SkyIsTheLimit
Bookmark

গ্রন্থাগার রচনা

গ্রন্থাগারের উপকারিতা 
বা গ্রন্থ নির্বাচন ও ব্যবহার
বা গ্রন্থাগারের উৎপত্তি ও বিকাশ
ভূমিকা : গ্রন্থ মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ সঙ্গী। মানুষের জ্ঞান আহরণের প্রধান উৎস গ্রন্থ। সীমিত আয়ু নিয়ে মানুষ জ্ঞানার্জনের অদম্য আকাঙ্ক্ষায় বিচিত্র বিষয়ের বই পড়ে থাকে। আগ্রহী পাঠকের চোখের সামনে বই পড়ার অনিঃশেষ সুযােগ এনে দেয় গ্রনথাগার। গ্রন্থাগার জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন বইয়ের এক বিশাল সংগ্রহশালা। গ্রন্থাগার হলোে গ্রন্থের ভাণ্ডার, জ্ঞানের বিচিত্র বিষয়ের বই পুস্তক সংগ্রহ করে গ্রন্থাগার অপেক্ষা করে থাকে আগ্রহী পাঠকের জন্য। মানুষ এই জ্ঞান সমুদ্রে অবগাহন করে জ্ঞানের মনিমুক্তা আহরণ করে। মানুষের বই পড়ার আগ্রহ থেকে গ্রন্থাগারের উৎপত্তি। আর ক্রমবর্ধমান আগ্রহের জন্য গ্রন্থাগারের সম্পসারণ। জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণ নিজেদের সাধনার ফল হিসেবে গ্রন্থ রচনা করে আগামী দিনের মানুষের জন্য অফুরন্ত সম্পদ রেখে গেছেন। সে সব বই যাতে পাঠকের হাতে সহজে পৌছে যুগ যুগ ধরে জ্ঞানের আনন্দময় ঘটাতে পারে সেজন্যই গ্রন্থাগারের আয়ােজন।
গ্রন্থাগারের বৈশিষ্ট্য : ভাব-তৃষিত, জ্ঞান-পিপাসু সহস্র চিত্তের তৃপ্তি সরােবর গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগার জ্ঞানান্বেষী অগণিত মানুষের নীরব আলাপনের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। এখানে চিন্তাবিদদের জন্য আছে চিন্তার খােরাক। আছে দুরহ জিজ্ঞাসার উত্তর। হৃদয় মনের ক্ষুধা নিবৃত্তির বিপুল আয়ােজন কেবল গ্রন্থাগারেই লাভ করা যায়। গ্রন্থাগার অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের মিলনের অক্ষর নির্মিত সেতু। নদীর স্রোতের মতাে জ্ঞান প্রবাহ দেশ-দেশান্তর ও যুগ-যুগান্তরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলছে। এক হৃদয়ের ভাবরাশি নিঃশব্দে সঞ্চারিত হয়ে যায় হৃদয়ান্তরে। গ্রন্থাগার হলাে জ্ঞান চলাচলের নির্ভরযােগ্য মাধ্যম। গ্রন্থাগার মানব জীবনের এক তীর্থক্ষেত্র। এখানে সঞ্চিত থাকে বিভিন্ন বিষয়ের অসংখ্য গ্রন্থ। মানুষের সুদীর্ঘ দিনের জ্ঞানচর্চার সমস্ত স্বাক্ষর গ্রন্থাগারে নিহিত। গ্রন্থাগার অতীতকাল থেকে মানুষের জ্ঞানচর্চার ইতিহাসকে বিধৃত করে রেখেছে। আর মানুষের এই জ্ঞানের অমৃত সরােবরে অবগাহন করে তুপ্ত হয়েছে, তার চিন্তা-চেতনা, যুক্তি-বুদ্ধি, হৃদয়ানুভূতি প্রসারিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে। বিশ্বের মানুষের অফুরন্ত ভাবরাশি অবলম্বনে রচিত হয়েছে অসংখ্য গ্রন্থ। সেসব গ্রন্থ একার পক্ষে সংগ্রহ করা মােটেই সম্ভব নয়। গ্রন্থাগারে বহু মানুষের প্রয়াসে সংগৃহিত গ্রন্থ পাঠের সুযােগ পায় নানা বয়সের নানা রুচির মানুষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গ্রন্থাগারের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে চমৎকারভাবে বলেছেন, 'মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিয়া পারিত যে, সে ঘুমন্ত শিশুটির মত চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলােক কাল অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে, হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন তুষারের মধ্যে যেমন শত শত সমস্যা বাধা পড়িয়া আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানব-হৃদয়ের বন্যাকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে।
গ্রন্থাগারের উৎপত্তি ও বিকাশ : গ্রন্থাগারের ইতিহাস খুবই প্রাচীন। যখন থেকে গ্রন্থ রচিত হতে থাকে তখন থেকেই সংরক্ষণের জন্য গ্রন্থাগার স্থাপন করার রীতি চলে এসেছে। সর্ব প্রথম গ্রন্থাগার স্থাপনের কৃতিত্ব রােম দেশের। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে জনসাধারণের মধ্যে জ্ঞান বিস্তারের জন্য গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়। তাছাড়া মিশর, ব্যাবিলন, চীন, তিব্বত ও ভারতে প্রাচীন কালে গ্রন্থাগারের বিকাশ ঘটেছিল। ইসলামের আবির্ভাবের ফলে মুসলমান শাসনামলে বিভিন্ন দেশে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। আধুনিক যুগে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বৃহদাকার গ্রন্থাগার গড়ে উঠেছে। প্যারিসের Bibliotheque Natinal লণ্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম, মস্কোর লেলিন গ্রন্থাগার ও ওয়াশিংটনের সাধারণ পাঠাগার গড়ে ওঠে। ঢাকায় বাংলাদেশের এশিয়াটিক সােসাইটি গ্রন্থাগার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি, বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগার, রাজশাহীর বরেন্দ্র মিউজিয়াম প্রভৃতি বাংলাদেশের উল্লেখযােগ্য গ্রন্থাগার।
গ্রন্থাগারের প্রকার ভেেটদ : সাধারণত গ্রন্থাগারকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়- (১) ব্যক্তিগত, (২) পারিবারিক ও (৩) সাধারণ। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক গ্রন্থাগারে সীমিত পরিসরের। কিন্তু সাধারণ গ্রন্থাগারের পরিসর অনেক বড়। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রয়ােজনে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। গ্রন্থাগারে বই রাখার বিশেষ নিয়ম থাকে। বর্তমানে সারা বিশ্ব জুড়ে ডিউই পদ্ধতি বা দশমিক পদ্ধতিতে বইয়ের শ্রেণীবিন্যাস করা হয়। গ্রন্থাগার থেকে বই খুঁজে বের করার জন্য এই পদ্ধতি বিশেষ সহায়ক। আজকাল ভ্রাম্যমাণ, গ্রন্থাগার চালু আছে। 
গ্রন্থাগারের উপকারিতা : গ্রন্থাগার সভ্যতার অঙ্গ। দেশ, জাতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির উ্থান-পতনের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় গ্রন্থাগারের মধ্যে। বিশ্বের তাবৎ কবি-সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও ঐতিহাসিক সৃষ্টির মধ্যে আজকের মানুষের পরিচয় করি দেয় গ্রন্থাগার। তাদের অসামান্য সৃষ্টির মধ্যে অবগাহন করে মানুষ অপরিমেয় আনন্দ লাভ করে। গ্রন্থাগার কৌতূহল ও জ্ঞানতৃষ্ণার পরিতৃপ্তি ঘটায়। শিক্ষা ও অবসর বিনােদনের ক্ষেত্রেও গ্রন্থাগারের ভূমিকা অপরিসীম। গ্রন্থাগার সর্বজনীন পাঠশালা। এখানে জ্ঞানের সাধনার জন্য সকল মানুষের সাদর আমন্ত্রণ। বিদ্যার বৈচিত্র্যময় উপকরণ সাজিয়ে গ্রন্থাগারগুলাে সারা বিশ্বের জ্ঞানপিপাসুদের জ্ঞানতৃষ্ণা দূর করার জন্য সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। অতীতের কোলে যে মনীষীদের কণ্ঠ চিরদিনের মত নীরব হয়ে গেছে, তাদের আবিষ্কৃত গ্রন্থরাজির মধ্যে তাঁদের আলােকিত সান্নিধ্য লাভ করা যায়। তাদের আবিষ্কৃত জ্ঞান সমুদ্রে অবগাহন করে লাভ করা যায় বিমল আনন্দের অনুভূতি। গ্রন্থাগারের মাধ্যমে দেশ দেশান্তরের ও যুগ-যুগান্তরের জ্ঞান সাধনার সম্ভার জনগণের উপভােগ্য হয়। গ্রন্থাগারের সান্নিধ্যে এসে জনসাধারণের চিত্তের বিকাশ ঘটে। তাদের জ্ঞান বৃদ্ধি হয়, তারা আনন্দ উপভােগ করে এবং চিন্তাশক্তি জাগ্রত হলে জীবন হয়ে ওঠে যথার্থ উপভােগ্য।
গ্রন্থ নির্বাচন ও ব্যবহার : গ্রন্থাগারে বইয়ের সংরক্ষণ নির্বাচন সাপেক্ষ। বৃহত্তর পাঠকসমাজের যথার্থ উপকারের কথা বিবেচনা করে বই সংগ্রহ করা দরকার। গ্রন্থাগারের ধরনের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে বই সংগ্রহ করতে হবে। বৈচিত্র্যময় পাঠকের জন্য সংগ্রহেও থাকবে বচিত্র্য সব রকম পাঠক যাতে তাদের মনের খােরাক লাভ করতে পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। বই শুধু সংগ্রহ করলেই চলবে না, সুন্দরভাবে বই সংরক্ষণের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। পাঠকের গ্রন্থাগারের বই নির্বাচন করে পড়তে হবে। গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যা অনেক বেশি হলেও পাঠকের জীবনের সময় ও সুযােগ কম। সে জন্য যথাযােগ্যভাবে নির্বাচন করে বই পড়া দরকার। প্রত্যেক গ্রন্থাগারের নিজস্ব নিয়ম-কানুন থাকে। পাঠককে তা মানতে হয়। বই পড়ার সুযােগ যাতে সবাই লাভ করতে পারে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। 
উপসংহার : গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে মানুষের জ্ঞান-পিপাসা নিবৃত্ত করার জন্য। সুশিক্ষিত লােক সশিক্ষিত হয় গ্রন্থাগারের নির্মল সাহচর্যে। সেজন্য গ্রন্থাগার যাতে সমৃদ্ধ ও সুপরিচিত হয় সেদিকে সকলকে খেয়াল রাখতে হবে। বই নির্বাচন, বই সংরক্ষণ ও বই পড়ার সুবন্দোবস্ত হলেই গ্রন্থাগার স্থাপনের সার্থকতা প্রকাশ পায়। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগারের বিশেষ গুরুত্ব আছে। শিক্ষার্থীদের পাঠে অনুরাগী করে তােলা শিক্ষকের কর্তব্য। শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের গ্রন্থাগারমুখী করবেন। যে কোন পেশার লােক গ্রন্থাগার থেকে উপকার লাভ করতে পারে। সে জন্য গ্রন্থাগারের আয়ােজন থেকে সবাই যাতে উপকৃত হতে পারে সে ব্যাপারে সচেতন থাকা দরকার। আমাদের দেশে জনগণের পড়ার অভ্যাস বাড়িয়ে জাতিকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে হবে। গ্রন্থাগার এক্ষেত্রে বিপুলভাবে সাহায্য করতে পারে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment