বা জনসংখ্যা বিস্ফোরণ
ভূমিকা: বর্তমান বিশ্বে অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে জনসংখ্যা সমস্যা। জনসংখ্যার এ অবিশ্বাস্য গতি বৃদ্ধির দরুন একে আজ জনসংখ্যা বিস্ফোরণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ জনসংখ্যা বিস্ফোরণ প্রতিটি দেশের উন্নতির প্রধান অন্তরায়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতােই বাংলাদেশের প্রধান সমস্যাগুলাের মধ্যে জনসংখ্যা সমস্যা অন্যতম। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও প্রধান সমস্যা হলাে এ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা সমস্যা। এ কারণে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় পরিসংখ্যানে জনসংখ্যা সমস্যাকে এক নম্বর সমস্যা বলে অভিহিত করেছে।
বিশ্ব জনসংখ্যা: জাতিসংঘের এক হিসাব অনুযায়ী ১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বের লােকসংখ্যা ছিল ১০০ কোটি। এভাবে ক্রমহারে ১৯৯৯ সালে বিশ্বের লােকসংখ্যা ৬০০ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। অধিকন্তু পৃথিবীর জায়গা বাড়েনি, বেড়ে চলেছে মানুষ। বর্তমানে পৃথিবীতে জনসংখ্যার যে উর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে তাতে বিশ্বের জনসংখ্যা ৭০০ কোটির বেশি হতে পারে।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা সমস্যা: বর্তমানে জনসংখ্যা সমস্যা বাংলাদেশে জাতীয় সমস্যা। জীবনধারণের জন্য মানুষের যেসমস্ত মৌলিক চাহিদা রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান হলাে— খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। এভাবে দুতহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলাে মেটানাে ক্রমশ দুরূহ হয়ে পড়ছে। ফলে আমাদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে বাংলাদেশের মতাে ক্ষুদ্র দেশের পক্ষে এটি একটি ভয়াবহ সমস্যায় পরিণত হবে।
বাংলাদেশের অবস্থা ও ভয়াবহতা: বাংলাদেশ বিশ্বের সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত। মাত্র ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলােমিটার আয়তনের মধ্যে ১৫ কোটির বেশি জনসংখ্যা বাস করে। ২০০৯ সালে আদমশুমারি অনুযায়ী প্রতি বর্গকিলােমিটারে ১০৯৯ জন বাস করে এবং প্রতি মিনিটে বাংলাদেশে ৪টি শিশু জন্মগ্রহণ করে। এরূপ চলতে থাকলে আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ২০ কোটি। আমাদের দেশের ৮৫% লােক গ্রামীণ পরিবেশে জীবন কাটায়। শহরের তুলনায় গ্রামে শিক্ষার পরিবেশ নেই বললেই চলে। শিক্ষার আলাে না পাওয়ায় শহরের তুলনায় গ্রামে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি। গ্রামের সহজ-সরল জনগণ ধর্মীয় কুসংস্কারে জন্ম-নিয়ন্ত্রণের আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণ করছে না। ফলে আমাদের জনসংখ্যা-বিস্ফোরণ দেশের অগ্রগতির পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির অসুবিধা: মানুষ স্বভাবতই জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। আর তার জীবিকার সংস্থান বাড়ে গাণিতিক হারে। ফলে দেশে ব্যাপকভাবে দেখা দেয় দারিদ্র্য আর খাদ্যাভাব। জনসংখ্যা সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে বেকার সমস্যাও প্রকটভাবে দেখা দেয়। দেশের শিক্ষিত যুবকের আধিক্য থাকা সত্ত্বেও জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারণে তাদেরকে বেকার থাকতে হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বর্ধিত জনগণের জন্যে আবাদি জমিগুলাের ওপর ঘরবাড়ি তৈরির চাপ বাড়ছে। ফলে ক্রমশ কৃষিযােগ্য জমি হ্রাস পাচ্ছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ: এখানকার মানুষ জলবায়ুগত কারণে অল্পবয়সেই যৌবনপ্রাপ্ত হয়। এদেশের অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ অতিঅল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়, ফলে স্বাভাবিক কারণেই মেয়েদের অধিক সন্তানের মা হতে হয়। শিক্ষা হচ্ছে সভ্যতার প্রথম লক্ষণ। আর আমাদের দেশে সিংহভাগ মানুষ অশিক্ষিত বলে তারা জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সচেতন নয়। ফলে অধিক হারে সন্তান জন্মদানের ব্যাপার নিয়ে মাথাব্যথা নেই। বাংলাদেশের বেশিরভাগ লােক নিরক্ষর ও ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বিশ্বাসী। ফলে এসব কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ পরিবার পরিকল্পনাকে ধর্মীয় নীতিবিরুদ্ধ মনে করে এটি গ্রহণ করছে না। এছাড়াও বৃদ্ধ বয়সে নিরাপত্তার প্রত্যাশা, শিশুমৃত্যুর উচ্চহার, চিত্তবিনােদনের অভাব, নারী স্বাধীনতার অভাব, জীবনযাত্রার নিম্নমান, দারিদ্র্য, কৃষিপ্রধান অর্থনীতি, জন্মনিয়ন্ত্রণের সুষ্ঠু পদ্ধতির অভাব প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশে উচ্চহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের উপায়: বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বৃহৎ পরিকল্পনার মাধ্যমে হওয়া চাই। তাই প্রতিটি পরিকল্পনা হওয়া চাই দীর্ঘমেয়াদি। নিম্নে জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের কয়েকটি উপায় বর্ণিত হলাে
শিক্ষা: জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথমেই দরকার দেশের জনগণকে শিক্ষিত করে তােলা। জনগণকে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল সম্পর্কে জ্ঞানদান করে, সচেতন করে তুলতে হবে। নারীশিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে নারীসমাজকে রােধের আবশ্যকতা সম্পর্কে . সচেতন করে তুলতে হবে। শিক্ষার মাধ্যমে ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে জনগণকে মুক্ত করে সুষ্ঠু পরিবার-পরিকল্পনা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
আইন-প্রণয়ন: জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সরকারিভাবে আইন প্রণয়ন করা উচিত। আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বিয়ের ন্যূনতম বয়স বৃদ্ধি ও তা বলবৎ করে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রােধ করতে হবে।
সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও জনসংখ্যার পুন:বণ্টন: দেশে প্রাপ্ত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে সকল জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সকলের আয় বাড়াতে হবে। পুনর্বণ্টনের মাধ্যমেও জনসংখ্যা সমস্যার কিছুটা সমাধান করা যেতে পারে।
জাতীয় আয়ের পুনর্বণ্টন: জাতীয় আয়ের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে জনগণের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে এবং জনসংখ্যা সমস্যা কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি: অর্থনৈতিক উন্নতি হলে জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে এবং জন্মনিয়ন্ত্রণের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটবে। কৃষি ও শিল্পখাতে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ: জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সরকারের উদ্যোগই প্রধান। এছাড়া বিভিন্ন এনজিও ও বেসরকারি সংস্থারও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কাজ করা উচিত।
উপসংহার: বাংলাদেশের মতাে একটি উন্নয়নশীল দেশকে আত্মনির্ভরশীল উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে হলে সর্বাগ্রে এর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জনসংখ্যা সমস্যা সমাধান করতে গেলে দেশের জনগণকে অধিক জনসংখ্যার কুফল সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। জনসংখ্যা সমাধানের মধ্যেই আমাদের জাতীয় অগ্রগতির মূল সূত্র নিহিত।
Post a Comment