SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাস

প্রাকৃতিক গ্যাস ‌: সম্ভাবনা ও আশঙ্কা
বা প্রাকৃতিক গ্যাস ও বাংলাদেশের উন্নয়ন
ভূমিকা : আমাদের মত দরিদ্র দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস আবিষ্কারের মাঝে দারিদ্র্য-বিমােচনের এমন প্রতিশুতিশীল সুযােগ বাংলাদেশ কখনও পায়নি।
সরন্ধ্র ও তরল পদার্থ প্রবহমানযােগ্য হাইড্রোকার্বনবাহী বালুকাস্তর সমৃদ্ধ পৃথিবীর সুবৃহৎ ব-দ্বীপ এলাকা বাংলাদেশে রয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক গ্যাস। পরীক্ষিত গ্যাস মজুদ হচ্ছে ২৩ টিসিএফ। এ গ্যাস মজুদের পরিমাণ ৬০ টিসিএফ পর্যন্ত উন্নীত হতে পারে। মাথা পিছু প্রায় ১২৫ কেজিওই কিলােগ্রাম ওয়েল ইকুয়িভ্যালেন্ট) জ্বালানি ব্যবহারের হার পৃথিবীর নিম্নতম পর্যায়ের। এখন তা দ্রুত বাড়ছে। জ্বালানি চাহিদার ৭০ শতাংশ সরবরাহ করছে প্রাকৃতিক গ্যাস। প্রাকৃতিক গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়, যা প্রায় ৫০ শতাংশ। নাইট্রোজেন সার উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় প্রায় ৩০ শতাংশ, অবশিষ্টাংশ ব্যবহৃত হয় উৎপাদনকারী শিল্পকারখানায় ও গৃহস্থালি জ্বালানি হিসেবে। বর্তমানে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারের হার প্রায় ১ হাজার এমএমসিএফডি। আশা করা হচ্ছে, ২০০৫ সালের মধ্যে এ হার ১ হাজার ৫০০ এমএমসিএফডিতে উন্নীত হবে।
তথাপি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে জ্বালানি-স্বল্পতার কারণে। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বাের্ড মাত্র ৪৯ দিন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সক্ষম হয়েছে। যেখানে ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছে। ১৪ কোটি মানুষের একটি দেশে রয়েছে মারাত্মক বায়ুদূষণ, বিশেষ করে ২ স্ট্রোক ইঞ্জিন ব্যবহারকারী শহরগুলাের বাণিজ্যিক যান, নৌযান, ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল ব্যবহারকারী ও কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনকারী ট্রেন যা আমদানি বিলকে ক্রমাগত বাড়িয়ে নিয়ে গেছে এক উঁচু পর্যায়ে। ভৌগােলিকভাবে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল , পূর্বাঞ্চল (যেখানে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে) থেকে দুটি বিশাল নদী ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা দ্বারা বিচ্ছিন্ন ও তুলনামূলকভাবে পূর্বাঞ্চলের তুলনায় দরিদ্র। ভারতের দূরবর্তী অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত পশ্চিমাঞ্চল বন্যার দুর্যোগ থেকে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ এ এলাকার প্রভূত উন্নতি সাধন করতে পারে। 
প্রাকৃতিক গ্যাস হচ্ছে প্রবৃদ্ধির চাকা : বিনিয়ােগের সর্বকালীন অভাব বর্তমান বিপর্যয়ের কারণ, এর সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের অব্যবস্থাপনা দেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে ব্যাহত করছে। সুখবর হচ্ছে, ১৯৯৩ সালে পাঁচটি এবং সম্প্রতি দ্বিতীয় দফা দরপত্র আহবানের মাধ্যমে আরাে একটি ও প্রত্যাশিত পাঁচটি প্রােডাকশন শেয়ারিং কনট্রাষ্ট-এ স্াক্ষর করা বাংলাদেশ সরকারের বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। এর ফলে বিপুল বিনিয়ােগ সম্ভাবনা, প্রযুক্তিগত ও ব্যবস্থাপনা জ্ঞান নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে শেল, ইউনিকল, কেয়ান এনার্জি, ইউএমআইসি, রেক্সউড, অক্সিডেন্টালের মত শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলাে। এখন আশা করা হচ্ছে, ১০ বছর ব্যাপ্তিকালের মধ্যে পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি বুভুক্ষু ভারতকে রপ্তানি করার মত এমনকি ১০ টিএসএফ প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ আমাদের রয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ১ হাজার ৫৫০ মেগাওয়ার্ট পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার মধ্যে ৩০০ মেগাওয়াট সঞ্চালন খাতে চলে এসেছে। একটি নতুন বেসরকারি খাত বিদ্যুৎ উৎপাদন পলিসি ১৯৯৬ সালে প্রণীত হয়েছে। 
সামনের পথ : সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে গ্যাস অনুসন্ধান ও বাজারে সঞ্চালনই হচ্ছে আমাদের চাবিকাঠি। ভূগর্ভস্থ গ্যাস নিঃসন্দেহে একটি সম্পদ। কিন্তু এতে তাৎক্ষণিক কোন অর্থনৈতিক সুফল নেই। আজকের অর্থ-সম্পদ আগামীকালের অর্থ- সম্পদের চেয়ে অনেক মূল্যবান। নিম্নবর্ণিত বিষয়সমূহের নজর দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে। 
প্রােডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট (পিএসসি) : বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োেগ সামর্থ্যের অভাবের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলাের সঙ্গে পিএসসি স্বাক্ষরই হচ্ছে সঠিক উপায়। এটা অবশ্য বিবেচ্য যে, চুক্তির শর্তাবলি একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমান চুক্তিগুলাে হচ্ছে অপ্রচলিত এবং সেগুলাে প্রকৃত অবস্থার চিত্র বহন করে না। দুই দশক আগে উদ্ভাবিত এ চুক্তিগুলাে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলােকে বিনিময় সুবিধা পাওয়া ছাড়াই অনেক ছাড় দিচ্ছে। অশান্ত মধ্য এশিয়া, স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জ সমস্যা তৈরি হতে পারে। আজকের দুনিয়ায় সংঘাতের একক মূল কারণ হচ্ছে জ্বালানি। এতে প্রাকৃতিক গ্যাসের গুরুত্ব প্রাকৃতিক গ্যাস হচ্ছে সর্বাধিক পরিবেশ অনুকূল জীবাশ্ম জ্বালানি। কিয়ােটা প্রটোকলে স্বাক্ষরদাতাদের কয়লা ও জ্বালানি তেল প্রতীয়মান হয়। ব্যবহারের জন্য আরাে অধিক হারে মূল্য দেওয়া উচিত। কারণ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন হ্রাসের দায়িত্ব তাদের উপরেই বর্তায়। এর ফলে আগামী দিনের প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা বাড়বে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত জ্বালানি-বুভুক্ষু এবং তাদের জ্বালানি চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিবছর ৭ শতাংশ হারে। ১০০ কোটি মানুষের এক বিশাল দেশ, তার জ্বালানি চাহিদাও বিপুল এবং এ অবস্থা বিদ্যমান থাকার সম্ভাবনাই বেশি। আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিসমূহের সাথে চুক্তি সম্পাদনের সময় উপরােক্ত বিষয়গুলাে আলােচনাকারীদের বিশেষ করে মনে রাখতে হবে, সে সাথে এ বাস্তবতাটুকুও মনে রাখতে হবে যে, আমাদের আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলাের পুঁজি বিনিয়ােগ ও প্রযুক্তির দরকার। 
বিদ্যুতায়ন : আইনগত কাঠামাের আওতায় বাংলাদেশ সরকারের বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন পলিসি প্রাকৃতিক গ্যাসকে সাধারণ্যে সর্বাধিক ব্যবহৃত জ্বালানি বিদ্যুতে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে একটি প্রশংসনীয় আশ্বাস হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের জ্বালানি পলিসির সাধারণ প্রত্যাশার মাঝে থেকেও বলা যায়, আরও ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালন নেটওয়ার্কে জোগাতে হবে। যার ফলে ২০০৫ সালের মধ্যে জাতীয় গ্রিডের ক্ষমতা দাঁড়াবে ৬ হাজার ৮০০ মেগাওয়াটে। এর জন্য বিদ্যুৎ খাতে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ সরকারের গ্রাহকসেবা সংস্থাসমূহের দক্ষতা বদ্ধি, সিস্টেম লস কমানাে, যা এখন ৪০ শতাংশের নিত্যনেমাত্তক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে, এগুলোর মাধ্যমেই এটা সম্ভব। বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া, সঞ্চালন এবং বিতরণের গুরুভার হস্তান্তরই হচ্ছে দক্ষতা বাড়ানাে ও পুঁজি বিনিয়োেগ বাড়ানাের একমাত্র পথ। পল্লী বিদ্যুতায়ন কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ সরকার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি নামে পরিচিত স্থানীয় সমবায় সমিতির মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছে। এ কর্মসূচিতে সিস্টেম লস নগণ্য এবং বিল আদায়ের সাফল্য চমৎকার। বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি পল্লী বিদ্যুতায়ন বাের্ডকে বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের অনুমতি প্রদান করেছে। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া বেশ ভালাে, কারণ স্থানীয় উদ্যোক্তারা ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে পারছে, আরইবি স্থানীয় মুদ্রা টাকায় দরপত্র গ্রহণ করতে পারছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ফলদায়ক। বেসরকারি খাতকে বিনিয়ােগ উৎসাহিত করার নিমিত্তে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বাের্ডকে আরাে দক্ষ করে তােলাই হবে বাংলাদেশ সরকারের জন্য সঠিক কাজ। আরইবিকে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে আরও বিস্তার লাভের ব্যাপারে উৎসাহিত করা উচিত। 
রাসায়নিক সার:  রাসায়নিক সারের চেয়ে প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উৎপাদিত অন্য কোন পণ্য সম্পদ বিস্তারে এত কার্যকর নয়। যেখানে জিডিপির ৩৫ শতাংশ আসছে কৃষিখাত থেকে, জনসংখ্যার ২০ শতাংশ যেখানে পুষ্টির জন্য নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কম ক্যালরি পাচ্ছে, ভাত যেখানে প্রধান খাদ্য, রাসায়নিক সার সেখানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা প্রাকৃতিক গ্যাসের রাসায়নিক সারের রূপান্তরই হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের মাঝে গ্যাস সম্পদের সফল বণ্টনের সর্বোত্তম অর্জনের চাবিকাঠি। উপায়। 
বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়ন : উন্নয়নের জন্য জ্বালানি ব্যতীত বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে আর সফল সম্ভাবনা। তাই পাইপলাইন নেটওয়ার্কের বিস্তৃতির সঙ্গে এ দরিদ্র এলাকাকে উন্নয়ন বর্তনীতে নিয়ে আসতে হবে। দুটি ৫ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন রাসায়নিক সার কারখানা বাংলাদেশ ও পশ্চিমাঞ্চলকে, নাইট্রোজেন সারে ষয়ংসম্পূর্ণ করতে পারে, পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে করতে পারে প্রাণসঞ্চার। বন্দর, সড়ক পথ এবং রেল যােগাযােগের অবকাঠামােগত সমর্থনের প্রশ্ন বিবেচনা করে ভারত ও নেপালে নাইট্রোজেন রাসায়নিক সার রপ্তানির নিমিত্তে আরও একটি ৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন সার কারখানা প্রতিষ্ঠা করা যায়। 
ভারতে গ্যাস রপ্তানি : বাংলাদেশে স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত এবং পশ্চিমাঞ্চলে চাহিদার উপযােগী কাঠামাে স্থাপনের পর বাংলাদেশ সরকারের ভারতে গ্যাস রপ্তানি করা উচিত। অবশ্যই এটা স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামাে খাতের ব্যয় বহনের খরচ জোগাবে। গ্যাস রপ্তানির জন্য একটি যথােপযুক্ত নীতিমালা বাস্তবায়ন দরকার যাতে করে উৎপাদক, পরিবহনকারী এবং সাধারণ মানুষ দেখতে এবং বুঝতে পারে যে, একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া কাজ করছে। এ আইনগত এবং নীতিমালা সম্পর্কিত কাঠামাের উচিত বাংলাদেশের জন্য সুফল নিশ্চিত করা। 
পরিবেশ উন্নয়ন : বাংলাদেশ হচ্ছে একটি পরিবেশগত দুঃস্বপ্ন। শহরমুখী জনস্রোত, ডিজেল ও ফার্নেস ওয়েলচালিত পরিবহন যানের ব্যবহার এবং সার্বক্ষণিক যানজট এগুলাের মধ্যেই এ দুঃস্বপ্ন বাস্তবচিত্র রূপ পাচ্ছে। বাণিজ্যিক যান, জলযান ও রেল ব্যবস্থাকে সঙ্কুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস সিএনজি দিয়ে পরিচালনা করা দরকার। এটা একই সাথে বাঁচাবে বৈদেশিক মুদ্রা, কমাবে আমদানিকৃত পেট্রোলিয়ামের উপর নির্ভরতা, সে বাড়াবে প্রাকৃতিক গ্যাসের বাজার ও কমাবে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন। 
উপসংহার : বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বৃহৎ প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের সুফল জনগণের মাঝে পৌছে দেওয়া। এটা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। যখন সারা পৃথিবীতে জ্বালানি চাহিদা তখন বাংলাদেশের প্রয়োেজনীয় জ্বালানি বিদ্যমান, এবং প্রযুক্তি এখন সহজলভ্য। সরকারের আন্তরিকতা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা হচ্ছে একটি অনুঘটক যা প্রাকৃতিক গ্যাসকে কাজে লাগাতে পারে, পারে বাংলাদেশকে একটা মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করতে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment