বা পাট ও বৈদেশিক মুদ্রা
বা বাংলাদেশের পাট ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতা।
বিশ্লেষণ : পাট এক ধরনের তৃণ জাতীয় উদ্ভিদ। এ উদ্ভিদ ১০-১২ হাত পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। ডালপালাহীন এ গাছ কেবল শীর্ষে এক গুচ্ছ সবুজ পাতা নিয়ে সোজা দাড়িয়ে থাকে। পাট গাছের ছালকেই পাট বলা হয়। পাট গাছের রং সবুজ কিন্তু পাটের রং সাদা ও লালচে হয়ে থাকে। আমাদের দেশে সূতী, বগী এবং মেস্তা -এ তিন শ্রেণীর পাট উৎপন্ন হয়। সৃতী পাটের আঁশ মােটা, এটি জলা ও নিম্ন জমিতে জন্মে। বগী পাটের আঁশ মসৃণ ও শক্ত, এটি উচু জমিতে জন্মে। মেস্তা পাটের আঁশ মসৃণ কিন্তু শক্ত নয়, এটি উঁচু জমিতে ভালাে জন্মে।
উৎপত্তি : বাংলাদেশ মৌসুমি বায়ুর দেশ। তাই এখানকার জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র। আর এ জলবায়ু পাট চাষের জন্য বিশেষ উপযােগী। বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই কম-বেশি পাট উৎপন্ন হয়। তবে উৎকৃষ্টমানের পাট পাওয়া যায় ঢাকা, ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলায়। ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, ায়ানমার প্রভৃতি দেশেও উৎকৃষ্ট মানের পারট উৎপন্ন হয়।
চাষ প্রণালী : সাধারণত বাংলাদেশে চৈত্র-বৈশাখ মাসেই পাট চাষ শুরু হয়। পাট চাষ তেমন কষ্টসাধ্য কিংবা ব্যয়সাপেক্ষ নয়। পাট চাষের উপযােগী জমিকে ভালােভাবে চাষ করতে হয় যাতে সহজেই পাট গাছ বেড়ে উঠতে পারে। মই দিয়ে পাটের জমিকে সমান করা হয়। জমিতে পরিমাণ মত সার প্রয়ােগ করা হয়। বীজ বপনের কয়েক দিনের মধ্যেই পাটের চারা বের হয় এবং ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। গাছ একটু বড় হলে আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হয় এবং গাছগুলাে ঘন হলে মাঝে মাঝে কিছু গাছ তুলে পাতলা করে দিতে হয়। এতে গাছগুলাে সহজই মােটা ও উঁচু হয়। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে বড় গাছগুলাে কেটে আঁটি বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হয়। ২০-২৫ পরে ডুবিয়ে রাখা গাছগুলাে পচে নরম হয়ে ওঠে। কৃষকরা তখন পাটের কাঠি থেকে নরম আঁশগুলাে ছাড়িয়ে নেয়। পরে আঁশগুলাে পানিতে ধুয়ে রােদে শুকাতে দেয়। শুকনাে এবং শুভ্র ছালগুলােই হচ্ছে পাট। ছাল উঠিয়ে যে কাণ্ডটি থাকে, তাকে পাটখড়ি বলে। এগুলো জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
ব্যবহার : পাট একটি অতি প্রয়ােজনীয় সম্পদ। পাটের উপকারিতা বর্ণনা করে শেষ করা যায় না। উৎকৃষ্ট পাটের আঁশগুলো যেমন লম্বা, তেমনি সূক্ষ্ম এবং রেশমের মত উজ্জ্বল। পাট নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। এ পাট হতে কার্পেটও তৈরি হয়ে থাকে। দৈনন্দিন কাজে আমরা পাটের থলে ব্যবহার করে থাকি। এছাড়া পাট হতে চট, থলে, সুতা, দড়ি, কাছি প্রভৃতি জিনিস তৈরি হয়। গৃহস্থের ঘর বাঁধতে, গরু চরাতে, জিনিস পত্র বাঁধতে পাটের প্রয়োজন রয়েছে। যুদ্ধের সময়ে পাটের চাহিদা বেড়ে যায়। বােমারু বিমানের আক্রমণ হতে আত্মরক্ষা করার জন্য বালির বস্তার প্রাচীর সৃষ্টি করতে হয়। এজন্য কোটি কোটি টাকার পাটের থলে প্রয়ােজন। পাট হতে মাদুর, শিকা, কাছি ও শিল্পকর্ম সমন্বিত রকমারী পছন্দসই জিনিসও তৈরি হয়।
পাট উৎপাদন অঞ্চল : উষ্ণ জলবায়ু ও বৃষ্টিপাত পাট উৎপাদনের বিশেষ সহায়ক। নিচু অঞ্চলের পলিযুক্ত দো-আঁশ সমতল জমির যেখানে বর্ষার পানি বেশি দিন জমে থাকে না, সেখানে পাট ভাল জন্মে। সেজন্য বাংলাদেশের জমি পাট চাষের পক্ষে বিশেষ উপযােগী। এদেশ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পাট উৎপাদন কেন্দ্র। এদেশের প্রায় সবখানেই পাট জন্মে। তবে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুর, পাবনা, রংপুর ও রাজশাহী জেলায় পাট বেশি জন্মে। কিন্তু ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও পাবনার পাট গুণগতভাবে উৎকৃষ্ট ও এর আঁশগুলা দীর্ঘ, সূক্ষ্ম ও সুন্দর।
বর্তমান সমস্যা : বর্তমানে বাংলাদেশে নানা কারণে পাটের মূল্য হ্রাস পেতে থাকায় চাষীদের বিরাট ক্ষতি হচ্ছে। পাট চাষ করে চাষী তার ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে প্রথমত, পাট হতে প্রচুর আয় আসে বলে চাষীরা অতিরিক্ত লাভের আশায় পাটের চাষ বাড়িয়ে ফেলেছে। এতে প্রচুর পরিমাণে পাট উৎপন্ন হওয়া সত্ত্বেও সাথে সাথে পাটের চাহিদা না বাড়াতে পাটের মূল্য কমে গেছে। দ্বিতীয়ত, পাটের চাষ বাড়াতে গিয়ে ধান চাষে তেমন মনােযােগ না দেয়ায় খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বেড়ে গিয়েছে। এতে ক্রমবর্ধমান লােকসংখ্যার অনুপাতে খাদ্যদ্রব্যের সংকুলান হচ্ছে না। কাজেই চাউলের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। তৃতীয়ত, বিদেশেও পাটের চাষ বেড়ে যাওয়ায় পাটের রপ্তানি পূর্বের চেয়ে অনেক কমে যায়।
উপসংহার : পাট আমাদের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। এ ফসলের উপর ভিত্তি করে আমাদের দেশের কৃষকদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নির্ভর করে। এ ফসল বিদেশে রপ্তানি করে আমরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকি। কাজেই, সরকারের উচিত, পাটের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়ে দেশের পাটকলগুলােকে সচল করে তােলা।
1 comment