বা বাংলাদেশে যুবসমাজের ভবিষ্যৎ
ভূমিকা : Shakespeare বলেছেন, "Youth, I adore thee" শেক্সপীয়র যৌবনের পূজো করেন। কারণ যে কোন একটি দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য যৌবন একটি আদর্শ স্বপ্ন। আজকের যুবকই পরিচালনা করবে আগামীকালের সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতিকে। যুবকদের সেবাময় রূপ দুর্বলের পাশে দাঁড়ায় বল হয়ে হতাশার বুকে জাগায় আশা। যুবকদের প্রেমময় রূপের কারণে দরিদ্র, নিঃসহায়, প্রবঞ্চিত ও নিঃগৃহীত জনতা লাভ করে নতুন জীবন, প্রদীপত হয় অভিনব উদ্দীপনায় । যুবসমাজের অবক্ষয়ের কারণ : যুবসমাজের অবক্ষয়ের কারণ পর্যালােচনা করলে আমরা লক্ষ্য করি:
১। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় নি। রাজনৈতিক নেতারা যুবসমাজকে লেলিয়ে দেয় শিক্ষাঙ্গন থেকে যেনাে শ্লোগানের সুর উঠতে না পারে। তারপর এ অস্র দিয়ে শুরু হয় ব্যাংক ডাকাতি, ছিনতাই ও লুটতরাজ। আর এ থেকে যে কালাে টাকা আসে তা ব্যবহার করা হয় মাদকদ্রব্য সেবনে। এ রাজনৈতিক কারণটি বাংলাদেশের যুবকদের অবক্ষয়ের প্রধান কারণ।
২। শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য: বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক অবস্থা এতই নড়বড়ে হয়েছে যে, কোন ছাত্র একবার ভাত হলে তাকে বের হতে পাঁচ বছরের কোর্সে কমপক্ষে সাত বছর লাগে। সামান্য কোর্স শেষ করতে এত দর্ঘ সময় লাগার দরুন, তার শিক্ষাজীবনের অধিকাংশ সময়ই হয় আইডেল। কথায় বলে, "Idle brain is the deVi'S workshop. আর এ থেকেই হয়ে পড়ে সে উচ্ছংখল ও বেপরােয়া।
৩। চাকরি ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি : বহু কষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি দেবার পরও একজন ছাত্রের চাকরি প্রাপ্তির কোন নিশ্চয়তা নেই। বরঞ্চ দেখা যায়, যে ছেলে নকল করে পাস করে সে ছেলেই কালক্রমে পেয়ে যায় বড় ধরনের একটি পদ। আর এর ফলে সারা বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাই আজ নড়বড়ে। ছাত্ররা আজকাল অবৈধ নকলের দাবি তােলে। তােলার কথা তাে বটেই। কারণ, তারা তাদের চোখের সামনে দেখছে রাজনৈতিক নেতারা কিভাবে ভােট ডাকাতির মাধ্যমে ভোট ছিনিয়ে নিচ্ছেন।
৪। শিক্ষকদের দায়িত্বহীনতা : একজন আদর্শ শিক্ষকের সুশিক্ষার ফলেই দৈশ হয় সুশিক্ষিত এবং উন্নত। কিন্তু বাংলাদেশের প্রায় শিক্ষকগণ আজ ব্যক্তিস্বার্থ, প্রাইভেট টিউশনি ও রাজনৈতিক দলাদলিতে এত বেশি জড়িয়ে গেছেন যে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া হচ্ছে কিনা, তা দেখার সময় তাদের নেই। শিক্ষকদের এ দায়িত্বহীনতা যে ছাত্রদের কতটুকু অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা কি তারা কখনও ভেবে দেখেছেন?
৫। অভিভাবকদের দায়িত্বহীনতা : বাংলাদেশের প্রায় মাতাপিতাই আজকাল সন্তানদের খবরাখবর তেমন রাখেন না। সন্তান কুল কলেজে গেছে কি যায় নি, গেলেও সেখানে কি করছে, সারা দিন রাত কোথায় থাকে সে ব্যাপারে তাদের তেমন একটা নেই। অভিভাবকদের এ দায়িত্বহীনতা যুবকদের অবক্ষয়ে অনেকখানি সহায়তা করছে।
৬। পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব : পশ্চিমা সংস্কৃতির পরিত্যাজ্য অংশটুকু এ দেশের যুবসমাজ ভালােভাবেই গ্রহণ করেছে। পশ্চিমের *Free Sex" -এর বদৌলতে দেশের সমাজে জীবনে বিস্তার লাভ করেছে Rape বা ধর্ষণ। যেহেতু এ সমাজে "Free Sex" -এর কোন আইন নেই, “নীলছবি” এর বদৌলতে ব্যাপারটি দাঁড়িয়েছে ধর্ষণে।
৭। সহশিক্ষা: সহশিক্ষা ব্যবস্থাও যুবকদের নষ্ট হওয়ার পেছনে অনেকখানি দায়ী। কারণ, একই সাথে যে ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া করে, তারা হয়ত একই সাথে মিশতে পারে না সামাজিক বাধার জন্য। আর এ থেকেই যে ব্যর্থ প্রেমের জন্ম নেয়, তার আবার জন্ম দেয় হতাশার, আর এ হতাশা আনয়ন করে ব্যভিচার।
৮। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের উন্মেষ : পশ্চিমা সামাজিক কায়দায় এদেশের বহু প্রাচীন যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যাচ্ছে এর ফলে প্রসার ঘটছে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের এবং হ্রাস পাচ্ছে মূল্যবােধ। মূল্যবােধের এ অবক্ষয় মূলত যুবসমাজকেও অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে
৯। নারীর স্বাধীনতা : বাংলাদেশে এমন এক সময় ছিল যখন নারী ছিল আদর্শের প্রতীক। শত লাঞ্জনা গঞ্জনা সহ্য করেও তারা পরিবারকে আকড়ে ধরতাে। এতে সামাজিক বন্ধন অটুট থাকতাে এবং সন্তানেরা মায়ের দুঃখের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে নিজেকে সুশিক্ষিত করে তুলতাে। কিন্তু এখন আধুনিক নারীসমাজ প্রগতির ধাক্কায়, দুপাতা বিদ্যার ধাক্কায় আর কোন সামান্য, বাকবিতণ্ডা সহ্য করতে প্রস্তুত নয়। এর ফলে সংসার ভাঙছে আর বিস্তার লাভ করছে বহু বিবাহ। ফলে সন্তানেরা হচ্ছে পিতা-মাতার অধিকার থেকে বঞ্চিত। সমাজ করছে তাদেরকে পরিহাস। তাই তারা হয়ে পড়ছে হতাশাগ্রস্ত এবং হতাশা নিবারণের জন্য গ্রহণ করছে ড্রাগ, যা তাদেরকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে চালিত করছে। আর ড্রাগের অর্থ যােগাড় করতে নিজেকে সাজাচ্ছে মাস্তান।
১০। অভিভাবকদের আদর্শহীনতা : এমন এক সময় ছিল যখন পিতা-মাতারা আদর্শের প্রশ্নে আপােষ করতেন না কখনােই। নীতির ক্ষেত্রে তাঁরা কখনও হতেন না। একজন শিক্ষক স্কুল, কলেজে ঠিকমতো লেখাপড়া না করিয়ে বাড়িতে প্রাইভেট পড়ান, আর পরীক্ষার হলে ছাত্রদের থেকে টাকা নিয়ে নকল করতে সহায়তা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা প্রশ্ন পত্র ফাঁস করে দেন। এ যখন প্রবীণদের অবস্থা তখন নবীনদের নৈতিক অবক্ষয় না হয়ে উন্নত হব এ ধরনের চিন্তা করা বিকৃত মস্তিষ্কের পরিচয় মাত্র।
প্রতিকার: উপরােক্ত কারণগুলাে পুঞ্জীভূত সমস্যা। একদিনে এর প্রতিকার সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে তার প্রতিকার করতে হবে। তার জন্য নিম্নোক্ত পয়েন্টসমূহ বিবেচনায় আনতে হবে।
(ক) এ দেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।
(খ)অস্ত্রের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।
(গ) যথার্থ শিক্ষানীতি প্রণয়নের মাধ্যমে যথাসময়ে শিক্ষাবর্ষ সমাপ্ত করতে হবে।
(ঘ) শিক্ষকদের যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।
(ঙ) ছাত্রদের দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে।
(চ) প্রায়ােগিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে, যাতে করে ছাত্ররা শিক্ষাবর্ষ সমাপ্ত হওয়ার পর অর্থনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হতে পারে।
(ছ) সুস্থ সাহিত্য সাংস্কৃতিক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে হবে।
(জ) যুবসমাজের জন্য বিনােদনমূলক ব্যবস্থার প্রসার ঘটাতে হবে।
(ঝ) অভিভাবকদের যথাসময়ে তাদের সন্তানদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। যার ফলে তাদের মন কুপথে । চালিত হতে পারবে না।
(ঞ) পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে।
উপসংহার : বাংলাদেশের জনসংখ্যার অধিকাংশই যুবক। তাই তারা যদি এভাবে নষ্ট হতে থাকে তাহলে গােটা দেশটাই উচ্ছন্নে যাবে। সুতরাং এ ব্যাপারে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, সরকার, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী সবাইকে সচেতন হতে হবে যাতে করে যুবকরা পূর্ণাঙ্গরূপে, নৈতিক ও আদর্শবান হয়ে এ দেশের সকল অন্যায়, অবিচার, অনাচার দূর করে একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
Post a Comment