সম্ভাবনাময় সফটওয়্যার শিল্প ও বাংলাদেশ
সফটওয়্যার ও আধুনিক জীবন
ভূমিকা : প্রতিনিয়ত আবিষ্কৃত ও উদ্ভাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এক একটা জিনিস আর এতে প্রভাবিত হয়ে নিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে প্রায় ছয়'শ কোটি মানুষের প্রাত্যাহিক জীবন। বাংলাদেশ এ পৃথিবীর একটি অংশ। অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর হলেও আগামি শতকের তথ্য প্রযুক্তির যুগে এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে দেশটির। ইতােমধ্যে গার্মেন্টস খাত ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে বহির্বিশ্বে, সে সাথে একটি বিশাল কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে এ শিল্প। গার্মেন্টসের চেয়েও অধিক সম্ভাবনাময় যে খাতটি নিয়ে তােলপাড় চলছে সারা দেশে তা হচ্ছে সফটওয়্যার (Software) শিল্প। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পাল্টিয়ে দিতে পারে এ সফটওয়্যার। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত এর উজ্জ্বল সম্ভাবনা বুঝতে পেরেছিল বলেই গত দশ বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় বর্তমানে পৃথিবীর নেতৃস্থানীয় সফটওয়্যার রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হতে সক্ষম হয়েছে। সফটওয়্যার কি : একটি সাধারণ অর্থাৎ, গতানুগতিক প্রস্তুতকারক অথবা বাণিজ্যিক ধরনের ব্যবসায় চেয়ে সফটওয়্যার ব্যবসায়টি একটু ভিন্ন ধরনের। এটাকে বলা যায় জ্ঞানভিত্তিক ব্যবসায়ের। সুতরাং, অন্যান্য পেশাগত সেবা যেমন—মেডিক্যাল সার্ভিস অথবা স্থাপত্য ফার্মের চেয়ে সফটওয়্যার ব্যবসায় একটু ভিন্ন ধরনের যা শুধু সফটওয়্যারে দক্ষ পেশাগতরাই করতে পারে। কম্পিউটার সফটওয়্যার এবং সার্ভিস এমনই একটি পণ্য যাকে গতানুগতিক সংজ্ঞার আওতাভুক্ত করা যায় না। কোম্পানির প্রস্তুতকৃত বা নির্মিত দৃশ্যমান পণ্যের মত সফটওয়্যারের কোন আকার আকৃতি রং ও গন্ধ নেই। এগুলাে এমন নয় যে, কেউ একে শারীরিক অঙ্গদ্বারা ধরতে পারে বা অনুভব করতে পারে। এটা অনেকটা মিউজিক সদৃশ
সফটওয়্যার শিল্পের যাত্রা : ১৯৬৪ সালে আমাদের দেশে কম্পিউটারের ব্যবহার আরম্ভ হলেও আমরা এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে আরম্ভ করি ১০ দশকের প্রথম দিক থেকে। এ সময় কয়েকটি সাধারণ সফটওয়্যার নিয়ে যাত্রা শুরু হয় আমাদের কম্পিউটারের। শিল্পোদ্যোক্তারা এ সময় এটাও বুঝতে পারেন যে, বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে এক উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় সেক্টর হচ্ছে সফটওয়্যার রপ্তানি। যে গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা হয়েছিল অবশেষে তার বিকাশ হয়েছিল সফল ঘটনার রেশ ধরেই। শিল্পোদ্যোক্তারা সফটওয়্যার রপ্তানি বিষয়ে প্রয়ােজনীয় সার্ভে এবং অনুসম্ধান চালিয়ে দেখতে পান এ দেশে পুরােপুরি অনুকর এবং সম্ভাবনাময় পরিবেশ বিদ্যমান। এতে কিছু তরুণ ব্যবসায়ী উৎসাহিত হন এবং নিজস্ব উদ্য্যাগে সফটওয়্যার তৈরি করে এবং স্থানীয় বাজারে বাজারজাতসহ অনেক বিদেশী বাজারেও ছাড়া শুরু করেন। এভাবে শুরু হয় সফটওয়্যার শিল্পের পথ চলা।
সফটওয়্যার শিল্পের সম্ভাবনা : বাংলাদেশে সফটওয়্যার শিল্পের বিকাশে অনেক সম্ভাবনা বিদ্যমান। নিচে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ বাংলাদেশে থেকে সফটওয়্যার শিল্পের সম্ভাবনা তুলে ধরা হল:
জনশক্তি: অন্য যে কোন শিল্পের সাথে সফটওয়্যার শিল্প বা তথ্য শিল্পের একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। এ শিল্প শুরু করতে বিশাল যন্ত্রপাতি বা বড় বড় সুবিস্তৃত দালান কোঠার কোন প্রয়ােজন নেই। কম্পিউটার নামক যে যন্ত্রটির প্রয়ােজন সেটি তুলনামূলকভাবে স্বল্পমূল্যের। বাইরের জগতের সাথে যােগাযােগ রক্ষার জন্য যে প্রযুক্তি প্রয়ােজন সেটি বাংলাদেশে রয়েছে। এবং তার বিস্তার করা মােটেও দুঃসাধ্য নয়। অবকাঠামােগতভাবে একমাত্র যে জিনিসটির প্রয়ােজন সেটা হচ্ছে দক্ষ জনশক্তি। বাংলাদেশে অবশ্য জনশক্তির কোন অভাব নেই, কিন্তু দক্ষ জনশক্তির সত্যিই অভাব রয়েছে। তবে এ অভাব বেশিদিন থাকবে না। কেননা, বর্তমানে আমাদের দেশের কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলােতে কম্পিউটার চালু করা হয়েছে। প্রতি বছর হাজার হাজার দক্ষ জনশক্তি বের হয়ে আসছে। ফলে আমাদের দেশে সফটওয়্যার শিল্পের সমভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
স্বল্প মজুরির সুবিধা : স্বল্প মজুরির সুবিধা বাংলাদেশে সফটওয়্যার শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে একটি বিরাট ইতিবাচক দিক। বাংলাদেশে যে সস্তা শ্রম পাওয়া যায় বিশ্বের কোন দেশে তা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ এ সস্তা শ্ৰমকে কাজে সফটওয়্যার শিল্পে বিরাট সাফল্য অর্জন করতে পারে।
সরকারের ভূমিকা : দেশে বড় কিছু আরম্ভ করতে হলে সব সময় সরকারের একটা বড় ভূমিকা থাকতে হয়। সরকার কিছু একটা করতে চাইলেই যে দেশে সেটা করে ফেলতে পারবে সে ব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা নেই। কিন্ত সরকার কোন ব্যাপারে। উৎসাহ না দিলে সেটি যে এক পাও অগ্রসর হবে না সে ব্যাপারে এতটুকু সন্দেহ নেই। তথ্য প্রযুক্তি জগতে সে জন্য নতুন একটি শব্দ সংযােজন হয়েছে সেটি হচ্ছে It Friendly Government (তথ্য প্রযুক্তির প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন সরকার)। আমাদের দেশের সফটওয়্যার শিল্পের ব্যাপারে আমরা অত্যন্ত আশাবাদী। কারণ, বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে প্রকৃত অর্থে উৎসাহ দিতে আরম্ভ করেছেন। ১৯৯২ সালের ২১ এপ্রিল রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরাের পৃষ্ঠপােষকতায় বাংলাদেশে সফটওয়্যার শিল্পের বৃদ্ধি এবং এর উন্নয়নকল্পে "এক্সপাের্ট ইলেকট্রনিক্স এণ্ড সফটওয়্যার ফ্রম বাংলাদেশ প্রগ্রেস, পসিবিলিটিস এণ্ড প্রবলেম শিরােনামে একটি সেমিনারের আয়ােজন করা হয়। এ সেমিনারে প্রস্তাবমালার আলােকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটিকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হতে সফটওয়্যার রপ্তানিতে যাবতীয় বাধা দূর এবং এর দ্রত উন্নয়নকল্পের সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলাে মােকাবেলার জন্য প্রয়ােজনীয় প্রস্তাবমালা পেশ করার জন্য বলা হয়। একই বছরের সেপ্টেম্বরে জামিলুর রেজা চৌধুরী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি রিপাের্ট পেশ করেন। তার এ রিপাের্টে বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে যে চারটি সমস্যা প্রধানতভাবে দেখান হয়েছিল সেগুলাে হচ্ছে।
ক. অর্থবছরের বাজেটে সফটওয়্যারের স্থান;
খ. মানব সম্পদ উন্নয়ন;
গ. অবকাঠামাে এবং
ঘ. বিপণন।
বিজ্ঞান গ্রাজুয়েট : আমাদের দেশে সফটওয়্যার শিল্প গড়ে তােলার জন্য জনশক্তির সৃষ্টি হবে বিজ্ঞান, ফলিত বিজ্ঞান বা ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রাজুয়েটদের থেকে। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ থেকে মােটামুটি অনেক বিজ্ঞান গ্রাজুয়েট বের হয়ে আসছে, যাদেরকে এ শিল্পে ব্যবহার করা যাবে। সেটিকে সত্যিকার অর্থে অর্থপূর্ণ করতে হলে প্রধানত দুটি কাজ করতে হবে। প্রথমত, ছাত্র রাজনীতি নামক ব্যাপারটির জন্য শিক্ষা কার্যক্রমের যে ক্ষতি হচ্ছে সেটি বন্ধ করতে হব। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার মানকে বিশ্ব পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে।
প্রবাসী বাংলাদেশী : সফটওয়্যার শিল্প প্রকৃত অর্থে গড়ে তুলতে চাইলে সেটি রপ্তানির উপযোেগী হতে হবে। সে উদ্দেশ্যে বহির্বিশ্বের সাথে যােগাযােগ করিয়ে দেওয়ার জন্য প্রবাসী বাংলাদেশীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ভারতের সাথে তুলনা করা হলে বাংলাদেশের প্রবাসীরা দেশে বিদেশে নানা জায়গায় এখন সমপরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হাজির হতে পারেন নি। কিন্তু তবুও একটি বড় সংখ্যা নানা ধরনের দায়িত্বে রয়েছেন। দেশে সফটওয়্যার শিল্প গড়ে তােলার জন্য তাদের সক্রিয় ভূমিকা বিশেষ প্রয়ােজন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, যদিও আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি আজ থেকে ৩৫ বছর পূর্বে কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে আমরা তেমন অগ্রসর হতে পারি নি। তাই আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকল্পে শীঘ্রই তথ্য প্রযুক্তির রপ্তানিতে ঢােকার জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা একান্ত প্রয়ােজন। অনেক ত্যাগতিতিক্ষা আর সংগ্রামের পর জন্ম হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের। এখন লড়াই করতে হবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য। পুরােপুরি স্বাবলম্বী হতে পারলেই আসল বিজয়ের স্বাদ অনুভব করা যাবে। তা না হলে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে আমাদের স্বাধীনতা।
1 comment