থাকা হীরকখণ্ডের মত। কাজেই সাধনাই প্রতিভা বিকাশের একমাত্র পথ।
প্রতিভা বিকাশের অন্তরায় : সব দেশে সর্বকালেই কিছু মানুষ প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবেশ এবং সাধনার সাহায্যে তা বিকশিত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে প্রতিভা বিকাশের যথাযোেগ্য পরিবেশ পরিস্থিতি নেই। তাই আমাদের দেশে প্রতিভাধরদের যথাযােগ্য মূল্যায়ন হয় না। তাছাড়া বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলাের মধ্যে বাংলাদেশ বিশেষভাবে অন্যতম। এখানে রয়েছে চরম বেকার সমস্যা। ফলে বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং অত্যাবশ্যক প্রযুক্তির অভাব প্রতিভা বিকাশের অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। যতদিন পর্যন্ত আমাদের দেশ থেকে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য দূর না হবে ততদিন পর্যন্ত অনেক প্রতিভাই ধ্বংস হয়ে যাবে।
প্রতিভার দৃষ্টান্ত : প্রতিভার একটা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিদ্যমান। সে অস্তিতের সফল রূপায়ণের জন্যে পরিবেশ, পরিস্থাত এবং সাধনা দরকার। সাধনার দ্বারা প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে পৃথিবীতে যারা অমর হয়ে আছেন তাঁদের মধ্যে হােমার, শেঙ্গপারির, সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, আইজ্যাক নিউটন, গ্যালিলিও, মার্কোনি, আলভা এডিসন প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। বাংলা ভাষায় মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম তাদের প্রতিভার সাথে সাধনার সমন্বয় ঘটিয়ে অম্লান দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। পটুয়া কামরুল হাসান ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আমাদের দেশের চিত্রশিল্পের গৌরব। এমনি আরও অনেক প্রতিভার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
উপসংহার: সবশেষে একথা বলা যায় যে, সব মানুষই প্রতিভাধর নয়, যুগে যুগে অল্পসংখ্যক প্রতিভাধর ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেন। আর সমাজ তথা দেশের অনুকূল পরিবেশ পরিস্থিতি এবং সাধনার দ্বারা তা বিকশিত হয়। যে জাতির মধ্যে যত বেশি প্রতিভার বিকাশ ঘটবে সে জাতি ততই সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে।
Post a Comment