বা মায়ের ভাষা ও ভূমি
ভূমিকা : মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি মানুষের চির শ্রদ্ধার বস্তু। জন্ম পরিগ্রহের পর মানবশিশু ও পশুশাবকের মধ্যে তেমন পার্থক্য থাকে না। উভয়ই বিশাল পৃথিবীর দিগন্তবিস্তৃত আকাশের নিচে দুর্বল ও অসহায়। কিন্তু পশুশাবকের বিশেষত্ব হল এই যে, সে প্রকৃতি থেকে নিজে নিজেই হাঁটতে শেখে, খেতে শেখে, চলাফেরা করতে শেখে এজন্য তাকে অন্যের উপর নির্ভর করতে হয় না। কিন্তু মানব শিশুর জীবনের অস্তিত্ব নির্ভর করে সম্পূর্ণভাবে মায়ের আদর যত্নের উপর। পৌষের কনকনে শীতের মধ্যে মা শিশুকে গরম কাপড় জড়িয়ে বুকে আগলে রাখে, ক্ষুধার তাড়নায় শিশু যখন কাদতে থাকে মা তখন শিশুকে দুধ খাইয়ে দেয়। এভাবে অবুঝ শিশু সর্বপ্রথম মাকে চিনতে পারে। মা দৃশ্যে আড়াল হলে সে কান্নাকাটি শুরু করে। শিশু দিনে দিনে বড় হতে থাকে। মা শিশুকে মা ডাকতে শেখায়। এক সময় শিশু মুখে 'মা উচ্চারণ করে। এভাবে শিশু মায়ের কাছ থেকে সর্বপ্রথম ভাষা তথা মাতৃভাষা আয়ত্ত করে। ধীরে ধীরে শিশু হাঁটতে শেখে। সময়ের পরিক্রমায় সে বড় হতে থাকে। পৃথিবীর আলােবাতাস, তাপ সে গ্রহণ করে। চারদিকের বনবনানী, শ্যামল শ্যামলিমা, পাহাড়পর্বত, ফসলের মাঠ, সবুজের সমারােহ তাকে মুগ্ধ করে। সে তার চারপাশের প্রকৃতিকে মায়ের মত ভালাে, বাসতে শেখে। কারণ, জন্মের পর সে এ ভূমিকেই সর্বপ্রথম চিনতে পারে। এজন্য এ ভূমি তার কাছে মাতৃভূমি।
মা ও মাতৃভাষা : মাতৃগর্ভ হতে ভূমিষ্ঠ হয়ে মানুষ মায়ের কাছেই ভাষা আয়ত্ত করতে শেখে। জন্ম হতে যে ভাষা উচ্চারণ করে মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে তাই মাতৃভাষা। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, "মাতৃভাষা মাতৃ স্তনের ন্যায়। জননীর স্তন্য দুথে মাতৃভাষার ভাব দোহন করে মানুষ মানসিক পুষ্টি লাভ করে। আজন্ম যে ভাষার সাথে তার পরিচয়, যে ভাষার মধ্য দিয়ে শিশু মাতাপিতা, আত্মীয় ও পরিজনবর্গের হৃদয়বৃত্তির অভিব্যক্তি উপলদ্ধি করে, সে ভাষাই তার অস্থিমজ্জার সাথে মিশে থাকে। মাতৃভাষার মাধ্যমেই আমরা নিজেদের জীবনকে, কৃষ্টিকে এবং চিন্তাধারাকে প্রসারিত করতে পারি। হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশের শতমুখী ভাবধারাকে আমরা পরিস্ফুট করতে পারি একমাত্র মাতৃভাষার সাহায্যেই।
মা ও মাতৃভূমি : "জননী জন্মভূমি ষর্গাদপি গরীয়সী।" কবি সাহিত্যিকরা তাঁদের প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বর্গের মহিমায় দীপান্বিত করে নিজেরা মহিমান্বিত হয়েছেন, মাতৃভূমিকে করেছেন গৌরবান্বিত। তাঁরা তাঁদের মাতৃভূমির ভাবনা তাঁদের কথায়, তাদের লেখায়, তাদের উচ্চারণে বাঙময় করেছেন। কখনও কখনও মাতৃভূমিই তাঁদের কাছে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাতৃভাষার গুরুত্ব তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন-"আমাদের মধ্যে যাহা কিছু অমর এবং আমাদিগকে যাহা কিছু অমর করিবে সে সকল মহাশক্তিকে ধারণ করিবার, পােষণ করিবার, প্রকাশ করিবার এবং সর্বত্র প্রচার করিবার একমাত্র উপায় যে মাতৃভাষা।” সাহিত্যে মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে আলােচনা করতে গিয়ে সুসাহিত্যিক মােঃ ওয়ােজদ আলী বলেছেন, "বাংলা আমাদের মাতৃভাষা এবং এ মাতৃভাষা ও সাহিত্যের যথােচিত সেবা ছাড়া আমাদের সামাজিক ও জাতীয় উন্নতি একান্তই অসম্ভব।
সাহিত্যের মাতৃভূমি : কবি-সাহিত্যিকদের কাছে তাঁদের মাতৃভূমির ধূলিকণা পরম আদরণীয় জিনিস, খাটি সােনার চেয়েও আরও বেশি খাটি। বিদ্রোহী কবির কণ্ঠে সুন্দরভাবে ধ্বনিত হয়েছে,
"আমার দেশের মাটি
ও ভাই খাটি সােনার চেয়ে খাটি।"
মাতৃভূমির রূপসুধায় মােহিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাতৃভূমির প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা জানিয়েছেন। উচ্চারণ করেছেন,
"আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি
চিরদিন তােমার আকাশ তােমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।”
আধুনিক প্রজন্মের কবি সৈয়দ আলী আহসান মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসা জানাতে গিয়ে বলেছেন,
“আমার পূর্ব বাংলা একগুচ্ছ অন্ধকারের সিন্ধ তমাল।"
বস্তুত মাতৃভূমির মাটি কবি-সাহিত্যিকদের কাছে মধুর চেয়েও মধুর অনুভবের, হীরা মানিকের চেয়ে মূল্যবান। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের উচ্চারণে এ সত্য প্রকাশিত হয়েছে,
"মধুর চেয়ে আছে মধুর সে আমার দেশের মাটি
আমার দেশের পথের ধূলা খাটি সােনার চেয়ে খাঁটি।"
কবি-সাহিত্যিকরা জানেন মাতৃভূমি তাঁদের শেষ ভরসার স্থান। তাঁদের শেষ আশ্রয়। তাই মরার পরেও পরজীবনে করি মাতৃভূমিতে আবার ফিরে আসার বাসনা ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন,
'আবার আসিব ফিরে
ধান সিঁড়িটির তীরে এ বাংলায়।'
উপসংহার : মাতৃভূমি একটি প্রস্ফুটিত ফুল আর তার সুবাস হচ্ছে মাতৃভাষা। তাই মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার সাথে মানুষ আবদ্ধ হয় বিনি সুতাের মালার এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে। মর্মের সবগুলাে বাঁধন দিয়ে এদের বেঁধে রাখতে চায় অমূল্য মণিমুক্তার মত। তাই মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা ভালবাসার দাবি, জীবনের দাবি, মনুষ্যত্বের দাবি। মাতৃভাষাকে আশ্রয় করেই একটি জাতি লালিত-পালিত ও বিকশিত হয়। জাতির ভাব কল্পনা, আত্মার আকুলতা, ব্যাকুলতা, হৃদয়ের প্রেম-ভালােবাসা মাতৃভাষার মাধ্যমেই রূপায়িত হয়। তাই মাতৃভাষা মায়ের মত।
Post a Comment