বিশ্বে ক্রিকেটের আবির্ভাব: বিশ্বে ক্রিকেটের আবির্ভাব বেশ পুরােনাে। আঠারাে শ শতাব্দীর পঞ্ডাশের দশকে ইংল্যান্ডে ক্রিকেট খেলার উৎপত্তি হয়। শুরু থেকেই এ খেলাটিকে বলা হতাে 'জেন্টেল ম্যানস্ গেম'। বর্তমানেও ক্রিকেট সম্পর্কে এই উক্তিটি প্রযােজ্য। শুরুতে অনির্ণীত সময়ের টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে ক্রিকেটের আবির্ভাব হলেও উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে এসে সুনির্দিষ্ট একটি সময়ে মধ্যে বাঁধা হয় টেস্ট ক্রিকেটকে। তাছাড়া দলের খেলােয়াড়, খেলার পিচের মাপ, ক্রিকেটারদের পােশাক, ওভার প্রতি বলের হিসাবসহ আরও নানা নিয়ম এ সময় ক্রিকেটে অন্তর্ভুক্ত হয়। বিশ্বক্রিকেটকে আরও উন্নত করার জন্য একটি সর্বজনীন সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল বর্তমানে ক্রিকেটের দেখভাল করছে, যাকে সংক্ষেপে আমরা আইসিসি বলি।
বিশ্বক্রিকেটের প্রকারভেদ: বিশ্বক্রিকেট তার যাত্রা শুরু করেছিল ক্রিকেটের সবচেয়ে আভিজাত্যপূর্ণ সংস্করণ টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে। তবে বর্তমানে ক্রিকেট আর সে স্থানে নেই। ১৯৬০ সালের শেষের দিকে একদিনের ক্রিকেটের ধারণা সৃষ্টি এবং ১৯৭৫ সালে প্রথম একদিনের ক্রিকেটের বিশ্ব আসর বসে ইংল্যান্ডে। এছাড়া ২০০৭ সালে ক্রিকেটের আরও ছােটো একটি সংস্করণের বিশ্ব আসর বসে যার নাম দেয়া - হয়েছে টুয়েন্টি টুয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপ । বর্তমানে সাদা পােশাকের টেস্ট ক্রিকেটের পাশাপাশি রঙিন পােশাকের একদিনের ক্রিকেট ও টুয়েন্টি টুয়েন্টি ক্রিকেট অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
বাংলাদেশের ক্রিকেট যাত্রা: ইংরেজ শাসনামল থেকে এদেশে ক্রিকেটের যাত্রা শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তান নাম পাবার পর এদেশের ক্রিকেট খুব বেশি দূর এগােতে পারেনি। পাকিস্তানি শােষণনীতি ছিল এর বড় কারণ। স্বাধীনতালাভের পর এক দশকের মধ্যেই বাংলাদেশ আইসিসি-র সহযােগী সদস্যের মর্যাদা লাভ করে। তারপর বাংলাদেশের সুযােগ হয় বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসরে অংশগ্রহণের। কিন্তু ১৯৯০ সালে আইসিসি ট্রফিতে সেমিফাইনালে জিম্বাবুয়ের কাছে পরাজিত হয়ে সে স্বপ্ন সেবার বাস্তবে রূপ নেয়নি। অবশেষে এর সাত বছর পর অর্থাৎ ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ অপরাজিত চাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করে পা রাখে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ।
বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জন: ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জেতার কিছুদিন পরেই বাংলাদেশ একদিনের ক্রিকেট খেলার (ওয়ান ডে স্ট্যাটাস) যােগ্যতা অর্জন করে। কিন্তু টেস্ট স্ট্যাটাস না পাওয়া পর্যন্ত কোনাে দেশই আইসিসি-র সম্পূর্ণ সদস্য পদ লাভ করে না। সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি আসে ২০০০ সালের ২৬শে জুন তারিখে। আইসিসির দ্বিবার্ষিক সভায় সহযােগী ৩৬টি দেশের সর্বসম্মত ভােটে বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস লাভ করে এবং আইসিসি-র দশম টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারপর থেকেই বাংলাদেশের ক্রিকেট ক্রমােন্নতি করছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ দল ইংল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কার মতাে ক্রিকেট পরাশক্তিকে টেস্টে পরাজিত করে তাদের ধারবাহিক সাফল্যের জানান দিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ: ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসরে প্রথমবারের মতাে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করে। সে দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। এই আসরে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ ছিল ১৭ই মে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। ১১৬ রান সংগ্রহ করে এই ম্যাচ বাংলাদেশ হেরে যায়। ২৪শে মে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করে এবং প্রথমবার বিশ্বকাপে কোনাে ম্যাচ জেতার গৌরব অর্জন করে। এরপর ৩১শে মে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান। সারাবিশ্বকে বিস্ময়ে ফেলে সেই ম্যাচে বাংলাদেশ সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানকে পরাজিত করে এবং বিশ্বক্রিকেটে নতুন পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০০৭-এর বিশ্বকাপে বাংলাদেশ সুপার এইটে এবং ২০১৫-এর বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কোয়াটার ফাইনাল খেলার গৌরব অর্জন করে।
বিশ্বকাপের আয়ােজক হিসেবে বাংলাদেশ: ২০০৩ ও ২০০৭-এর বিশ্বকাপে অসাধারণ নৈপুণ্যের পর ২০১১ সালে বাংলাদেশের সামনে অসামান্য এক সুযােগ আসে। এ বছর যৌথভাবে ভারত ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ আয়ােজনের সুযােগ লাভ করে। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অসাধারণ এক জমকালাে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এদেশের মাটিতে প্রথমবারের মতাে বিশ্বকাপ আসরের সূচনা হয়। তাছাড়া একটি নিরপেক্ষ ভেন্যু হিসেবে বাংলাদেশ ইতােমধ্যেই আইসিসির প্রশংসা অর্জন করেছে।
বাংলাদেশের বর্তমান ক্রিকেটের অবস্থা: পর পর দুটি ওয়ান ডে বিশ্বকাপ এবং সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও আইসিসি চ্যাম্পিয়ন ট্রফিতে বাংলাদেশের অসামান্য সাফল্যই আমাদের বর্তমান বাংলাদেশের ক্রিকেট সম্পর্কে একটি ধারণা দেয়। বাংলাদেশ দলের গৌরব অলরাউন্ডার সাকিব-আল-হাসান তিন ধরনের ক্রিকেটেই সেরা অলরাউন্ডার হবার গৌরব অর্জন করেছেন। এছাড়া বাংলাদেশের বােলিং বিস্ময় মুস্তাফিজুর রহমান বিশ্বক্রিকেটে এখন সবচেয়ে আলােচিত ক্রিকেটার। মাশরাফির নেতৃত্ব বাংলাদেশের ক্রিকেটকে দিয়েছে অসামান্য গতি। অতি সম্প্রতি শেষ হওয়া ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ বা আইপিএল-এ মুস্তাফিজ সানরাইজ হায়দ্রাবাদ দলের হয়ে অংশগ্রহণ করেন এবং এ বছরই প্রথমবার এই দল আইপিএলের শিরােপা অর্জন করেছে। এছাড়া যুব বিশ্বকাপেও বাংলাদেশের যুব ক্রিকেটাররা অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে।
বাংলাদেশের ক্রিকেট ভবিষ্যৎ: বাংলাদেশের ক্রিকেটের এখন শুধুই সামনে এগিয়ে চলা। বর্তমানে দেশে ঘরােয়া ক্রিকেটের আসর বেশ ভালাে মানের খেলােয়াড় তৈরি করছে। তবে এই ধারা আরও তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত যাওয়া প্রয়ােজন। স্কুল থেকেই ভালাে মানের ক্রিকেটার তৈরির করার প্রচেষ্টা থাকতে হবে। এ কারণে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে আরও বেশি করে ক্রিকেট প্রতিযােগিতার আয়ােজন করতে হবে। সেখান থেকে ভালাে মানের খেলােয়াড়দের এনে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া এই ক্রিকেটারদের হাতেই -ভবিষ্যৎকালের বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাফল্য নির্ভর করছে।
উপসংহার: বিশ্বক্রিকেটে বাংলাদেশ বর্তমানে পরাশক্তির রূপলাভ করেছে। তবে সাফল্য পেতে অনেক কঠোর পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে ক্রিকেট দিয়েই বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে পরিচিতি লাভ করেছে। এই খেলায় বর্তমানে আমাদের আবেগের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়তাবাদের চেতনাও যুক্ত হয়ে গেছে। তাই ক্রিকেট এখন আমাদের কাছে নিখাদ বিনােদন নয়; একটি শক্তিও বটে। এই শক্তিকে আমাদের শ্রদ্ধা ও লালন করতে হবে। এই শক্তি নিয়েই বিশ্বের সামনে আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে।
Post a Comment